দেশের অনুমোদিত ডিলার ব্যাংকগুলোর (এডি) মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রা লেনদেন সংক্রান্ত বিধিবিধান নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা লঙ্ঘনের প্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে যথাসময়ে স্বীকৃত বিলের মূল্য পরিশোধ না করা, আমদানিতে বিল অব এন্ট্রি বা আগামপত্র মেয়াদোত্তীর্ণ থাকা অবস্থায় নতুন এলসি স্থাপন, আমদানি বিলের দায় পরিশোধ করে গ্রাহকের নামে তাৎক্ষণিকভাবে বাধ্যতামূলক ঋণ সৃষ্টি না করা, মেয়াদোত্তীর্ণ রপ্তানি বিল প্রত্যাবাসন সঠিকভাবে তদারকি না হওয়া, বৈদেশিক মুদ্রায় যে কোনো মূল্য পরিশোধ ও প্রাপ্তির তথ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ড্যাশবোর্ডে রিপোর্ট না করা এবং ভুয়া ডকুমেন্ট দাখিলের মতো ঘটনা সম্প্রতি অনেক বেড়েছে। এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক এডি ব্যাংকগুলোকে জোরালো সতর্ক করেছে এবং নির্দেশনা পরিপালন করতে বলেছে। আমাদের সময়ের প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত-
২০ মে বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদিত ডিলারস ফোরামের ৩৮তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনায় এডি ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা পরিপালন না করার বিষয়টি ওঠে আসে। এতে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্বীকৃত বিলের বিপরীতে পেমেন্ট না দেওয়ার প্রবণতা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। তখন গভর্নরের নির্দেশে এডি ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ওই সভাটি করা হয়। সে সময় আরও অনেক বিষয় উঠে আসে। ব্যাংকগুলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা ঠিকভাবে পরিপালন করতে বলা হয় জোরালোভাবে। নির্দেশনা বুঝতে সমস্যা হলে তাও ভালোভাবে বুঝে নিতে বলা হয়।
ওই সভার পর ব্যাংকগুলোর ত্রুটি-বিচ্যুতি অনেকাংশে কমে এসেছে বলে জানান তিনি।
স্বীকৃত বিলমূল্য পরিশোধে তালবাহানা : সভায় মেয়াদোত্তীর্ণ স্বীকৃত বিলের মূল্য পরিশোধ না করায় ক্ষোভ প্রকাশ করে জানানো হয়, গত ১৩ এপ্রিল প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে মেয়াদোত্তীর্ণ স্বীকৃত বিল পরিশোধ ত্বরান্বিত করতে কিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়। এগুলো হলো- মেয়াদোত্তীর্ণ স্বীকৃত বিলগুলোর বিস্তারিত পর্যালোচনা, সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা নেওয়া, শাখাভিত্তিক পারফরমেন্স মূল্যায়ন, বিশেষ পরিবীক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা, এডি শাখায় দাখিল করা সব বিল, প্রদত্ত ডিসক্রিপেন্সি ও বিলমূল্য পরিশোধের তথ্য সংরক্ষণ এবং মাসিক ভিত্তিতে প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগে রিপোর্ট পাঠানো ইত্যাদি। সভায় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের প্রতিনিধি উল্লেখ করেন, বিভিন্ন এডি ব্যাংক আমদানি ঋণপত্রের বিপরীতে স্বীকৃত বিলের মূল্য পরিশোধে বিলম্ব করছে। এতে বিলগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় থেকে যাচ্ছে। ফলে গ্রাহকের ব্যবসা পরিচালনা ও নতুন ঋণ সুবিধা গ্রহণ প্রক্রিয়া বিঘ্নিত হচ্ছে। আরিফ হোসেন খান বলেন, যথাসময়ে আমদানি বিলের বকেয়া পরিশোধ না করায় বাংলাদেশি ব্যাংকের কনফারমেশন চার্জ বাড়ছে। তাই এডি ব্যাংকগুলোকে যথাসময়ে স্বীকৃত বিলের (বৈদেশিক বা স্থানীয়) মূল্য পরিশোধ করার নির্দেশনা দেন তিনি।
বিল অব এন্ট্রি মেয়াদোত্তীর্ণ থাকা অবস্থায় নতুন এলসি স্থাপন : সভায় জানানো হয়, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় নীতিমালা ২০১৮-এর নির্দেশনা অনুযায়ী, বিল অব এন্ট্রি মেয়াদোত্তীর্ণ থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া নতুন এলসি স্থাপনের সুযোগ নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০২০ সালের ৩০ জানুয়ারির প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আমদানিতে অগ্রিম পরিশোধ বা এলসি ছাড়া বিক্রয় চুক্তির আওতায় আমদানির ক্ষেত্রেও একই বিধান ধার্য করা হয়েছে। বিল অব এন্ট্রি ওভারডিউ থাকা অবস্থায় এলসি সংশোধনের বিষয়েও একই বিধান প্রযোজ্য। এ ক্ষেত্রে ফরেন এক্সচেঞ্জ অপারেশন বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়- একই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক ও শিল্প উভয় ধরনের আমদানি নিবন্ধন সনদ (আইআরসি) থাকতে পারে। ফলে কোনো প্রতিষ্ঠান ভিন্ন ভিন্ন আইআরসির মাধ্যমে পৃথক ব্যাংকে এলসি বা চুক্তির মাধ্যমে আমদানি দায় তৈরি করতে পারে। এ ধরনের প্রবণতা রোধে ২০২১ সালের ১২ অক্টোবর এক চিঠির মাধ্যমে গ্রাহককে আমদানি সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে অনলাইন ইমপোর্ট মনিটরিং সিস্টেম (ওআইএমএস) থেকে আইআরসি নম্বর ও নাম সার্চ করে বিল অব এন্ট্রি মেয়াদোত্তীর্ণবিষয়ক তথ্য যাচাইয়ের নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। তারপরও সম্প্রতি বিল অব এন্ট্রি মেয়াদোত্তীর্ণ থাকা অবস্থায় এলসি স্থাপনের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
গ্রাহকের নামে ফোর্সড ঋণ সৃষ্টি না করা : সভায় বলা হয়, আমদানি বিলের দায় ব্যাংকের নিজস্ব উৎস থেকে পরিশোধ করা হলেও তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকের নামে বাধ্যতামূলক (ফোর্সড) ঋণ সৃষ্টি করছে না অনেক ব্যাংক। তাদের সতর্ক করে বলা হয়, এলসি দায় পরিশোধের পর তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকের নামে বাধ্যতামূলক ঋণ সৃষ্টি করতে হবে। চলতি মাসে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায়ও এ বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে দিকনির্দেশনা দেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
মেয়াদোত্তীর্ন রপ্তানি বিল প্রত্যাবাসন ঠিকভাবে তদারকি না হওয়া : ফরেন এক্সচেঞ্জ অপারেশন বিভাগ থেকে ২০২২ সালের ৬ সেপ্টেম্বর এক প্রজ্ঞাপনে মেয়াদোত্তীর্ণ রপ্তানিমূল্য প্রত্যাবাসন বা নিষ্পত্তিতে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ ও তদারকির জন্য একজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক কিংবা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রত্যেকটি ব্যাংকে কমিটি গঠন এবং ওই কমিটি সেগুলোর অগ্রগতি প্রতিবেদন ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পরবর্তী মাসের ১০ তারিখের মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভাগে দাখিল করবে- এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ বিষয়ে সভায় বলা হয়- অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যাবাসিত রপ্তানিমূল্য দিয়ে সংশ্লিষ্ট রপ্তানির ব্যাক টু ব্যাক আমদানি (স্বীকৃত) বিল মেয়াদোত্তীর্ণ রেখে অন্য আমদানি বিলের পেমেন্ট করা হচ্ছে।
ড্যাশবোর্ডে বিলম্বে রিপোর্ট করা : কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিদের্শনা অনুযায়ী, বৈদেশিক মুদ্রায় যে কোনো মূল্য পরিশোধ এবং প্রাপ্তির আট কর্মঘণ্টার মধ্যে ড্যাশবোর্ডে রিপোর্ট করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সভায় বলা হয়, ব্যাংকগুলো কিছু ক্ষেত্রে পাঁচ দিন থেকে ৩০ দিন পরও রিপোর্ট করে, যা ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই জারি করা প্রজ্ঞাপনের নির্দেশনার স্পষ্ট লঙ্ঘন।
ভুয়া ডকুমেন্ট দাখিল করা : সভায় বলা হয়, ডকুমেন্টের সঠিকতা যাচাই করে এডি ব্যাংকগুলো তা দাখিল করবে, এমন বিধান রয়েছে। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, এডি ব্যাংকগুলো ডকুমেন্ট ঠিকভাবে যাচাই না করেই বাংলাদেশ ব্যাংকে দাখিল করে।
ভুল পারপাস কোডে রিপোর্ট করা : ফরেন এক্সচেঞ্জ অপারেশন বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, ব্যাংকগুলো অনলাইন ইনওয়ার্ড রেমিট্যান্স মনিটরিং সিস্টেম (ওআইআরএমএস) ও অনলাইন টিএম ফর্ম মনিটরিং সিস্টেমে (ওটিএফএমএস) ভুল পারপাস কোডে রিপোর্ট করে, যা ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই প্রজ্ঞাপনে জারি করা নির্দেশনার লঙ্ঘন। ভুল পারপাস কোডে রিপোর্ট করার ফলে জাহাজ পুনঃরপ্তানিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকার রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
সার্ভিস এলসির পেমেন্ট সংশ্লিষ্ট সফটওয়্যারে রিপোর্ট না করা : সভায় বলা হয়, এডি ব্যাংকগুলো কর্তৃক সার্ভিস এলসির ওটিএফএমএসে রিপোর্ট করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। ব্যাংকগুলো সার্ভিস এলসির পেমেন্ট সম্পাদনে আউটওয়ার্ড রেমিট্যান্স করলেও তা সব ক্ষেত্রে রিপোর্ট করে না এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ঠিকভাবে তথ্য সংরক্ষণ করে না।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।