আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী চাইতেন, কেবল আনন্দের জন্য শারীরিকভাবে মিলনের ব্যাপারে নারীরা যেন প্রতিরোধ করে। গান্ধীর মতে নর-নারীর যৌ ন সম্পর্ক হবে শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্য যতটুকু দরকার, ততটুকুই।
মার্কিন একজন জন্মনিয়ন্ত্রণকর্মী এবং যৌ ন শিক্ষাবিদ মার্গারেট স্যাঙ্গারের সঙ্গে ১৯৩৫ সালে গান্ধীর যে কথোপকথন হয়েছিল, ২০১৮ সালে প্রকাশিত বিবরণ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।
গান্ধীর এক নতুন জীবনীগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ সালে। যা লিখেছেন ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ। সেই বইয়ে নারী অধিকার, যৌ নতা এবং কৌমার্য বিষয়ে গান্ধীর ভাবনা উঠে এসেছে। মার্গারেট স্যাঙ্গারের সাথে গান্ধীর কথোপকথনের বিস্তারিত নোট নিয়েছিলেন গান্ধীর সচিব মহাদেব দেশাই।
তিনি লিখেছেন, মনে হচ্ছিল দু’জনেই একমত যে নারীর মুক্তি হওয়া উচিৎ- তার নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা হওয়া উচিৎ। কিন্তু খুব দ্রুতই তাদের মধ্যে মতভেদ দেখা গেল।
স্যাঙ্গার ১৯১৬ সালের নিউইয়র্কে খুলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্র। তিনি মনে করতেন, জন্মনিরোধকই হচ্ছে নারীর মুক্তির সবচেয়ে নিরাপদ পথ।
কিন্তু গান্ধী বলেন, পুরুষদের উচিৎ তার ‘জান্তব কামনা’কে সংযত করা, আর নারীদের উচিৎ তাদের স্বামীদের বাধা দেয়া।
তিনি স্যাঙ্গারকে বলেন, যৌ নক্রিয়া করা উচিৎ শুধু সন্তান উৎপাদনের জন্যই।
সে বছর ভারতের ১৮টি শহরে সফর করেছিলেন স্যাঙ্গার, কথা বলেছিলেন ডাক্তার ও কর্মীদের সাথে। কথাবার্তার বিষয়বস্তু ছিল- জন্ম নিয়ন্ত্রণ এবং নারীমুক্তি।
তিনি মহারাষ্ট্র রাজ্যে গান্ধীর আশ্রমেও গিয়েছিলেন এবং সেখানেই তার সাথে স্যাঙ্গারের এই কৌতুহলোদ্দীপক আলোচনা হয়। তবে গান্ধীর মতামত শুনেও স্যাঙ্গার দমে যাননি। তিনি বিতর্ক চালিয়ে গিয়েছিলেন।
‘কিন্তু নারীরও তো গভীর যৌ ন অনুভুতি আছে, তারা পুরুষের মতোই গভীর এবং তীব্র’ তিনি বললেন, এমন সময় আছে যখন নারীরাও ঠিক তাদের স্বামীদের মতোই শারীরিক মিলন চায়।’
‘আপনি কি মনে করেন যে যখন একজন নারী ও পুরুষ পরস্পরের প্রেমে আবদ্ধ এবং সুখী, তখন তারা শুধু বছরে দু’একবার যখন সন্তান চাইবে তখনই যৌ ন মিলন করবে- এটা কি সম্ভব?’ প্রশ্ন করেন স্যাঙ্গার।
তিনি যুক্তি দেন- ‘ঠিক এই ক্ষেত্রেই জন্মনিয়ন্ত্রণ খুবই সুবিধাজনক- যা নারীকে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ থেকে রক্ষা করবে এবং তার দেহের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে।’
কিন্তু গান্ধী একগুঁয়েভাবে তার বিরোধিতা করতে থাকলেন। তিনি স্যাঙ্গারকে বলেন, তিনি সব যৌ নতাকেই ‘কামনা’ বলে মনে করেন। গান্ধী বলেন, তার স্ত্রী কস্তুরবার সাথে তার সম্পর্ক তখনই ‘আধ্যাত্মিক’ হয়ে উঠেছিল যখন তিনি ‘শারীরিক কামনার জীবনকে বিদায় দিয়েছিলেন।’
১১২৯ পাতার এই বইয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত শান্তিবাদী নেতার ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে প্রত্যাবর্তন থেকে শুরু করে ১৯৪৮ সাথে তার নিহত হওয়া পর্যন্ত সময়কালকে তুলে ধরা হয়েছে।
গান্ধী বিয়ে করেছিলেন মাত্র ১৩ বছর বয়েসে। এর পর ৩৮ বছর বয়সে- যখন তিনি চার সন্তানের পিতা- তখন তিনি ‘ব্রহ্মচর্য’ বা যৌ নসম্পর্কবিরহিত জীবনযাপন শুরু করেন।
গান্ধী নিজেই আত্মজীবনীতে লিখেছেন, তার পিতা যখন মারা যান- তখন তিনি তার স্ত্রীর সাথে যৌ নমিলন করছিলেন বলে পিতার পাশে থাকতে পারেননি- এই অপরাধবোধ তাকে তাড়া করছিল।
অবশ্য, মার্গারেট স্যাঙ্গারের সাথে কথাবার্তার শেষ দিকে গান্ধী তার সাথে কিছুটা একমত হন। তিনি বলেন, পুরুষের স্বেচ্ছামূলক বন্ধ্যাকরণে তার আপত্তি নেই, কারণ পুরুষই মুখ্য ভূমিকা নেয়। তাছাড়া গর্ভনিরোধক ব্যবহারের চাইতে প্রতিমাসে নারীর যে ‘নিরাপদ সময়’ থাকে তখন স্বামী-স্ত্রী যৌ নমিলন করতে পারে।
স্যাঙ্গারের এসব যুক্তি খুব পছন্দ হলো না। তার ভাবনাকে গান্ধী যে স্বীকৃতি দিলেন না এতে তিনি গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন। তিনি পরে লিখেছিলেন, প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দেয়া এবং অবাধ যৌ নাচার সম্পর্কে গান্ধীর প্রচন্ড ভীতি আছে। গান্ধীর দিক থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা অবশ্য এই প্রথম নয়।
তিনি একবার একজন নারী-অধিকার কর্মীকে বলেছিলেন, আপনি কি মনে করেন যে জন্মনিরোধক দিয়ে শরীরের স্বাধীনতা পাওয়া সম্ভব? নারীদের বরং শেখা উচিৎ কিভাবে তাদের স্বামীদের ঠেকাতে হয়। পশ্চিমা দেশের মতো গর্ভনিরোধক ব্যবহার করলে ভয়াবহ পরিণতি হবে, নারী আর পুরুষ বাঁচবে শুধু যৌ নতার জন্য, তাদের মস্তিষ্ক হবে দুর্বল। নীতিবোধ ভেঙে পড়বে।
‘দি ইয়ার্স দ্যাট চেঞ্জড দি ওয়ার্ল্ড’ নামের বইটিতে রামচন্দ্র গুহ বলেছেন, গান্ধী মনে করতেন যৌ নতা হচ্ছে ‘জান্তব কামনা’ মাত্র, যা বংশবৃদ্ধির জন্য দরকার। আর জন্মনিয়ন্ত্রণ এই জান্তব কামনাকে বৈধতা দিয়ে দিচ্ছে।
এর অনেক বছর পর নোয়াখালীতে ভারত ভাগকে কেন্দ্র করে যথন ভয়াবহ হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা চলছে- তখন গান্ধী এক বিতর্কিত পরীক্ষায় অবতীর্ণ হলেন। তিনি তার নাতনি এবং সর্বক্ষণের সঙ্গী মানু গান্ধীকে বললেন, তার সঙ্গে একই বিছানায় ঘুমাতে।
তিনি চাইছিলেন এটা পরীক্ষা করতে যে তিনি তার যৌ ন আকাঙ্খাকে সম্পূর্ণ জয় করতে পেরেছেন কিনা। গুহ লিখছেন, গান্ধী মনে করতেন- তিনি যে পরিপূর্ণ ব্রহ্মচারী হতে ব্যর্থ হয়েছেন তার সাথে ভারতের ধর্মীয় সংঘাতের একটা সম্পর্ক আছে।
তবে মানু গান্ধীকে নিয়ে ঘুমানোর পরীক্ষার কথা যখন গান্ধী তার সহযোগীদের বললেন, তখন তারা সতর্ক করেছিলেন যে তিনি যেন এটা না করেন এবং এতে তার সুনাম ক্ষুণ্ণ হবে।
একজন সহকারী বলেছিলেন, এটা দুর্বোধ্য এবং সমর্থনের অযোগ্য। আরেকজন এর প্রতিবাদে গান্ধীর সাথে কাজ করা ছেড়ে দিয়েছিলেন।
স্পষ্টতই নারীদের সাথে গান্ধীর সম্পর্ক ছিল জটিল। যে নারীরা পুরুষদের কাছে নিজেদের আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করে তাদের তিনি দেখতে পারতেন না। আধুনিক চুলের স্টাইল এবং পোশাক সম্পর্কে তার ছিল তীব্র ঘৃণা।
মানু গান্ধীকে তিনি লিখেছিলেন, তিনি মুসলিম নারীদের বোরকারও বিরোধী ছিলেন। অন্যদিকে তিনি আবার নারীদের শিক্ষা, কাজ করার অধিকার এবং নারীপুরুষের সাম্যেরও সমর্থক ছিলেন।
তিনি নারীদের সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলনে যুক্ত করেছিলেন, সরোজিনী নাইডুকে কংগ্রেসের নেত্রী বানিয়েছিলেন- যখন পশ্চিমা দেশেও নারী রাজনৈতিক নেত্রী ছিলেন খুবই কম। তবে গান্ধী এটাও মনে করতেন যে, সন্তান লালন-পালন এবং গৃহকর্ম নারীদেরই কাজ।
তার একজন সহযোগী বলেছিলেন, তার মানসিকতা ছিল অনেকটা মধ্যযুগের খ্রিস্টান সন্তদের বা জৈন সাধুদের মতো। ইতিহাসবিদ প্যাট্রিক ফ্রেঞ্চ বলেছিলেন, গান্ধীর চিন্তাধারা প্রাচীন হিন্দু দর্শনে প্রোথিত মনে হলেও, আসলে তিনি ছিলেন ইংল্যান্ডের ভিক্টোরিয়ান যুগের একজন প্রতিভূ।
রামচন্দ্র গুহ লিখেছেন, আজকের মাপকাঠিতে বিচার করলে গান্ধীকে রক্ষণশীল বলা যায়, তবে তার নিজ সময়ের বিচারে তিনি নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল ছিলেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



