অ্যান্টিম্যাটার আসলে কী? সহজ করে বললে, এরা হলো সাধারণ বস্তুকণার মিরর ইমেজ বা প্রতিবিম্ব। কোনো মানুষকে যদি একটি সমতল আয়নার সামনে দাঁড় করানো হয়, তাহলে আয়নায় প্রায় অবিকল সেই মানুষের মতো একটি প্রতিবিম্বের দেখা মিলবে। তবে মানুষ ও প্রতিবিম্বের মধ্যে একটি মৌলিক পার্থক্য থাকবে। প্রতিবিম্বে দেখা যাবে পার্শ্বপরিবর্তন। অর্থাৎ প্রতিবিম্বের ডান হাত নির্দেশ করবে মূল ব্যক্তির বাঁ হাত এবং প্রতিবিম্বের বাঁ হাত নির্দেশ করবে মূল ব্যক্তির ডান হাত।
স্বাভাবিক বস্তুকণা ও প্রতিকণার (অ্যান্টিম্যাটার) মধ্যেও বিষয়টি অনেকটা একই রকম। কেবল একটি মৌলিক পার্থক্য বাদে এরা পুরোপুরি স্বাভাবিক বস্তুকণার মতো। আর সেটা হলো কোয়ান্টাম সংখ্যার চিহ্ন। প্রতিকণার কোয়ান্টাম সংখ্যার চিহ্ন স্বাভাবিক বস্তুকণার ঠিক উল্টো। একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আমাদের অতি পরিচিত বস্তুকণা ইলেকট্রনের কথাই ধরুন। ইলেকট্রন ঋণাত্মক আধানবিশিষ্ট এবং চার্জের মান -১। অন্যদিকে ইলেকট্রনের ঠিক সমান ভরবিশিষ্ট প্রতিকণা পজিট্রন ধনাত্মক আধানবিশিষ্ট এবং চার্জের মান +১। অর্থাৎ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোয়ান্টাম সংখ্যার চিহ্ন ঠিক উল্টো।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকটা পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসের এক উত্তেজনাপূর্ণ সময়। সে সময়কে পদার্থবিজ্ঞানের স্বর্ণযুগ বললেও বিন্দুমাত্র বাড়িয়ে বলা হবে না। তখন নিয়মিত বিরতিতে নিত্যনতুন যুগান্তকারী সব ধারণা হাজির করছিলেন পদার্থবিদেরা। চমকে দিচ্ছিলেন গোটা বিশ্বকে। ক্রমেই বদলে যাচ্ছিল মহাবিশ্ব নিয়ে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি। সে সময় পদার্থবিজ্ঞানকে আমূল বদলে দেওয়ার মূল কারিগর ছিলেন আইনস্টাইন।
১৯০৫ সালে তাঁর প্রকাশিত আপেক্ষিকতার বিশেষ তত্ত্ব এবং এর প্রায় ১০ বছর পর প্রকাশিত আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিল পদার্থবিজ্ঞানে। আপেক্ষিকতা–ঝড়ে সব লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার সময় অনেকটা নিভৃতেই গড়ে উঠছিল আরেকটি যুগান্তকারী ধারণা। একদল পদার্থবিদ একমনে কাজ করে যাচ্ছিলেন ইলেকট্রনের মতো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা নিয়ে। সেখান থেকেই সূত্রপাত হয় কোয়ান্টাম মেকানিকসের। খোঁজ মেলে চোখের সামনে লুকানো এক অদ্ভুত জগতের, যেখানে কাজ করে না পদার্থবিজ্ঞানের সাধারণ নিয়মকানুন। পুরোপুরি অচল আমাদের সাধারণ জ্ঞান।
পদার্থবিজ্ঞানের অনেক রথী-মহারথী তাঁদের পুরো কর্মজীবন ব্যয় করেছেন আপেক্ষিকতা ও কোয়ান্টাম মেকানিকসের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাতে। কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। কারণ, এরা আলাদা আলাদা জগতের বাসিন্দা। একটি কাজ করে গ্রহ–নক্ষত্রের মতো বিশাল ভরের বস্তু নিয়ে, অন্যটি ব্যাখ্যা করে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণার জগৎ। আপাতদৃষ্টে দুইয়ের ভেতর কোনো যোগসূত্র নেই। কিন্তু পদার্থবিদেরা মোটেও হাল ছাড়ার পাত্র নন। অবশেষে ১৯২৮ সালে ব্রিটিশ পদার্থবিদ পল ডিরাকের হাত ধরে আসে সফলতা।
প্রতিটি স্বাভাবিক বস্তুকণার বিপরীতে একটি করে প্রতিকণার অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনার কথা বলেন ডিরাক। পরবর্তী সময়ে ১৯৩২ সালে আমেরিকান পদার্থবিদ কার্ল ডি অ্যান্ডারসন প্রথমবারের মতো কসমিক রশ্মিতে সত্যি সত্যি এদের একটির অস্তিত্ব খুঁজে পান।
যত বেশি ভরের প্রতিকণা তৈরি করতে হবে, তত বেশি শক্তির প্রয়োজন পড়বে। শক্তির রূপান্তরের মাধ্যমে অবশ্য এককভাবে কোনো প্রতিকণা পাওয়া সম্ভব নয়। এসব প্রতিকণার শেষ পরিণতি কী? কী ঘটে এদের ভাগ্যে? নিশ্চয়ই এদের অস্তিত্ব খুব বেশি সময় ধরে থাকে না। যদি থাকত, তাহলে বিজ্ঞানীরা অনেক আগেই এদের শনাক্ত করে ফেলতে পারতেন। যা–ই হোক, সহজ করে বললে, উৎপন্ন হওয়ার খুব অল্প সময় পরেই প্রতিকণা ধ্বংস হয়ে যায়।
খুব সম্ভবত বিগ ব্যাংয়ের পর উৎপন্ন হওয়া কণা ও প্রতিকণার সংখ্যা একদম সমান ছিল না; সামান্য অসামঞ্জস্যতা ছিল। প্রতি ১০ লাখ কণা-প্রতিকণা যুগলে একটি অতিরিক্ত স্বাভাবিক কণা তৈরি হয়েছিল। ফলে যুগলগুলো একে অপরকে ধ্বংস করে শক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে গেলেও থেকে গিয়েছিল অতিরিক্ত স্বাভাবিক কণাগুলো। এদের নিয়েই তৈরি হয়েছে আমাদের বর্তমান মহাবিশ্ব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।