আককাস সিকদার, বাসস: স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিন গণনার সাথে-সাথে উপকূলের ঐতিহ্যবাহী ঝালকাঠি জেলার সর্বস্তরের মানুষ নতুন-নতুন স্বপ্নের জাল বোনা শুরু করেছে।
জেলা সদর থেকে লঞ্চ বা বাসযোগে ঢাকা পৌছাতে সময় লাগতো ১২ থেকে ষোল ঘন্টা। আবার কখনও ফেরীঘাটে যানজটের কারনে সময় লেগে যায় ১৮ থেকে ২০ ঘন্টা। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল শুরু হলে মাত্র পাঁচ মিনিটে বাসযোগে সেতু পাড়ি দিয়ে সাড়ে তিন থেকে চার ঘন্টায় পৌঁছানো যাবে ঢাকা, এ যেন স্বপ্ন সত্যি হওয়ার মত গল্প। তাই পদ্মা সেতু উদ্বোধনের দিনক্ষণ যত এগিয়ে আসছে দক্ষিণের জেলা ঝালকাঠির সাত লাখ মানুষের নানা স্বপ্নের গল্প নিয়ে চলছে আলোচনা। আলোচনার মূল বিষয় একটি সেতু কিভাবে পাল্টে দিতে পারে একটি জেলার অর্থনীতি। পদ্মা সেতু উদ্বোধন নিয়ে এ জেলার ব্যবসায়ী উদ্যোক্তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে নতুন পরিকল্পনা।
ঝালকাঠি বিসিক শিল্পনগরীর প্লটের চাহিদা ও দাম দুটোই বেড়েছে। অনেক উদ্যোক্তারা বরাদ্দ নেয়া প্লটে স্থাপনা নির্মাণ কাজ শুরু করেছেন।
ঝালকাঠির অন্যতম কৃষিপণ্য পেয়ারা ও আমড়া মাত্র চার ঘন্টায় সতেজ অবস্থায় পৌঁছে যাবে ঢাকা ও এর আশপাসের জেলায়। পেয়ারা ও আমড়া চাষীরা পাবে তাদের শ্রমের ন্যায্যমূল্য। তাই এখন সেতুর উদ্বোধনকে কেন্দ্র করে শুধু পেয়ারা-আমড়া চাষীরা খুশি নয়, খুশী লেবু ও কলা চাষীরাও। যারা শ্রম বিক্রি করে পেট চালান তারাও স্বপ্ন দেখছেন পদ্মা সেতু চালুর পরই জেলায় গড়ে উঠবে নানা ধরণের ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প কল-কারখানা। তাদের আর শ্রম বিক্রি করতে ঢাকায় যেতে হবে না। পদ্মা সেতু উদ্বোধন এবং এর ওপর থেকে যানবাহন চলাচল শুরু হলে জেলার মানুষ কিভাবে উপকৃত হবে সেই স্বপ্নের কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা।
ঝালকাঠি চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মু. মনিরুল ইসলাম তালুকদার মনে করেন জেলার ব্যবসায়ীদের জন্য পদ্মা সেতু একটি মহা আর্শিবাদ। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার কারনে ঢাকার সাথে সড়ক পথে যোগাযোগের দূরত্ব কমবে ৯০ কিলোমিটার। সময় কমবে কয়েক ঘন্টা। ঝালকাঠির ব্যবসায়ীরা বিশেষ করে লবন, রড, সিমেন্ট ও টিন ব্যবসায় উপকৃত হবেন। ঝালকাঠিতে এক সময় ৪০ টি লবনের মিল ছিল। যার মধ্যে বর্তমানে ১০/১২ টি চালু আছে। পদ্মা সেতুর প্রভাবে বন্ধ হওয়া লবন মিলগুলো চালু হলে ব্যবসায়ীরা খুব বেশী লাভবান হবে। ঝালকাঠিতে গড়ে উঠবে নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান। এ ছাড়া ঝালকাঠি জেলা টিন ও রডের ব্যবসার জন্য প্রসিদ্ধ। দূরত্ব এবং পরিবহন খরচ কমার কারনে ক্রেতা এবং ব্যবসায়ী উভয় লাভবান হবে ।
ঝালকাঠির শীতলপাটি ও গামছার কদর রয়েছে দেশের সব জায়গায়। স্বল্প সময়ে শীতলপাটি ও গামছা ঢাকায় পৌঁছানোর কারনে এর চাহিদাও বাড়বে। আগে বড় বড় ব্যবসায়ীরাও জরুরী প্রয়োজনে ঢাকায় গিয়ে আবার দিনে-দিনে ঝালকাঠি ফিরে আসতে পারতেন না। পদ্মা সেতু চালু হলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরাও জরুরী কাজে ঢাকা গিয়ে দিনে দিনে ফিরে আসতে পারবে ।
ভিমরুলী পেয়ারা বাগানের মালিক ভবেন্দ্র নাথ হাওলাদার বাসসকে জানান- জেলা সদরের ১০ টির মধ্যে তিনটি ইউনিয়নের (কীর্ত্তিপাশা, নবগ্রাম, গাভারামচন্দ্রপুর) বেশীরভাগ মানুষ পেয়ারা, আমড়া, কলা লেবু ও নানা ধরনের শাক-সব্জি উৎপাদন করে জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। বর্ষা মৌসুমে এখানকার উৎপাদিত পেয়ারা, আমড়া, লেবু ও কলা ট্রাক বা ট্রলারযোগে ঢাকা পৌঁছাতে ১৬ থেকে ২৪ ঘন্টা সময় ব্যায় হতো। ফলগুলো পেকেও যেতো। পেকে যাওয়ার কারনে পাইকারী এবং খুচরা বিক্রেতা উভয় আর্থিক ক্ষতির সম্মুখিন হতো। কোন কোন বছর ক্রেতার অভাবে চাষীরা পেয়ারা ভীমরুলী খালে ভাসিয়ে দিয়ে অথবা গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করতো। সেতু চালু হলে ঝালকাঠি সদরের এই তিন ইউনিয়নের পেয়ারা ও আমড়া চাষীরা ন্যায্য মূল্য পাবে। বাগান থেকে প্রতিদিন সকালে পেয়ারা ও আমড়া সংগ্রহ করার পর দুপুরে মধ্যেই ট্রাকযোগে তা পৌছে যাবে ঢাকা । ক্রেতারা পাবে সতেজ তাজা পেয়ারা । পেয়ারা চাষীরা পাবে ন্যায্যমূল্য। প্রতি বছর পেয়ারা বোঝাই কিছু ট্রাক ফেরীঘাটে ২/৩ দিন আটকে থাকার কারনে পেয়ারা পচে যেত তখন পাইকাররা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হতো। সেতু চালু হলে সেই লোকসানের দিন আর থাকবে না। প্রতিবছর ঝালকাঠি সদরের ভীমরুলী বাজারের কাছে খালে ভাসমান পেয়ারা ও সব্জির বাজার এবং পেয়ারা বাগান দেখতে হাজার-হাজার পর্যটক আসে। পদ্মা সেতু চালুর পরে সেই পর্যটকদের সংখ্যা বহুগুন বেড়ে যাবে। আর পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ার কারনে পেয়রাঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে। গড়ে উঠবে অনেক দোকানপাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পেয়ারা সমৃদ্ধ তিন ইউনিয়নের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল এখানে জেলির কারখানা তৈরি হয়। পদ্মা সেতুর কারনে হয়তো জেলি কারখানায় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করবে ।
ডুমরিয়ার চাষী সুনিল হালদার বলেন- অনেকেরই ধারণা ঝালকাঠির ভীমরুলীসহ আশপাশের গ্রামে শুধু পেয়ারা চাষ করে থাকে এখানকার চাষীরা। আসলে ঝালকাঠিরএ অঞ্চলে পেয়ারার সাথে কৃষকরা আমড়া, লেবু, কলা এবং নানা ধরনের সব্জির চাষ করে থাকেন। সেতু চালু হলে এসব চাষের সাথে জড়িতরা আর্থিকভাবে লাভবান হবে। চাষীদের সাথে লাভবান খুচরা ও পাইকারি বিক্রেতা থেকে শুরু করে পরিবহন শ্রমিকরাও। সেতুর কারনে ঝালকাঠির এই বিল অঞ্চলের মানুষের জীবন যাত্রার মানে ব্যাপক পরিবর্তন আসবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।