পরকীয়া জড়িয়ে তারা নিয়ে ফেলেন এক ভয়ঙ্কর খুনের পরিকল্পনা। নিজ স্বামী আজহারকে (৩৫) খুন করতে মসজিদের ইমামকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে প্ররোচিত করতেন স্ত্রী আসমা আক্তার (২৪)। সেই পরিকল্পনা মাফিক মসজিদের নিজ শয়নকক্ষে আজহারকে হত্যা শেষে ৬ টুকরা করে সেফটিক ট্যাংকিতে ফেলে দেন ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমান (৫৪)। আর এই হত্যার ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা রমজান মাসের ৭ দিন আগে নেয় তারা। আর এ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করতে মসজিদের ইমাম তার এক ছাত্রের নামে একটি মোবাইল ফোন ও সিম কিনে দিয়েছিলেন আসমা আক্তারকে।
ওই ফোনে হত্যা সম্পর্কে তারা শলা পরামর্শ করতেন বলে জানিয়েছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। বুধবার (২৬ মে) দুপুরে রাজধানীর কুর্মিটোলা র্যাব সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গত ২৫ মে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে দক্ষিণখানের সরদার বাড়ি জামে মসজিদের সেপটিক ট্যাংক থেকে আজাহার নামে এক ব্যক্তির ৬ খণ্ডে বিভক্ত মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত আজহারুল উত্তরখানের কাচকুরা একটি গার্মেন্টসে চাকরি করেন। দক্ষিণখানের মধুবাগে একটি বাসায় স্ত্রী আসমা আক্তার ও সন্তান আরিয়ানকে (০৪) নিয়ে ভাড়া থাকতেন।
এই ঘটনায় সরদার বাড়ি জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমান ও নিহত আজহারুলের স্ত্রী আসমা আক্তারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ বিষয়ে দক্ষিণখান থানায় নিহতের পরিবার একটি মামলা দায়ের করেন। ওই মামলায় এক নম্বর আসামি মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমান ও দুই নম্বর আসামি নিহত আজহারুলের স্ত্রী আসমা আক্তার।
সংবাদ সম্মেলনে খন্দকার আল মঈন বলেন, পরকীয়া সম্পর্কের জেরেই সরদার বাড়ি জামে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমান আজহারুলকে হত্যা করেন। আর এই হত্যাকাণ্ডের মুল পরিকল্পনাকারী ছিলেন নিহত আজহারুলের স্ত্রী আসমা আক্তার। তিনি আজহারকে হত্যা করার বিষয়ে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমানকে বিভিন্নভাবে চাপ দিতেন। স্বামী আজহারুলকে হত্যা করতে পারলে তিনি ইমামকে বিয়ে করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন আসমা আক্তার।
তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আমরা জানতে পারি মসজিদের ইমাম ও ভিকটিমের স্ত্রীর মধ্যে পরকীয়ার সম্পর্কের জের ধরে আজহারুলকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়। ইমাম ভিকটিম ও তার সন্তানকে আরবি শিক্ষা দিতেন। এ বছর জানুয়ারি মাস থেকে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমান বাসায় গিয়েই আজাহারুল ও তার ছেলেকে আরবি পড়াতেন। আর এই বাসায় যাওয়ার ফলেই ভুক্তভোগী আজহারুলের স্ত্রী আসমা আক্তারের সঙ্গে ইমামের সম্পর্ক তৈরি হয়। আজহারুল মার্চ মাসের দিকে তার স্ত্রী ও ইমামের মধ্যে অনৈতিক সম্পর্কের বিষয়টি টের পান। এ কারণেই ভুক্তভোগী ইমামকে তার বাসায় আর না যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।
এরপর আসমা আক্তারের সঙ্গে ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমানের সম্পর্ক আরও গভীর হয়ে যায়। মার্চের শেষের দিকে ভুক্তভোগীর স্ত্রী ও মসজিদের ইমাম দু’জনে মিলে আজহারুলকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন। প্রথমে তারা সিদ্ধান্ত নেন ভাড়াটে খুনির মাধ্যমে বা অন্য কোনো ব্যক্তির মাধ্যমে আজহারুলকে খুন করবে। পরবর্তীতে আসমা আক্তার মসজিদের ইমামকে পরামর্শ দেন আজহারুলকে হত্যার ঘটনাটি তার রুমে যাতে করা হয়।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন আরও বলেন, গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমান ও ভুক্তভোগী স্ত্রী আসমা আক্তার জানান, হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা ও তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনার জন্য মসজিদের ইমাম তার মক্তবের এক ছাত্রের নামে একটি সিমকার্ড ও একটি মোবাইল ফোন আসমা আক্তারকে কিনে দেন। সেটি আসমা আক্তারকে দেওয়া হয় গোপনীয়তা রক্ষার জন্য। এর মাধ্যমে তারা নিয়মিত শলা পরামর্শ করতে কিভাবে আজহার কে হত্যা করা যায়।
খন্দকার আল মঈন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তারা আরও জানায়, এ বছর রমজান মাসের ৭ দিন আগে আজহারুলকে তারা হত্যার পরিকল্পনা করে। এ সময় আজহারুল কলেরা রোগে আক্রান্ত হওয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তাদের হত্যার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। ওই সময় হাসপাতলে ভর্তি ছিলেন আজহারুল। এরপর আজহারুল সুস্থ হলে ঈদের আগের দিন তারা টাঙ্গাইলের কালিহাতী গ্রামের বাড়ি চলে যান। সেখানেও নিয়মিত আসমা আক্তারের সঙ্গে মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুর রহমানের যোগাযোগ চলছিল। পরবর্তীতে আসমা আক্তার ইমামের সঙ্গে মোবাইলের শলা পরামর্শ করে গত ১৮ মে অনেকটা প্ররোচনা দিয়ে আজহারুলকে ঢাকা পাঠান। পরদিন ১৯ মে ইমাম আজহারুলকে ফোন করে মসজিদে আসার জন্য বলেন। আজহারুল কাজ কর্ম শেষে গার্মেন্টস থেকে সরাসরি ইমামের সঙ্গে দেখা করতে এশার নামাজের সময় মসজিদে যান। এশার নামাজের পরে মসজিদের ইমাম আজহারুলকে অনুরোধ করে বলেন, ‘তুমি আমার কক্ষে বিশ্রাম নাও নামাজ শেষ করে আমি আসছি’। তখন আজহারুল ইমামের কক্ষে গিয়ে বিশ্রাম নেন। পরে কক্ষে ইমাম এলে দু’জনের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হয়।
র্যাবের এই কর্মকর্তা বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী ঠিক ওই সময় ইমাম আব্দুর রহমান কোরবানির পশু জবাইয়ের ছুরি দিয়ে আজহারুলকে আঘাত করতে গেলে ভুক্তভোগী টের পেয়ে যান। এতে তাদের দু’জনের মধ্যে ধস্তাধস্তি হয়। আজহারুল ইমামের কক্ষ থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে সিঁড়িতে পড়ে যান, ইমাম ঠিক তখনই আজহারুলের গলার ডান দিকে ওই ছুরি দিয়ে আঘাত করেন। এ সময় ইমাম আজহারুলের গলায় আরও কয়েকটি আঘাত করেন। পরে ইমাম আজহারের মরদেহ তার কক্ষে নিয়ে যান। সেখানে মরদেহটি ৬ খন্ডে খন্ডিত করেন। এরপর খন্ড করা মরদেহ নিয়ে ব্যাগে ভরে দক্ষিণখানের সরদার বাড়ি জামে মসজিদের সেফটি ট্যাংকিতে ফেলে দেন এবং ওই ট্যাংকির মুখটি সিমেন্টের বস্তা দিয়ে ঢেকে রাখেন। ঘটনার পর থেকে মসজিদের ওই কক্ষে ইমাম না থেকে পাশেই ঢাকা মাদরাসায় গিয়ে অবস্থান নেন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে মামলার দুই নম্বর আসামি আসমা আক্তারের বিষয়ে জানা যায়, আজহারুল ছিলেন আসমা আক্তারের তৃতীয় স্বামী। আসমা আক্তার আরও দু’টি বিয়ে করেছিলেন। আসমা আক্তারের দ্বিতীয় স্বামী ছিলেন ভুক্তভোগী আজহারুলের বড় ভাই। তাদের মধ্যে ২০১৫ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছিল। গোপনে গোপনে আসমা আক্তারের সঙ্গে আজহারুলের পরকীয়া সম্পর্ক হয়। পরে সম্পর্কের জেরে তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে আসমা আক্তারের বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। পরে আসমা আক্তার পালিয়ে আজহারুলেরকে বিয়ে করেন।
তিনি বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, আসমা আক্তার হত্যার বিষয়ে সব ধরনের পরিকল্পনা ও প্ররোচনা ইমামকে দিয়েছেন। হত্যার পরে আসমা আক্তার ইমামকে বিয়ে করবে বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। ইমামের বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায়। তার স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।