মোঃ রাকিবুল ইসলাম : পরিবেশের ভৌত, রাসায়নিক ও জৈবিক বৈশিষ্ট্যের যে অবাঞ্চিত পরিবর্তন জীবের জীবনধারণকে ক্ষতিগ্রস্ত করে তা-ই দূষণ। ক্ষতিকর পদার্থ পরিবেশের উপাদানসমূহে যুক্ত হয়ে পরিবেশ দূষণ ঘটায়। মাটি, পানি, আলো, বাতাস, শব্দ দূষণ এর মধ্যে অন্যতম। দূষণ অন্যান্য প্রাণীকূলের পাশাপাশি মানবস্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বিশ্বব্যাংকের দেয়া তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২০১৫ সালে পরিবেশ দূষণের কারণে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে প্রতি বছর যত মানুষের মৃত্যু হয়, তার ২৮ শতাংশই মারা যায় পরিবেশ দূষণজনিত অসুখ-বিসুখের কারণে।
বাংলাদেশের পরিবেশ এতটা দূষিত যে, বেঁচে থাকার জন্য এখানকার মানুষ পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাস গ্রহণ করে থাকে। ২০২৩ সালের আইকিউএয়ারের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত বাতাসের দেশ এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে পাকিস্তান ও ভারত । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেঁধে দেয়া মানের চেয়ে ১৫ গুণের বেশি পিএম পাওয়া গেছে বাংলাদেশের বাতাসে। পিএম হলো পার্টিকুলেট ম্যাটার, যার দ্বারা বোঝা যায় বাতাসে ভাসমান কঠিন বা তরল পদার্থের ক্ষুদ্র কণার মিশ্রণের পরিমাণ। ধুলো, ধোঁয়া, ছাই, ধাতব কণা, জৈব পদার্থ, বনভূমি দাহ, আগ্নেয়গিরি, ঝড়, ধুলোঝড়, যানবাহন, কলকারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র, ইটভাটা, কৃষি, নির্মাণকাজ প্রভৃতি কারণে বাতাসে পিএম বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিনিয়ত। দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকা পৃথিবীর দ্বিতীয় দূষিত শহর। এ তালিকায় প্রথমে রয়েছে ভারতের নয়াদিল্লি।
বাংলাদেশের বায়ুদূষণের পেছনে অসংখ্য কারণ রয়েছে। সাধারণত ঢাকায় চলাচল করা যানবাহনের ৮০ শতাংশ বাস অনেক বেশি পুরোনো। ওই যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত ধোঁয়া মারাত্মকভাবে বায়ুদূষণ করে থাকে। এছাড়া যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, রাস্তাঘাটের অতিরিক্ত যানজট বায়ুদূষণ বৃদ্ধির পেছনে দায়ী।
২০২৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পরিবেশমন্ত্রীর দেয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় আট হাজার ইটভাটা রয়েছে, যার ৬০ শতাংশ অবৈধ। অবৈধ ইটভাটাগুলো পরিবেশগত ছাড়পত্র ছাড়াই বছরের পর বছর চলছে। নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহারসহ আরও নানা মাধ্যমে এসব ইটভাটা মারাত্মকভাবে বায়ুদূষণ করছে।
এছাড়া মন্ত্রী আরও জানান, বাংলাদেশের শহরগুলোয় দৈনিক প্রায় ৩০ হাজার কঠিন বর্জ্য উৎপন্ন হয়, যেটি আগামী ২০২৫ সালে ৪৭ হাজারে উন্নীত হবে এবং এসব কঠিন বর্জের ১০ শতাংশই প্লাস্টিকজাত। বাংলাদেশে প্রায় ৫০ হাজার কলকারখানা রয়েছে। অধিকাংশ কলকারখানায় পুরোনো ও অনুন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার, নিম্নমানের জ্বালানি ব্যবহারের কারণে নির্গত ধোঁয়া ও ধূলিকণা, বিভিন্ন রাসায়নিক গ্যাস, যেমন কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ইত্যাদি বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজের কারণে নির্মাণস্থল থেকে ধুলোবালি ও ভবন ভাঙার ধুলো বাতাস, মাটি ও পানিতে মিশে গিয়ে মারাত্মকভাবে দূষণ সৃষ্টি করে থাকে। কাঠ, কয়লা, কেরোসিন ইত্যাদি অপরিমার্জিত জৈব জ্বালানি ব্যবহার ও গ্রামাঞ্চলে জৈব জ্বালানির ওপর নির্ভরতা বায়ুদূষণ সৃষ্টি করছে। এছাড়া বন উজাড়, অপরিকল্পিত কৃষিকাজ, অপরিচ্ছন্নতা ও পরিবেশ আইনের শিথিল প্রয়োগ বায়ুদূষণের পেছনে দায়ী।
বায়ুদূষণের কারণে বিভিন্ন ধরণের রোগ হয়ে থাকে, যথা শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যানসার, অ্যালার্জি ইত্যাদি। এছাড়াও বায়ুদূষণের কারণে মারাত্মকভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে থাকে।
পানিদূষণ পরিবেশ দূষণের পেছনে একটি অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশে নানাভাবে পানিদূষণ হয়ে থাকে। এর মধ্যে শিল্পকারখানা মুখ্য ভূমিকা পালন করে থাকে। কলকারখানার বর্জ্য পানিতে প্রত্যক্ষভাবে ফেলা পানিদূষণের পেছনে মারাত্মকভাবে দায়ী। কারখানার রাসায়নিক পদার্থ, ভারী ধাতু, তেল ও বিভিন্ন রঞ্জক পদার্থ পানিতে মিশে পানিদূষণ সৃষ্টি করে থাকে। এছাড়া শিল্পকারখানাগুলোর ত্রুটিপূর্ণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে পানিদূষণ হয়ে থাকে। কৃষি ক্ষেত্রে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অপরিকল্পিত ব্যবহারের কারণে কীটনাশক, সার, রাসায়নিক উপাদান এবং কৃষি ক্ষেত থেকে বর্জ্য পানিতে মিশে পানিদূষণ করছে।
এছাড়া পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাব, অপরিকল্পিত ও অপরিচ্ছন্ন শহরাঞ্চল, কঠিন বর্জ্য পানিতে ফেলা, যানবাহনের তেল ও রাসায়নিক দ্রব্য পানিতে মিশে যাওয়া, তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ফলে পানিদূষণ, আর্সেনিক দূষণ, জলাভূমি ভরাট, পানি ব্যবহারের অসচেতনতা, নদীতে চলমান যানের ময়লা-বর্জ্য পানিতে ফেলা, নদীর পাশে তৈরি হওয়া বাজারের সব বর্জ্য নদীতে ফেলা প্রভৃতি কারণে মারাত্মকভাবে পানিদূষণের সৃষ্টি হয়ে থাকে। পানিদূষণের কারণে নানা ধরনের পানিবাহিত রোগ হয়ে থাকে, যথা ডায়রিয়া, কলেরা, টাইফয়েড ইত্যাদি। ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়া প্রভৃতি মশাবাহিত রোগও পানিদূষণের কারণে হয়ে থাকে। এমনকি দূষিত পানি পানের ফলে জন্ডিসে আক্রান্ত হচ্ছে বিপুল সংখ্যক মানুষ। এছাড়া পানিদূষণের কারণে জীববৈচিত্র্য হ্রাস, জলজ প্রাণীর বিলুপ্তি, কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট হওয়াসহ আরও নানা ক্ষতি হয় এবং হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
পরিবেশ দূষণের আরেকটি অংশ হলো শব্দদূষণ, যা বাংলাদেশের একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা। বাংলাদেশে শব্দদূষণ একটি মারাত্মক সমস্যা, যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। নানা কারণে শব্দদূষণ হচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর মধ্যে ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরে যানবাহনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার এবং যানবাহন বৃদ্ধির কারণে শব্দদূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। প্রয়োজন ছাড়াই হাইড্রোলিক হর্ন ব্যবহার, সাইলেন্সারবিহীন মোটরবাইক ও যানজটের কারণে মারাত্মক শব্দদূষণের সৃষ্টি হচ্ছে। শিল্পকারখানাগুলোয় অনুন্নত ও ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং আবাসিক এলাকার কাছে কারখানা গড়ে ওঠাও শব্দদূষণ করে থাকে। এছাড়া নির্মাণকাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি, বিয়ে, মিলাদ, রাজনৈতিক সমাবেশে ও বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে উচ্চ স্বরে মাইক ও স্পিকার বাজানো এবং বহু জায়গায় বিদ্যুৎবিভ্রাটের কারণে জেনারেটরের ব্যবহারের কারণেও মারাত্মক শব্দদূষণের সৃষ্টি হয়ে থাকে। শব্দদূষণের কারণে মানুষের শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের ক্ষতিই হয়ে থাকে। দীর্ঘ সময় ধরে উচ্চ শব্দের সংস্পর্শে থাকলে শ্রবণশক্তি হ্রাস পেতে পারে। শব্দদূষণের কারণে মানসিক চাপ, উদ্বেগ এবং বিরক্তি ও মারাত্মক ঘুমের ব্যাঘাত হতে পারে, যা শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের ক্ষতিরই কারণ। শুধু মানুষই নয়, বরং শব্দদূষণের কারণে পাখিসহ অন্যান্য প্রাণীরাও মারাত্মক সমস্যার সম্মুখীন হয়ে থাকে।
ক্রমেই পরিবেশ দূষণ বৃদ্ধি পাওয়ার আরেকটি কারণ হলো অতিরিক্ত মাটিদূষণ হওয়া। মাটিদূষণের ফলে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি সাধন হয়ে থাকে। আমরা প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক ও পলিথিনের অতিরিক্ত ব্যবহারের মাধ্যমে মারাত্মকভাবে মাটিদূষণ করে থাকি। এছাড়া শিল্পকারখানার বর্জ্য, কৃষিক্ষেত্রে অতিরিক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার, বন উজাড় এবং সহজে পচে না এমন ময়লা মাটিতে ফেলা মাটিদূষণের অন্যতম কারণ। মাটিদূষণের ফলে মাটির উর্বরতা হ্রাস পায় এবং ফসল উৎপাদন কমে যায়। এছাড়া মাটিদূষণের কারণে দূষিত মাটিতে উৎপাদিত খাবার মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ। মাটিদূষণের ফলে জীববৈচিত্র্য হ্রাস, পানিদূষণসহ পরিবেশের ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে থাকে।
আমাদের দেশ ও পৃথিবীতে ক্রমেই অতিমাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়া আরেকটি দূষণ হলো আলোকদূষণ। অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার আনন্দ ও আধুনিকতার ছাপ মনে করা হলেও নীরব ঘাতকের মতো অতিরিক্ত আলোর ব্যবহার মারাত্মকভাবে মানুষসহ পরিবেশের অন্যান্য প্রাণীর ক্ষতি করে যাচ্ছে। অতিরিক্ত আলো ব্যবহারের কারণে মানুষের চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং ঘুমের ব্যাঘাত হয়ে শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা বাড়ছে। আলো দূষণের কারণে পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর ক্ষতিসহ মহাকাশ বিজ্ঞানীদের গবেষণায়ও বাধার সৃষ্টি হচ্ছে।
উক্ত সব ধরণের দূষণ রোধে একটি রাষ্ট্রের জনগণ ও সরকার সবাইকে একইসঙ্গে কাজ করতে হবে। বায়ু, মাটি, পানি, শব্দ ও আলোদূষণ রোধে যানবাহনের ধোঁয়া কমানো, কালো ধোঁয়া নির্গমন হয় এমন যানবাহন বন্ধ করা, কলকারখানা থেকে নির্গমন হওয়া ক্ষতিকারক ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ এবং এ ব্যাপারে কঠোর আইন প্রয়োগ, জৈব জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে এনে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহার, ইটভাটার ধোঁয়া নিয়ন্ত্রণ, নির্মাণ সাইটের ধুলো নিয়ন্ত্রণ, বনায়ন, পানিদূষণ রোধে কলকারখানার বর্জ্য পানি পরিশোধন করে নদীতে ফেলা, মানুষের বর্জ্য পানি সঠিকভাবে নিষ্কাশন করা, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে জৈব সার ব্যবহার বৃদ্ধি করা, পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন, জলাভূমি রক্ষা করা, শব্দদূষণ রোধে যানবাহনের হাইড্রোলিক হর্ন বাজানো নিয়ন্ত্রণ করা, সাইলেন্সারবিহীন মোটরবাইক জব্দ করা, আবাসিক এলাকায় শিল্পকারখানা বন্ধ করা, শিল্পকারখানাগুলোয় উন্নত যন্ত্রের ব্যবহার ও পুরোনো যন্ত্রের সংস্কার নিশ্চিত করা, মাটিদূষণ রোধে প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করে পাটজাতীয় পণ্যের ব্যবহার, নির্দিষ্ট জায়গায় ময়লা ফেলা, আলোদূষণ রোধে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আলো ব্যবহার না করা, আলো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা স্থাপন করে আলো অপচয় রোধ করা, এলইডি আলোর মতো উন্নত আলো ব্যবহার করাসহ সব ধরনের দূষণের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং কঠোর আইনি ব্যবস্থা তৈরি করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।