যদি বলি, পিথাগোরাসের উপপাদ্যটি পিথাগোরাস আদৌ আবিষ্কার করেননি, চমকে যাবেন? তথ্য-প্রমাণ কিন্তু সে কথাই বলছে! পিথাগোরাসের উপপাদ্যের নাম জানেন না, এমন কাউকে কি এ দেশে পাওয়া যাবে আদৌ? নিম্নমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে পাঠ্য এই উপপাদ্য ঝেড়ে মুখস্ত করেন অনেকেই। অনেকে আবার বুঝে-শুনে প্রমাণ করতে শেখেন।
উপপাদ্যটার ভাষ্য এরকম—কোনো সমকোণী ত্রিভুজের অতিভুজের ওপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল সেই ত্রিভুজের অন্য দুই বাহুর ওপর অঙ্কিত বর্গক্ষেত্র দুটির ক্ষেত্রফলের সমষ্টির সমান।
ঝকমারি এই সংজ্ঞা দেখে আঁৎকে ওঠার কিছু নেই। বিষয়টা যাঁদের এতদিন পর মনে নেই, তাঁদের জন্য একটু ছোট্ট করে ব্যাখ্যা করা যাক। সমকোণী ত্রিভুজ মানে, যে ত্রিভুজের একটি কোণের মান ৯০ ডিগ্রি। এই কোণের বিপরীত বাহুটির নাম অতিভুজ। ধরে নিই, তিনটি বাহুর নাম a, b ও c। c বাহুটি অতিভুজ (অর্থাৎ সমকোণ বা ৯০ ডিগ্রি কোণটি a ও b বাহুর মাঝখানে)। তাহলে এই উপপাদ্য মতে, a2 + b2 = c2।
তথ্য-প্রমাণ বলছে, পিথাগোরাসের নামে প্রচলিত এ উপপাদ্য পিথাগোরাস আদৌ আবিষ্কার করেননি। কিংবা তিনি হয়তো পুনরাবিষ্কার করেছেন, তবে তাঁর প্রায় ১ হাজার বছর আগে থেকেই প্রচলিত ছিল উপপাদ্যটি। প্রাচীন ব্যাবিলনের এক মাটির খণ্ড বা ট্যাবলেটে দেখা গেছে, পিথাগোরাসের উপপাদ্য ব্যবহার করে একটি চতুর্ভুজের ভেতরের কর্ণের দৈর্ঘ্য হিসাব করা হয়েছে। ট্যাবলেটটির নাম দেওয়া হয়েছে আইএম ৬৭১১৮।
বলে রাখা প্রয়োজন, চতুর্ভুজের (বা আরও বেশি ভুজ, অর্থাৎ বাহুবিশিষ্ট আকৃতির) বিপরীত দুই কোণের সংযোগ রেখাকেই কর্ণ বলে। যা হোক, বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই ট্যাবলেট ব্যবহৃত হতো শেখানোর জন্য। সেটা খ্রিস্টপূর্ব ১৭৭০-এর ঘটনা। আর পিথাগোরাসের জন্ম খ্রিস্টপূর্ব ৫৭০ অব্দে।
এখানেই শেষ নয়। আরেকটি ট্যাবলেট পাওয়া গেছে, খ্রিস্টপূর্ব ১৮ থেকে ১৬ শতকের। এতে একটি বর্গের মধ্যে একটি চিহ্নিত ত্রিভুজ দেখা যাচ্ছে। ব্যবিলনীয়রা ৬০ ভিত্তিক গণনা পদ্ধতি ব্যবহার করত। সে হিসাবে অনুবাদ করে দেখা গেছে, তারা স্পষ্টতই পিথাগোরাসের উপপাদ্য জানত। বলা বাহুল্য, সে কালে এটাকে নিশ্চয়ই পিথাগোরাসের উপপাদ্য বলা হতো না। শুধু তাই নয়, আরও অগ্রসর অনেক গাণিতিক বিষয়ও তাদের জানা ছিল।
বিষয়টা আরেকটু ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। এই ব্যাখ্যা বেশ স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে মার্কিন গণিতবিদ ব্রুস র্যাটনারের লেখা এক গবেষণাপত্রে। নাম—পিথাগোরাস: এভরিওয়ান নোজ হিজ ফেমাস থিওরেম, বাট নট হু ডিসকভারড ইট ১০০০ ইয়ারস বিফোর হিম। স্প্রিঙ্গার জার্নালে প্রকাশিত এই শিরোনামের বাংলা করলে দাঁড়ায়, পিথাগোরাস: সবাই তাঁর বিখ্যাত উপপাদ্যটি জানে, তবে কেউ জানে না তাঁরও হাজার বছর আগে এটা কে আবিষ্কার করল।
তিনি লিখেছেন, ‘বিষয়টা অনস্বীকার্য। ব্যাবিলনীয়রা বর্গের কর্ণের দৈর্ঘ্য ও এর বাহুগুলোর সম্পর্ক জানত: d = √2।’ তাঁর ভাষ্যে, ‘এটাই সম্ভবত প্রথম জানা অমূলদ সংখ্যা। অন্যদিক থেকে ভাবলে এর আরেকটি অর্থ দাঁড়ায়, পিথাগোরাসের উপপাদ্যখ্যাত নিয়মটির সঙ্গে তাঁরা পরিচিত ছিল। অন্তত এর বিশেষ ব্যবহার, বর্গের কর্ণের দৈর্ঘ্য, d2 = a2 + a2 = 2a2 তারা জানত (a এখানে বর্গের বাহু)। সেটা বিখ্যাত পিথাগোরাসের আরও প্রায় হাজার বছর আগের কথা।’
পিথাগোরাসের উপপাদ্যের আরেক ধরনের প্রয়োগ আছে। এর ইংরেজি নাম ‘পিথাগোরিয়ান ট্রিপল’। বাংলায় বলা যায়, পিথাগোরাসের ত্রয়ী। অর্থাৎ এমন তিনটি ধনাত্মক পূর্ণসংখ্যা, যাদের দুটির বর্গ তৃতীয়টির বর্গের সমান। একটি সংখ্যা a, একটি b ও একটি c হলে, a2 + b2 = c2। ঠিক ধরেছেন, পিথাগোরাসের উপপাদ্যে ত্রিভুজের তিন বাহুর দৈর্ঘ্যের সংখ্যাগত মানকেই একসঙ্গে বলা হয় পিথাগোরাসের ত্রয়ী। এটাকে সাধারণত লেখা হয় (a, b, c) আকারে। যেমন(3, 4, 5)।
খ্রিস্টপূর্ব ১৮ শতকের একটি প্যাপিরাস পাওয়া যায় মধ্য মিসরীয় সাম্রাজ্যে। প্যাপিরাস হলো একধরনের উদ্ভিদ থেকে তৈরি বিশেষ ধরনের মিসরীয় লেখার খাতা। এই প্যাপিরাসে একটা সমস্যা দেখা যায়, যার সমাধান পিথাগোরাসের ত্রয়ী (6, 8, 10)। তবে সেই প্যাপিরাসে কোনো ত্রিভুজের উল্লেখ নেই।
মিসর তো মিসর, প্রাচীন ভারতের বুদ্ধায়ন শুল্বসূত্রতেও পিথাগোরাসের ত্রয়ী ও উপপাদ্যের উল্লেখ আছে। দুটোই এ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে সমদ্বিবাহু ত্রিভুজের জন্য। অর্থাৎ এটি এই উপপাদ্য বা ত্রয়ীর সাধারণ ব্যবহার নয়, বিশেষ একধরনের ব্যবহার। এই শুল্বসূত্রের সময়কাল খ্রিস্টপূর্ব ৮ থেকে ৫ শতকের দিকে।
শোনা যায়, পিথাগোরাস মিসরে গিয়ে মূলত এই উপপাদ্যটি শিখেছিলেন। তাহলে প্রশ্ন আসে, এটি তাঁর নামে বিখ্যাত হয়ে উঠল কেন? এর কৃতিত্বই-বা তিনি কীভাবে পেলেন? উত্তরে বলা যায়, পিথাগোরাসের নিজের কোনো লেখা ইতিহাসে সংরক্ষিত নেই। সে কালে তিনি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বলা হতো ‘পিথাগোরিয়ান’। স্কুলটির অবস্থান ছিল আজকের দক্ষিণ ইতালিতে। সেই স্কুলে তিনি যা শিখিয়েছেন, সেগুলো কালের আবর্তে ছড়িয়ে পড়েছে। সে সব জ্ঞানের বেশির ভাগই তাঁর নামে স্বীকৃতি পেয়েছে সময়ের খেরোখাতায়।
প্রশ্ন আসে, তাঁর লেখা কেন পাওয়া যায় না? কারণ, পিথাগোরিয়ান জ্ঞান শেখানো হতো মুখে মুখে। লেখার চল ছিল না ওভাবে। তাই সেই বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অনেক আবিষ্কারও পরে প্রচলিত হয়েছে তাঁর নামে। পিথাগোরাসের আবিষ্কার না হলেও তাঁর বিদ্যালয়ই এই উপপাদ্য জনপ্রিয় করে তোলে। এভাবে হাজার বছরের ইতিহাসে উপপাদ্যটি খ্যাতি পায় পিথাগোরাসের নামে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।