জুমবাংলা ডেস্ক: পশ্চিম আফ্রিকার দেশ নাইজার ও চাদ। দেশদুটির অংশে থাকা সাহারা মরুভূমিতে বাস করে যাযাবর পশুপালক উপজাতি ওডাআবে। সারাবছর এই উপজাতির মানুষেরা ছোট ছোট পরিবার নিয়ে গড়া কয়েকটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে ঘুরে বেড়ায় সাহারা মরুভূমির মরুদ্যানগুলোতে। পশুপালনই এদের মূল জীবিকা। ওডাআবে উপজাতির নারী ও পুরুষেরা তাদের সৌন্দর্য্য নিয়ে ভীষণ গর্বিত।
পুরুষেরা মনে করে তারাই পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ। এমনকি তাদের রুপচর্চায় যাতে ব্যাঘাত না ঘটে তাই তারা সর্বদা সঙ্গে আয়না নিয়ে ঘোরে। প্রাচীনকাল থেকেই ওডাআবে সমাজে অবাধ যৌনতার সুযোগ পান নারী ও পুরুষেরা। যৌনতা নিয়ে কোনো রাখঢাকের ব্যাপার নেই উপজাতিটির মধ্যে। গোষ্ঠীপতি শাসিত এই সমাজে একজন নারী বা পুরুষের অসংখ্য যৌনসঙ্গী থাকা স্বাভাবিক এবং সেটা ওডাআবে সমাজে দ্বারা স্বীকৃত। বিয়ের আগে ওডাআবে উপজাতির মেয়েরা যার সঙ্গে ইচ্ছা শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। বিয়ের পরেও যতখুশি স্বামী রাখতে পারে।
এই ওডাআবে উপজাতির কাছে বছরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় মাসটি হলো সেপ্টেম্বর। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে এই সেপ্টেম্বর মাসে তারা পালন করে আসছে এক অদ্ভুত উৎসব, নাম ‘গেরেওল’। এই উৎসবে পুরুষরা যোগ দেয় পরের বউকে চুরি করার উদ্দেশ্য নিয়ে। যৌবনবতী পরস্ত্রীরা মুখিয়ে থাকে ‘গেরেওল’ উৎসবে এসে পছন্দ করা পরপুরুষের সঙ্গে পালাবার জন্য। তাই এই উৎসবের অন্য নাম, বউ চুরি উৎসব।
বছরের সেপ্টেম্বর মাসে সাহারা মরুভূমির বিভিন্ন মরুদ্যানে ওডাআবে উপজাতির হাজার হাজার নারী-পুরুষ একত্রিত হয়ে পালন করে গেরেওল উৎসব। তবে, উৎসব কোথায় হবে তা আগে থেকে বলা হয় না। উৎসবের কিছুদিন আগে দিন ও স্থান ঘোষণা করা হয়। দূতের মাধ্যমে খবর চলে যায় মরুভূমির বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ওডাআবে গোষ্ঠীগুলোর কাছে।
টানা সাতদিন সাতরাত ধরে চলে এই উৎসব। অন্যের বউ চুরির করার চিরাচরিত চেষ্টার সঙ্গে এই উৎসবে চলে দেদার নাচগান ও খানাপিনা। গেরেওল উৎসবের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানটি হলো, ‘ইয়াকে’ প্রতিযোগিতা। এটি হলো পুরুষদের প্রজনন নৃত্য প্রতিযোগিতা। ময়ূররা যেমন সঙ্গিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য পেখম মেলে প্রজনন নৃত্য করে, ওডাআবে উপজাতির পুরুষেরাও সেরকমই একটি নৃত্য পরিবেশন করে। নৃত্যটির নাম ‘ইয়াকে’। বউ চুরির ‘গেরেওল’ উৎসবে হয় সেই ‘ইয়াকে’ নাচের প্রতিযোগিতা।
এই প্রতিযোগিতার কয়েকমাস আগে থেকে পুরুষেরা প্রতিযোগিতার জন্য নিজেদের তৈরি করা শুরু করে। ওডাআবে পুরুষরা বিশ্বাস করে, তাদের সৌন্দর্য্য লুকিয়ে থাকে, তাদের চোখের ধবধবে সাদা ভাব, টিকোলো নাক আর ঝকঝকে সাদা দাঁতে। প্রতিযোগিতায় নামার আগে পুরুষেরা তাই ঘন্টার পর ঘন্টা রুপচর্চা করে চোখ নাক আর দাঁতের সৌন্দর্য্য বাড়াবার চেষ্টা করে। লম্বা ও সুঠাম চেহারার ওডাআবে পুরুষেরা প্রতিযোগিতা শুরুর আগে প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে সাজে।
লাল মাটি দিয়ে তৈরি করা রঙ মুখে মাখে। নিজেদের তৈরি করা আই-লাইনার লাগায় চোখকে সাদা দেখাবার জন্য। ঠোঁটে লিপস্টিকও ব্যবহার করে দাঁতকে ঝকঝকে সাদা দেখাতে। রোমানদের মতো খাড়া নাকগুলোর তীক্ষ্ণতা আরো বাড়ানো হয়, নাকের ওপর সাদা রেখা টেনে। মাথার চুলে বিনুনি করে, সেই বিনুনিতে পুঁতি ও কড়ি গাঁথা হয়। নিজেকে আরো লম্বা দেখাতে মাথার চুলে উটপাখির পালক গাঁথে পুরুষেরা।
এমন যত্ন করে পুরুষেরা নিজেকে সাজায়, দেখে মনে হয় কোনো সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নামতে যাচ্ছে তারা। এসবের মূল উদ্দেশ্য কিন্তু পরস্ত্রীর নজর কাড়া। মজার ব্যাপার হলো, সাজার পর প্রত্যেক পুরুষকে একইরকম দেখতে লাগে। কালো, হলুদ ও সাদা রং মাখা একই ধরনের সরু মুখ আর বড় বড় চোখ। বোঝা যায় না পুরুষটি কোন দলের। তাই ‘ইয়াকে’ প্রতিযোগিতার ময়দানে পরস্পরকে টেক্কা মারতে হয় নৃত্যে ফুটিয়ে তোলা যৌন আবেদন দিয়ে। এই প্রতিযোগিতায় বিচারকের ভূমিকা পালন করে উপজাতির সেরা তিন সুন্দরী। তাদের অবশ্যই বিবাহিতা হতে হবে। প্রতিযোগিতার শেষে তাদের চোখে সেরা পুরুষ বেছে নেয় বিচারকেরা।
বিচারকদের রায়ে যৌন আবেদনের দিক থেকে সেরা তিন পুরুষ, সমবেত পরস্ত্রীদের মধ্যে থেকে বেছে নিতে পারে তার পছন্দ সই নারী। এমনকি বেছে নিতে পারে বিচারকদের মধ্যে থেকে কাউকেও। ওডাআবে সমাজ এই অবিশ্বাস্য কান্ডটিকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়। প্রস্তুতি সমাপ্ত হওয়ার পর শুরু হয় এই অদ্ভুত প্রতিযোগিতা। আশেপাশে ভিড় করে থাকা পরস্ত্রীদের উত্তেজনা তুঙ্গে ওঠে।
বাদ্যযন্ত্রের উদ্দাম তালে তাল মিলিয়ে দলবেঁধে পুরুষেরা ‘ইয়াকে’ নাচতে শুরু করে বৃত্তাকারে। নৃত্যরত অবস্থাতেই বিভিন্নরকমের যৌনভঙ্গি প্রদর্শন করে। ‘ইয়াকে’ নৃত্যের মাধ্যমে প্রত্যেক ওডাআবে পুরুষ মাঠের চারপাশে ভিড় করে থাকা পরস্ত্রীদের বোঝাতে চেষ্টা করে যৌনসঙ্গী হিসেবে সেই শ্রেষ্ঠ। এই নৃত্যের সময় পুরুষরা ইচ্ছে করে তাদের দাঁত বের করে রাখে। যাতে তাদের অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ও আগ্রাসী দেখায়।
ঘন্টা খানেকের মধ্যে শেষ হয় প্রতিযোগিতা। তিন বিজয়ী পুরুষ ভিড়ের মধ্যে থেকে বেছে নেয় তাদের পছন্দের নারীদের। কিন্তু তিনজন পুরুষ না হয় পছন্দের নারী পেলেন, কিন্তু বাকিরা! না বাকি প্রতিযোগীরা প্রতিযোগিতায় জিততে না পেরে একটুও হতাশ হন না। কারন এই প্রতিযোগিতার পরেই শুরু হয় আসল বউ চুরি উৎসব। প্রতিযোগিতা চলাকালীন নৃত্যরত ওডাআবে পুরুষেরা তাদের চারধারে ভীড় করে থাকা পরস্ত্রীদের দিকে অর্থপূর্ণ যৌন ইঙ্গিত করেন।
পুরুষদের ইঙ্গিতে সবার অলক্ষে সাড়া দেন বিভিন্ন পরস্ত্রীরা। তাদের মধ্যে থেকে পছন্দের পরস্ত্রীটিকে নজরে রাখে ওডাআবে পুরুষেরা। প্রতিযোগিতার শেষ হওয়ার পর, ভিড়ের সুযোগ নিয়ে পছন্দ করা পরস্ত্রীর কাঁধে টোকা মারে পুরুষ। সাড়া দেয় পরস্ত্রীও। তারপর পরপুরুষের সঙ্গে মেলায় হারিয়ে যায়। প্রতিযোগিতায় যোগ দেওয়া সব পুরুষকেই একই রকম দেখতে লাগে বলে ‘বউ চোর’ পুরুষ সহজে ধরা পড়ে না।
এই উৎসবে কেউ যদি ধরা না পড়ে, সফলভাবে পরের বউকে চুরি করে নিতে পারে এবং তাহলে সেই ‘বউ চোর’ পুরুষটি হবে নারীটির দ্বিতীয় স্বামী। একেবারে সমাজ স্বীকৃত স্বামী। বউ চুরি উৎসবের সুযোগে, দেখতে খারাপ স্বামীর সুন্দরী স্ত্রী বা দাম্পত্য জীবনে অসুখী স্ত্রীরা স্বামীকে নির্দ্বিধায় পাল্টে নেয়। রাতের অন্ধকারে মরুভূমির বালিতে বা মরুদ্যানের ঝোপের ভেতর চলে নতুন জুটিদের উদ্দাম প্রেম। কেউ বাধা দেয় না। কেউ বিরক্ত করেনা।
ভোর হওয়ার আগেই নতুন স্বামীতে তৃপ্ত নারীরা, নিজেদের স্বামী ও সংসার ফেলে পালিয়ে যায় পরপুরুষদের হাত ধরে। নারীদের ফেলে যাওয়া ছেলেমেয়েদের লালন পালন করে বউয়ের বাবা, মা ও গোষ্ঠী। কিছুদিন মাথা চাপড়াবার পর বউ পালানো বর শপথ নেয়, আগামী বছরের গেরেওল উৎসবে পরের বউকে চুরি করবেই করবে। তার বউ চুরির প্রতিশোধ সে নেবেই নেবে। তাই সেপ্টেম্বর মাস আসার অনেক আগে থেকেই, বউপালানো বর ব্যস্ত হয়ে পড়ে রুপচর্চা আর ‘ইয়াকে’ নৃত্য নিয়ে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।