জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশে মজুত বা কালোবাজারি করে বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির অভিযোগের ঘটনা ঘটছে হর হামেশাই। পণ্য আমদানি, ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ারি দেওয়াসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও এ বিষয়ে সেভাবে আইনি ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না।
সম্প্রতি দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেউ পণ্য মজুত করে বাজার অস্থিতিশীল করলে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশও দিয়েছেন।
এরই প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, বিশেষ এই কারণটাকে ‘অ্যাড্রেস’ করার জন্য ১৯৭৪ সালে বিশেষ ক্ষমতা আইন করা হয়েছিলো। এ রকম কাজ করলে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
কিন্তু পণ্য মজুত বা কালোবাজারি নিয়ে ১৯৭৪ সালের এই বিশেষ ক্ষমতা আইনে আসলে কী রয়েছে? বিস্তারিত জানিয়েছে বিবিসি
কোন প্রেক্ষাপটেই বা করা হয়েছিলো এই আইনটি? এতে শাস্তির বিধানই বা কী রয়েছে?
আইনটি তৈরির প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালের ৯ই ফেব্রুয়ারি এই আইন করা হয়।
পাকিস্তানের নিরাপত্তা আইন ১৯৫২, জন নিরাপত্তা অর্ডিন্যান্স ১৯৫৮ এবং ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ তফসিলি অপরাধ (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশকে প্রতিস্থাপনের জন্য আইনটি পাস করা হয়েছিলো।
এর উদ্দেশ্য ছিল বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিরোধী কিছু কার্যকলাপ প্রতিহত করা। একই সাথে কিছু গুরুতর অপরাধের দ্রুত বিচার এবং কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা।
১৯৭৪ সালের আইনটিতে পণ্য মজুত, চোরাচালান বা কালোবাজারির বিষয়গুলো রাখার প্রেক্ষাপট সম্পর্কে জানান সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক।
তিনি বলেন, “স্বাধীনতার পর দেশে কিছু খারাপ ব্যবসায়ী পণ্য মজুত করে দ্রব্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি করার চেষ্টা করে। একই সাথে বেড়ে গিয়েছিল স্মাগলিং ও কালোবাজারিও। সে সময় এই আইনে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি রোধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রাখা হয়। যাতে করে ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণ করা যায়।” এই আইনটিকে ‘কালো আইন’ হিসেবেও অভিহিত করা হয় বলে জানান মালিক।
এ আইনে চোরাচালান, কৃত্রিম সংকট তৈরি এবং ক্ষতিকারক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত যে কাউকে সরকারের আটক করতে পারার বিধান রয়েছে । রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের বিভিন্ন সময় এই আইনে কিছু কিছু ধারা সংশোধন ও সংযোজন করা হয়।
যে সব ধারা এই আইনে সংযোজন করা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে কাগজের মুদ্রা ও সরকারি স্ট্যাম্প জাল করা, চোরাচালানি, খাদ্য, পানীয় ওষুধ ও প্রসাধনী দ্রব্যে ভেজাল, অপরাধ করার ষড়যন্ত্র করা এবং ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কিছু কিছু অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড।
এই আইনে রাষ্ট্র-বিরোধী কার্যকলাপের সংজ্ঞা হিসেবে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং প্রতিরক্ষা বিরোধী কার্যকলাপ, বাংলাদেশের সঙ্গে অন্যান্য দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের ক্ষতি সাধন, জন নিরাপত্তা বিরোধী কাজ করা, জনসাধারণের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের সরবরাহে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা-সহ নানা বিষয়।
এছাড়াও জনগণের মধ্যে বা জনগোষ্ঠীর কোনও অংশের মধ্যে ভয়ভীতি সৃষ্টি করা , দেশের আইন ও শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় বাধা দেয়া এবং দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থের পরিপন্থী কাজ করা রাষ্ট্র-বিরোধী কার্যকলাপের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
বিভিন্ন সময় এই আইনটি অপসারণের দাবি উঠলেও কোনও সরকারই তা করেনি।
আইনটিতে কালোবাজারি নিয়ে যা রয়েছে
এ আইনে যে গুরুতর অপরাধগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে তার মধ্যে আছে রেশনে সরবরাহকৃত দ্রব্যাদির কালোবাজারি এবং রেশনের লাইসেন্স, পারমিট ইত্যাদি কেনাবেচা করা।
‘কালোবাজারে লেনদেন’ বলতে বোঝায় আইনে নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্যে বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে কোনও কিছু বিক্রি করা বা কেনা।
একটা নির্দিষ্ট সময়ে নির্ধারিত পরিমাণের বেশি দ্রব্যাদি যদি কেউ মজুত করে তবে সেটি গুরুতর অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।
আইনটিতে কোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন, বিতরণ এবং সরবরাহে ব্যবহৃত ভবন বা অন্যান্য সম্পত্তি, খনি বা কারখানা বিনষ্ট করাকে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
একই সাথে খাদ্য, পানীয়, ওষুধ ও প্রসাধনী দ্রব্যে ভেজাল দেওয়া বা ভেজাল সামগ্রী বিক্রি করাও ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের আওতায় পড়বে।
এছাড়া পাটজাত দ্রব্য, পাটের গুদাম, পাট বা পাটকলের মতো সম্পদ নষ্ট করাও এই আইনের অধীনে ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড হিসেবে বিবেচিত হবে।
এ আইনের অধীনে, যে ব্যক্তি কালোবাজারে মজুত বা লেনদেনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হবেন তাকে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।
অথবা ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। জরিমানাও করা হবে।
তবে, শর্ত হিসেবে এতে বলা হয়েছে, যদি অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রমাণ করতে পারেন যে তিনি লাভ ছাড়া অন্য উদ্দেশ্যে মজুত করেছিলেন তবে তিনি তিন মাস পর্যন্ত কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। একই সাথে জরিমানাও করা হবে তাকে।
একই সাথে আদালত কালোবাজারি বা মজুত হয়েছে এমন কিছু সরকারকে বাজেয়াপ্ত করার আদেশও দিতে পারবে। এই আইনে চোরাচালানের অভিযোগেও শাস্তি রয়েছে। এই অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিতে পারে আদালত।
এছাড়া ১৪ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড এবং দুই বছরের কম নয়, এমন কারাদণ্ড শাস্তি হিসেবে রয়েছে। রয়েছে জরিমানার বিধানও।
একই সাথে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ এমন কোনও পণ্য বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে যদি কোনও ব্যক্তি নিজের দখলে রাখে, সেটিও চোরাচালানের সংজ্ঞায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই কারণে এক বছরের কম নয় কিন্তু সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দিতে পারবে আদালত।
খাদ্য, পানীয়, ওষুধে ভেজাল করা বা জেনেশুনে এ ধরনের ভেজাল পণ্য বিক্রির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। একইসাথে ১৪ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ড ও জরিমানার শাস্তিও রয়েছে।
এছাড়া চুলের তেল, সাবান বা অন্যান্য প্রসাধনীতে ভেজাল মেশানো – যা চুল ও ত্বক বা শরীরের যে কোনো অংশের জন্য ক্ষতিকর – এমন প্রসাধনী জেনেশুনে বিক্রি করা, বিক্রির প্রস্তাব দেওয়াও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এ অপরাধে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তির পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং জরিমানা হতে পারে।
মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ঢাকায় ওসমানি স্মৃতি মিলনায়তনে জেলা প্রশাসক সম্মেলনের অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের জানান, অবৈধ মজুত করে বাজার ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা হলে এই আইনের অধীনে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রমজানে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে রাখা হবে বলেও ঘোষণা দিয়েছেন।
তবে, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে সর্বোচ্চ শাস্তি থাকলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতা বেড়ে যায়। তাদের এটি অপব্যবহারে সুযোগ থাকে।”
আবার, শাস্তি যত বেশি হয়, তাহলে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার সংখ্যাও অনেক কমে যাওয়ার শঙ্কা থাকে। শাস্তি যত কঠোর হবে অপরাধ তত কমে যাবে, এই ধারণাটা ভুল বলে মনে করেন মালিক।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।