বিনোদন ডেস্ক : বাংলা চলচ্চিত্রে দেশ জুড়ে অনেক স্বনামধন্য অভিনেত্রী রয়েছে। কিন্তু আমাদের অনেকের হয়তো অজানা প্রথম বাঙালি মুসলমান নায়িকা বনানী চৌধুরী। কিন্তু যে সময় উপমহাদেশে মুসলিম নারীদের ঘর থেকে বের হওয়ার অনুমতি ছিলো না। গান-বাজনা বা চলচ্চিত্র ছিলো তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। সে সময়ে শত বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে উপমহাদেশের প্রথম মুসলিম নারী হিসেবে চলচ্চিত্রে আত্মপ্রকাশ করেন বনানী চৌধুরী।
পুলিশ কর্মকর্তা পিতা আফসার উদ্দীন আহমদ এর কর্মস্থল বনগাঁতে অবস্থানকালেই ১৯২৪ সালের মে মাসে বনানী চৌধুরী জন্মগ্রহণ করেন। তার গ্রামের বাড়ী মাগুরা জেলার, শ্রীপুর থানার সোনাতুনদি গ্রামে। ১৯৩৬ সালে অষ্টম শ্রেণীতে পড়াকালীন রাজ্জাক চৌধুরীর সঙ্গে তার বিবাহ হয়। রাজ্জাক চৌধুরী কলকাতা ওয়াকফ-এর কমিশনার ছিলেন।
মুর্শিদাবাদ জেলার সাগরদিঘী গ্রামের স্কুলে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। উচ্চ শিক্ষিত স্বামী রাজ্জাক চৌধুরীর উৎসাহেই বনানী চৌধুরীর শিক্ষাজীবন বিকশিত হয়। ১৯৪১ সালে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। পরবর্তীতে আই, এ. ও. বি. এ. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
ছাত্রীজীবন থেকেই তার শৈল্পিক প্রতিভার প্রতিফলন ঘটতে থাকে। এ সময় বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে তার অংশগ্রহণ অনুষ্ঠানের আকর্ষণ বৃদ্ধি করতো। বিদ্যালয়ের মঞ্চস্থ থিয়েটারগুলোতে নিয়মিত অংশগ্রহণ ও কবিতা আবৃত্তি করে ব্যাপক সুখ্যাতি অর্জন করেন তিনি। শৈশবকাল থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি দূর্লভ আকর্ষণ ছিল তার। এই আকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটে স্বামী ও বন্ধু প্রতিম কথাশিল্পী মানিক বন্দোপাধ্যায় এবং সুলতান আহমদের উৎসাহ ও সহযোগিতায়।
তখনকার দিনে ধর্মীয় এবং সামাজিক কারণে রূপালী পর্দায় সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারের মেয়েদের অংশগ্রহণ ছিল একেবারে অকল্পনীয়। এই গোড়ামী সমাজের কু-সংস্কারকে উপেক্ষা করে রূপালী পর্দায় একটি নতুন মুখ সংযুক্ত হল। যার আসল নাম বেগম আনোয়ারা নাহার চৌধুরী লিলি। পোষাকী নাম বনানী চৌধুরী। চিত্র পরিচালক গুনময় বন্দোপাধ্যায় এর সহযোগিতায় এই অনবদ্য অভিনেত্রীকে ১৯৪৬ সালে সর্বপ্রথম ‘বিশ বছর আগে’ ছবিতে দেখা যায়। এই লাবন্যময়ী চিত্র তারকা এই ছবিতে এত নিখুঁত ও নৈপূণ্যতার সঙ্গে অভিনয় করলেন যে, চিত্রামোদীদের হৃদয়রাজ্যে স্থান করে নেন।
১৯৪৬ সালে কলকাতার সিনেমায় অভিনয় করার সুযোগ পেলেন। সিনেমায় যোগ দিয়ে আনোয়ারা থেকে হয়ে গেলেন ‘বনানী চৌধুরী’। প্রথম অভিনয় করলেন ‘বিশ বছর আগে’ ছবিতে। এই ছবিটি রিলিজ হতে দুই বছর সময় লেগ গেল। এর আগেই ১৯৪৭ সালে বনানী চৌধুরী অভিনীত ‘অভিযোগ’, ‘পূর্বরাগ’ ও ‘তপোভঙ্গ’ নামের ৩টি ছবি রিলিজ হয়। সুশীল মজুমদার পরিচালিত ‘অভিযোগ’ ছবিতে সুমিত্রা দেবী ও বনানী চৌধুরী তারা দুজনে নায়িকা ছিলেন।
এ ছাড়া অভিনয় করেছিলেন দেবী মুখোপাধ্যায়, অহিন্দ্র চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, রবি রায়, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য প্রমুখ। ‘তপোভঙ্গ’ ছবিটি পরিচালনা করেন বিভূতি দাস। এ ছবিতে বনানী চৌধুরী ও সন্ধ্যারানী দুজনে নায়িকা ছিলেন।
ছবিতে সন্ধ্যারানীর ছোট বোন প্রমীলা ত্রিবেদীর ক্লাসমেট ছিলেন বনানী চৌধুরী। অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায় পরিচালিত ‘পূর্বরাগ’ ছবিতে বনানী চৌধুরী রানীর ভূমিকায় অভিনয় করেন। তার বিপরীতে ছিলেন দীপক মুখোপাধ্যায়।
১৯৪৮ সালে ‘চলার পথে’ ছবিতে অভিনয় করে বেশি প্রশংসা পেয়েছিলেন তিনি। বনানী চৌধুরী ইস্টার্ন টকিজের নিজস্ব শিল্পী হিসেবে চুক্তিবদ্ধ হন ১৯৪৭ সালে। দুই বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়ে ‘পরশ পাথর’, ‘নন্দরানীর সংসার’ ও ‘মহাসম্পাদ’-এ অভিনয় করেন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে বনানী চৌধুরী অভিনীত ‘বিষের ধোঁয়া’, ‘মায়াজাল’ এবং ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ছবি তিনটি সাড়া জাগায়। ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ ছবিতে মাস্টার দা’র স্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করার পর তিনি সারা বাংলায় প্রশংসিত হন। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় তিনি জহির রায়হান পরিচালিত ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ ছবিতে অভিনয় করেন। পঞ্চাশের দশকের শেষার্ধে ঢাকায় তার অভিনীত ছবি হলো—ধীরে বহে মেঘনা, সুখ দুঃখের সাথী, আল্লাহ মেহেরবান, আকাশপরী ইত্যাদি। মঞ্চেও তিনি নিয়মিত অভিনয় করতেন। আকাশবাণী কলকাতায় তিনি নিয়মিত অভিনয় করতেন।
১৯৪৬ সাল থেকে তিনি অদ্যাবধি বিভিন্ন ছায়াছবিতে যে সমস্ত খ্যাতনামা অভিনেতা অভিনেত্রীর সঙ্গে অভিনয় করে যশস্বী হয়েছেন তাদের মধ্যে ছবি বিশ্বাস, জহর গাঙ্গুলী, পাহাড়ী সান্যাল ও মলিনা বিশেষ উল্লেখযোগ্য।প্রমথেশ বড়ুয়া, নীতির বসু, আর হেমেন গুপ্ত ও জহির রায়হানের মত পরিচালকের নির্দেশনায় অভিনয় করার সৌভাগ্য লাভ করেছেন তিনি। চলচ্চিত্রে অভিনয় ছাড়াও বনানী চৌধুরী কলকাতার মঞ্চ ও বেতারের সংগে সংযুক্ত ছিলেন।
মুসলিম সমাজ চলচ্চিত্র জগতের তারকাকে যখন ভালো চোখে দেখত না। সেই যুগে মুসলমান মেয়ে বনানী চৌধুরী এক অর্থে বিদ্রোহ করেই ফিল্মে এসেছিলেন। সে জন্য এখনও অনেকে তার কথা মনে করেন। ১৯৯৫ সালের ৫ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় তার নিজ বাসাতেই মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ঢাকার বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।