আন্তর্জাতিক ডেস্ক : প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষ নতুন নতুন উপায়ে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছে, আর তারই এক নিদর্শন হিসেবে আজও পৃথিবী জুড়ে অগণিত মাটির নিচে থাকা আশ্রয়স্থল এবং গোপন শহর খুঁজে পাওয়া যায়। এ বিষয়ে লিখেছেন অনিন্দ্য নাহার হাবীব
মাটির নিচের শহরগুলো যেন পৃথিবীর ভূগর্ভে লুকিয়ে থাকা রহস্যময় গহিন জগতের দরজা। এগুলো শুধু ভুতুড়ে বা চাঞ্চল্যকর কোনো জায়গা নয়, বরং ইতিহাস, প্রাচীন সভ্যতা এবং মানব প্রকৌশলের এক চমকপ্রদ উদাহরণ। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা যেখানে শহর গড়ে তুলছি, সেখানে এই মাটির নিচের প্রাচীন শহরগুলো মানুষের ক্ষমতা ও ইতিহাস সম্পর্কে একদম ভিন্ন কিছু উদাহরণ আমাদের সামনে উপস্থিত করে।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই মানুষ নতুন নতুন উপায়ে নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছে, আর তারই এক নিদর্শন হিসেবে আজও পৃথিবী জুড়ে অগণিত মাটির নিচে থাকা এসব আশ্রয়স্থল এবং গোপন শহরগুলো আমাদের অবাক করে। কিছু শহর কয়েক শতক আগেও ছিল প্রাণবন্ত, আর কিছু শহর পরিণত হয়েছে কিংবদন্তির খন্ডচিত্রে। এর মধ্যে যেমন রয়েছে দুর্দান্ত স্থাপত্য এবং ঐতিহাসিক কীর্তির প্রতিফলন, তেমনি রয়েছে যুদ্ধকালে শত্রুর হাত থেকে আশ্রয় নেওয়ার গল্প।
যদি ইতিহাসের পাতায় চোখ বুলাই, প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে শুরু করে ঊনবিংশ শতকের শুরু পর্যন্ত, দেখতে পাবেন যে প্রাচীন ও আধুনিক সব ধরনের সভ্যতাই সবসময় নিজেদের রক্ষা করার নতুন নতুন উপায় খুঁজে বের করার চাপের মধ্যে ছিল। আর মজার বিষয় হলো, তাদের সেই কৌশল আজও মানুষকে অবাক করে দেয়।
বিশাল প্রতিরক্ষামূলক শহরের দেয়াল, গোপন পথ ও সুড়ঙ্গ বানানোর মতো চমকপ্রদ কাজ মানুষ করেছে।
তুরস্কের ডেরিনকুয়ু
ক্যাপাডোকিয়া তুরস্কের অন্যতম সুন্দর এবং জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। গরম বাতাসের সাহায্যে উড়ে বেড়ানো বেলুন, যাকে হট এয়ার বেলুন বলে, তাতে করে আকাশ ভ্রমণের সঙ্গে মিশে থাকা এই এলাকার মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য সত্যিই স্বপ্নময়। বলা হয়ে থাকে, তুরস্কে এমন একটি অঞ্চল আছে যা চাঁদের মতো দেখতে এবং সেখানে আছে অন্তত ৩৬টি মাটির নিচের শহরের অস্তিত্ব। এর মধ্যে সবচেয়ে গভীর এবং উল্লেখযোগ্য হলো ডেরিনকুয়ু।
তথ্যমতে, ডেরিনকুয়ুর এই বিশাল নেটওয়ার্কের সুড়ঙ্গ এবং পথ প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৮ম শতাব্দীর সময় থেকে আছে। এটি সম্ভবত যুদ্ধের সময় আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ডেরিনকুয়ু ছিল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মাটির নিচের শহর, যেখানে জীবনধারণের সব ব্যবস্থা ছিল। এর অন্যতম আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো ক্রুস আকৃতির একটি গির্জা।
১৯৬৩ সালে এটি আবিষ্কৃত হয়। দর্শনার্থীদের জন্য জায়গাটি খোলা রয়েছে। কেউ চাইলে সেখানে গিয়ে দেখে আসতে পারেন তাদের ঘর, সুড়ঙ্গ, সেখানে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা ইত্যাদি।
তুরস্কের মাটিতে এই শহর একদিকে ঐতিহাসিক রহস্য আর অন্যদিকে প্রকৌশল দক্ষতার অনন্য উদাহরণ।
জর্ডানের পেট্রা : মাটির মধ্যে গড়ে ওঠা রহস্যময় শহর পেট্রা আজ জর্ডানের সবচেয়ে বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্রগুলোর মধ্যে একটি এবং এর ইতিহাস সত্যিই মজার! এই প্রাচীন শহরটি দক্ষিণ-পশ্চিম জর্ডানে, লালচে বালির পাহাড়ের মধ্যে লুকিয়ে ছিল দীর্ঘদিন এবং ১৮০০ সালের আগে কেউ জানতও না এর কথা।
পেট্রা গড়ে উঠেছিল নবাতিয়ান নামে একটি গোত্রের হাতে, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে। তারা এখানে একটা বিরাট শহর গড়ে তোলে যেখানে ছিল প্রায় ৩০,০০০ মানুষের বসবাস। তাদের বিশেষত্ব ছিল মাটির মধ্যে গভীরভাবে খোদাই করা অদ্ভুত সুন্দর ভবনগুলো। পেট্রা এত সুন্দর ছিল যে, এটি হয়ে উঠেছিল বিশ্বের অন্যতম ধনী ও জনপ্রিয় বাণিজ্যিক কেন্দ্র।
কিন্তু, সপ্তম শতকের পরে ধীরে ধীরে তা পরিত্যক্ত নগরীতে পরিণত হতে শুরু করে। প্রায় ১৮০০ বছর ধরে কেউ আর এই শহরের কথা জানত না! এক্সপ্লোরার জন রিড ১৯১২ সালে আবার
এটি আবিষ্কার করেন। তার পর থেকেই এটি পৃথিবীর অন্যতম রহস্যময় জায়গা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠে।
এখানের সবচেয়ে বিখ্যাত অংশ হলো ‘আল-খাজনে’ (The Treasury), যা এক বিশাল খোদাই করা বিল্ডিং, যা দেখতে এত সুন্দর যে এটি সারা বিশ্বের মানুষের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে গেছে। আপনি যদি এই শহরে বেড়াতে যান, তবে এখানে পাবেন একের পর এক সুদৃশ্য পাথরের গঠন, প্রাচীন মন্দির, নাটকীয় রাস্তা সব কিছুই মিলে একটি ঐতিহাসিক গল্প বলে।
পেট্রা শুধু ইতিহাস নয়, এক অভিজ্ঞতারও জায়গা। এই প্রাচীন শহরটি আপনাকে নিয়ে যাবে ইতিহাসের এক রহস্যময় পথে, যেখানে রহস্য, সৌন্দর্য এবং প্রাচীন সভ্যতার ছাপ মিশে রয়েছে!
ইংল্যান্ডের বর্লিংটন
কোল্ড ওয়ার-এর সময়, ব্রিটিশ সরকার ‘বর্লিংটন’ নামক একটি আন্ডারগ্রাউন্ড বাঙ্কারে আশ্রয় নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল। ধারণা করা হয়, কোর্টশামের গ্রামের নিচে এই বাঙ্কার প্রায় ৬০ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। ১৯৫০-এর দশকে এই গোপন শহরটি তৈরি হয়েছিল এবং এতে ছিল অফিস স্পেস, চিকিৎসা সুবিধা, বিবিসি স্টুডিও, ক্যান্টিন, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ এবং অন্যান্য সব প্রয়োজনীয় সুবিধা। রেকর্ড অনুযায়ী, এই শহরটি তৈরি করা হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর এবং প্রায় ৪,০০০ কর্মচারীকে জরুরি পরিস্থিতিতে নিরাপদ রাখার জন্য। যদিও এটি কখনো ব্যবহার করা হয়নি। ১৯৯১ পর্যন্ত শহরটি কার্যকর ছিল এবং ২০০৪ সালে এর গোপনীয়তা তুলে দেওয়া হয় বা ডিক্লাসিফাই করা হয়।
ইতালির অরভিয়েতো
ইতালির অরভিয়েতো শহরটি যেন মাটির মধ্যে এক দুর্দান্ত রহস্য লুকিয়ে রেখেছে। আগ্নেয়গিরির শিলা দিয়ে তৈরি এই শহরটি দেখতে যেমন দারুণ, তেমনি তার মাটির নিচে রয়েছে এক বিস্ময়কর শহর। একসময় ইট্রুস্কানরা এই শহর গড়ে তুলেছিল।
প্রথম দিকে, এই শহরের মাটির নিচের সিস্টেমটি মূলত মদ এবং তেল পরিষ্কার করার জন্য ব্যবহার করা হতো। তবে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এটি একটি বোমা থেকে বাঁচার আশ্রয়স্থল হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। অরভিয়েতোর এই মাটির নিচে ১,২০০টি পর্যন্ত সুড়ঙ্গ ও গ্যালারির নেটওয়ার্ক রয়েছে, যা মূলত সিংহভাগ জলাধার এবং কুয়া হিসেবে তৈরি হয়েছিল। পরে এতে নানা ধরনের ব্যবস্থা যুক্ত করা হয়।
এই শহরের মাটির নিচের পথ ধরে এগোলে, আপনি পেয়ে যাবেন আশ্চর্য সুন্দর পুরনো কাঠামো, টানেল, ভেতরের গোপন অংশ এবং মুছে না যাওয়া ইতিহাসের নানা দিক। যখন আপনি ওপরে উঠে আসবেন, তখন দেখবেন শীর্ষভাগ থেকে পুরো শহরের সুন্দর দৃশ্য।
অরভিয়েতো শহরটি অতীতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তার বাণিজ্যিক অবস্থানের জন্য এবং এখন তা ইতিহাসের দিক থেকে পৃথিবীর অমূল্য রত্নগুলোর মধ্যে অন্যতম!
চীনের বেইজিং : মাটির নিচে এক নিউক্লিয়ার শেল্টার
ডিক্সিয়া চেং, বেইজিংয়ের মাটির নিচে একটি বিস্ময়কর গোপন শহর, যা ১৯৬০-এর দশকে তৈরি হয়েছিল নিউক্লিয়ার হামলার পরবর্তী বিপর্যয় থেকে মানুষের সুরক্ষার জন্য। ৮৫ বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে থাকা এই শহরটি ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন হয়নি, তবে এটি প্রায় ১০ লাখ মানুষকে ৪ মাস পর্যন্ত আশ্রয় দিতে সক্ষম ছিল।
এই মাটির নিচের শহরে থাকা সমস্ত সুবিধা ছিল যা এক সমৃদ্ধ শহরের জন্য প্রয়োজন এখানে হাসপাতাল, বিদ্যালয়, রেস্তোরাঁ, গোডাউন, এন্টারটেইনমেন্ট ভেন্যু এবং এমনকি আইস স্কেটিং রিঙ্কও ছিল। আজ এটি একটি পাবলিক ট্যুরিস্ট আকর্ষণ হিসেবে উন্মুক্ত। এখন পর্যটকরা আসেন এবং ইতিহাসের এমন এক দিকের সম্মুখীন হন, যা সাধারণ মানুষের কাছে এতদিন সম্পূর্ণ গোপন ছিল।
ডিক্সিয়া চেংয়ের মতো মাটির নিচের শহরগুলো একেকটি দলিলসম। একসময় মানুষ কীভাবে আশ্রয়ের জন্য এমন বিস্ময়কর অবকাঠামো তৈরি করেছিল যা কালের পরিক্রমায় ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে।
ফ্রান্সের নেওর্স :মাটির নিচে এক গোপন আশ্রয়
নঅরস, ফ্রান্সের উত্তরে এক অদ্ভুত ভূগর্ভস্থ শহর, যা মানুষের হাতে তৈরি কমপক্ষে তিনশটি ঘরের এক সুবিশাল সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্ক। মূলত এটি একটি প্রাচীন খনি ছিল, যা পরে প্রতিরক্ষামূলক সুবিধার কারণে একটি গোপন আশ্রয়ে পরিণত হয়। শহরটির উৎপত্তি তৃতীয় শতক খ্রিস্টাব্দে। এ এক অবিশ্বাস্য স্থাপনা, যেখানে ছিল কুয়া, গির্জা, ঘোড়ার আস্তাবল এবং শহরের প্রাকৃতিক নিরাপত্তা বজায় রাখার জন্য আরও নানা বিশেষ জায়গা।
এই মাটির নিচে তৈরি শহরটি প্রায় তিন হাজার মানুষকে আশ্রয় দিতে সক্ষম ছিল। এখানকার ঘর, মন্দির এবং অন্য ভবনগুলো সাধারণ মানুষের কাছে এক রহস্যময় শহরের স্মৃতি হিসেবে আজও বেঁচে আছে।
গোপন আশ্রয় হিসেবে এর ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এবং পরবর্তী কালে এটি বিশ্বযুদ্ধের সময় বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছিল। এই গোপন শহর এখন পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত, যারা প্রাচীন ফ্রান্সের ইতিহাস এবং সেই সময়কার অভিজ্ঞান দেখতে চান তাদের জন্য এটি একটি চমৎকার ভ্রমণের জায়গা।
রোমের ভুতুড়ে কটাকম্বস ও ক্রিপ্ট : এক আতঙ্কিত ভ্রমণ
রোমের রাস্তায় চলতে চলতে আপনি যদি মাটির নিচে কিছু গর্ত দেখতে পান, তাহলে অবাক হবেন না! এখানে বিশ্বের সবচেয়ে পুরনো এবং দীর্ঘতম কবরস্থানের সুড়ঙ্গগুলো বিস্তৃত একটি অদ্ভুত ল্যাবিরিন্থ বা গোলকধাঁধা। এই মাটির নিচের কবরস্থানে খ্রিস্টান এবং ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রাচীন কবর দেওয়ার পদ্ধতির রহস্য লুকিয়ে আছে। এই ভুতুড়ে জায়গাগুলোর বহু অংশ এখনো অনাবিষ্কৃত!
শহরের এই মাটির নিচের বিস্ময়কর স্থানগুলোর মধ্যে কিছু অংশ দর্শকদের জন্য খোলা রয়েছে, যেমন সেইন্ট ডোমিটিয়া কটাকম্বসের পুরনো অংশগুলো, প্রিসিলা কটাকম্বসের ভেতরে থাকা ফ্রেস্কো দিয়ে সজ্জিত সুড়ঙ্গ এবং সবচেয়ে অদ্ভুত কাপুচিন ফ্রিরারেস মিউজিয়াম ও ক্রিপ্ট, যেখানে ৪,০০০ ফ্রায়ের মমি ও কঙ্কালের অলংকৃত প্রদর্শনী রয়েছে এবং কী মজা, এই গির্জার দেয়ালে থাকা কঙ্কালগুলো যেন আপনার শিরদাঁড়ায় ঠা-া কাঁপন তুলে দেয়, কারণ এখানে রয়েছে ত্রিশ হাজার প্লেগ আক্রান্ত ব্যক্তির কঙ্কাল! সূত্র : দেশ রূপান্তর
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।