সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ : পুলিশকে নিয়মিত মাসোহারা দিয়েও হঠাৎ উচ্ছেদের শিকার হয়েছেন মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকার শতাধিক হকার। ফলে দোকান করতে না পেরে চরম অর্থসঙ্কটে পড়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে ওই হকারদের পরিবার।
জানা গেছে, মানিকগঞ্জ পৌরসভার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ভ্যান, ট্রলি ও ছোট ছোট অস্থায়ী দোকান বসিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো শতাধিক হকার। ফুটপাতে এসব দোকান করার বিধান না থাকলেও দীর্ঘদিন ধরেই মানিকগঞ্জ সদর পুলিশ ফাঁড়ির কর্মকর্তাদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে ফুটপাতে দোকান বসিয়ে কোন রকমে জীবিকা নির্বাহ করতো হকাররা। মাস শেষ হতেই নির্ধারিত লোকের মাধ্যমে প্রতিটি হকারের নিকট হতে মাসোহারা সংগ্রহ করে পুলিশের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। বাসস্ট্যান্ড এলাকার ফুটপাতে বসানো প্রতিটি ভ্যান থেকে ১০০০ টাকা, ট্রলিতে ৫০০ টাকা, সেদ্ধ ডিম বিক্রির দোকানে ৫০০ টাকা, হালিম বিক্রির দোকানে ১৫০০ টাকা হারে চাঁদা দিতে হয়। প্রতিটি ক্যাটাগরির জন্য নির্ধারিত লোক এসে মাস শেষ হলেই চাঁদার টাকা উঠিয়ে সদর ফাঁড়ির ইনচার্জের কাছে পৌছে দেয়। তবে মাসোহারা দিতে দেরি হলেই মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে হকারদের দোকান বসাতে বাধা সৃষ্টি করে পুলিশ।
গত ৩০ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে (একজন হকারের সহকারি পরিচয়ে) দেখা যায়, ভ্যান, ট্রলি, ছোট ছোট অস্থায়ী দোকান বসিয়ে হকারি করছে শতাধিক হকার। সন্ধ্যা হওয়ার আগেই ফুটপাতে বসানো প্রতিটি ভ্যান থেকে ১০০০ টাকা ও ট্রলি থেকে ৫০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করছে পুলিশের সোর্স হিসেবে খ্যাত হকার জিন্নাহ। সেসময় ভ্যান ও ট্রলি থেকে চাঁদার টাকা উঠানোর সময় সাংবাদিকের উপস্থিতি টের পেয়ে (টাকা উঠানোর ভিডিও করার সময়) হকারদের দোকানে গিয়ে টাকা দিয়ে আসার কথা বলে নিজের দোকানে চলে যান জিন্নাহ। তখন জিন্নাহ বিষয়টি সদর ফাঁড়ির ইনচার্জ রণজিৎ সাহাকে ফোনে জানান। এর কিছুক্ষণ পরেই সদর ফাঁড়ির ইনচার্জ রণজিৎ সাহা মোটরসাইকেল যোগে বাসস্ট্যান্ডে এসে জিন্নাহকে দিক-নির্দেশনা দিয়ে চলে যান।
পুলিশকে মাসোহারা দেওয়ার বিষয়ে একাধিক হকারের সাথে কথা হলে তারা জানান, প্রতিটি ভ্যান থেকে ১০০০ টাকা ও ট্রলি থেকে ৫০০ করে টাকা দিতে হয়। পুলিশকে টাকা না দিলে এখানে দোকান করা যায়না। টাকা দেওয়ার পরও মাঝে মাঝে ঝামেলা করে। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে একাধিক হকার বলেন, প্রতিমাসে পুলিশকে টাকা দিয়ে আমরা কোনরকমে দোকান করে আমাদের সংসার চালাই। এটা নিয়ে কোন নিউজ কইরেন না। নিউজ হলে আমাদের উপর চাপ আসবে। আমাদের হয়তো আর দোকান করতে দিবে না।
পুলিশের নামে হকারদের কাছ থেকে টাকা উঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে হকার জিন্নাহ প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করলেও পরে ভিডিও দেখানোর পর অকপটে সব স্বীকার করেন। তিনি জানান, ভ্যান ও ট্রলিতে করে যারা কাপড় বিক্রি করে আমি শুধু তাদের কাছ থেকে টাকা উঠাই। পরে এসব টাকা রণজিৎ স্যারকে দেই। অন্যান্য হকারদের কাছ থেকে কে টাকা উঠায় আমি সেটা জানিনা। স্যার তো আসছে অল্পকিছু দিন হলো। এর আগে আরো অনেক অফিসারের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল।
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ সদর ফাঁড়ির ইনচার্জ রণজিৎ সাহার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, ফুটপাতে দোকান করার কোন বিধান নেই। অনেক সময় মানবিক কারণে তাদের সুযোগ দেই। তবে মাঝে মাঝেই বাসস্ট্যান্ডের হকারদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়। তাদের কাছ থেকে কোন টাকা পয়সা নেওয়া হয়না। যে ছেলেটা টাকা উঠায় বললেন সে হয়তো ওদের যে সমিতি আছে সেই টাকা উঠায়। বাসস্ট্যান্ডের সব হকারই আমাকে সম্মান করে। আমি সবসময় তাদের খোঁজখবর রাখি। তাদের কোন বিপদ আপদ হলে আমি তাদের সহযোগিতা করি। কিছুদিন আগেও এক হকার অসুস্থ শুনে ফল কেনার জন্য তাকে ৫০০ টাকা দিয়েছি। কে বা কারা টাকা উঠায় আমার জানা নেই। আপনি এ তথ্য দেয়ায় আমাদের উপকার হলো। খোঁজখবর নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে শনিবার (২২ অক্টোবর) বিকেলে বাসস্ট্যান্ড এলাকায় হকারদের উচ্ছেদের বিষয়ে জানতে চাইলে কয়েকজন হকার বলেন, শুনেছি গত মাসের শেষে সাংবাদিকরা টাকা উঠানোর ভিডিও করে নিয়ে গেছে। এর দুই তিন দিন পর থেকেই পুলিশ আমাদের এখানে বসতে দিচ্ছেনা। গতমাসের চাঁদার টাকাও দিয়ে দিয়েছি। তবু পুলিশ আমাদের হয়রানি করতেছে।
ভ্যানে করে কাপড় বিক্রি করা একজন হকার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আমার এখনো ৭০ হাজার টাকার মাল পড়ে আছে। একদিকে বাবা অসুস্থ, অন্যদিকে সংসারের খরচ যোগাড় করতে পারছিনা। আজকে বাবার জন্য ওষুধ নিতে আসছিলাম, পকেটে আর কোন টাকা নেই। কারো কাছ থেকে ১০০ টাকা ধার করে তারপর বাড়ি ফিরতে হবে।
ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে আসা হকার মূসা মিয়া শনিবার (২২ অক্টোবর) দুপুরে বলেন, আমি এখানে প্রায় ১০ বছর ধরে হকারি করি। এর থেকে যা আয় হয় তা দিয়েই সংসার চালাই ও ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা করাই। আজকে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে রণজিৎ স্যার এসে আমার দোকান থেকে চার জোড়া জুতা নিয়ে রিকশাওয়ালাদের দিয়ে দিয়েছে। সারাদিনে যা লাভ করবো তা নিমিষেই শেষ হয়ে গেছে। আমরা তো চুরি বাটপারি করি না, আমাদের ব্যবসা বন্ধ করে দিলে আমরা কি করে খাবো?
তবে সকালের দিকে বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার কথা স্বীকার করলেও হকার মূসা মিয়ার জুতা নিয়ে রিকশাওয়ালাদের দেয়ার কথা অস্বীকার করেন মানিকগঞ্জ সদর ফাড়ির ইনচার্জ রণজিৎ সাহা। তিনি বলেন, আমি একটু অসুস্থ, এরকম কোন ঘটিয়েছি বলে তো আমার মনে পড়েনা।
হকার উচ্ছেদ ও ফাঁড়ি পুলিশের চাঁদাবাজির বিষয়ে মানিকগঞ্জের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ গোলাম আজাদ খান বলেন, রাস্তায় কোন হকার বসার সুযোগ নেই, এটা সম্পূর্ণ বেআইনী। তবে পুলিশের কেউ যদি হকারদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে সেই দায় তার। কেউ অভিযোগ করলে তদন্ত করে বিষয়টি প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
বিয়ের ৫ মাস পর স্ত্রীকে পতিতালয়ে বিক্রি, স্বামী-ননদের বিরুদ্ধে মামলা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।