বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : পৃথিবী সূর্যের চারপাশে অবিরাম ঘুরছে। সেটা গত ৪৫০ কোটি বছর ধরে। ভাবতে পারেন, এতগুলো বছরে সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী কতবার প্রদক্ষিণ করেছে?
বলতেই পারেন, পৃথিবী বছরে একবার সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। তাহলে ৪৫০ কোটি বছরে ৪৫০ কোটিবার সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরেছে।একই কথা অন্য গ্রহগুলোর জন্য প্রযোজ্য। ব্যস, সহজ হিসাব।কিন্তু ব্যাপারটা মোটেও অত সহজ নয়। এটা ঠিক, সৌরজগতের গ্রহগুলোর কক্ষপথ অনেকটা স্থিতিশীল।কোটি কোটি বছর ধরে এদের মধ্যে আসলে তেমন কোনো বদল আসেনি। তারপরও অতি সরলীকরণ করা যাচ্ছে না।গ্রহবিজ্ঞানীদের মতে, সৌরজগতের জন্ম হয়েছিল আজ থেকে ৪৬০ কোটি বছর আগে। তার আগে এক নাক্ষত্রিক বিস্ফোরণের মাধ্যমে ধূলিকণার মেঘ থেকে সূর্যের জন্ম হয়।এর প্রায় এক লাখ বছর পর অর্থাৎ এখন থেকে ৪৫৯ কোটি বছর আগে গ্যাসীয় গ্রহগুলো —যেমন বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুনের জন্ম হয়। পৃথিবীসহ বুধ, শুক্র ও মঙ্গলের মতো পাথুরে গ্রহগুলো আকার নেয় আরো ৯ লাখ বছর পর। অর্থাৎ আজ থেকে ৪৫০ কোটি বছর আগে।সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, সবগুলো গ্রহ একসঙ্গে কক্ষপথে ঘুরতে শুরু করেনি। কিছু কিছু গ্রহ অস্থিতিশীল ছিল।বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন গ্রহ স্থিতিশীল হয়ে যায় শুরুতেই। পৃথিবীসহ পাথুরে গ্রহগুলোর মধ্যে বিশৃঙ্খলা ছিল, পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষও ঘটেছে এদের। এতে অনেক ছোট ছোট গ্রহাণু অন্যান্য বস্তু গ্রহগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে চিরদিনের মতো বিলীন হয়েছে, তেমনি নতুন নতুন বস্তু তৈরিও হয়েছে। প্রথম গ্রহগুলো তৈরির পর প্রায় ৯ কোটি বছর সময় লাগে এই অস্থিরতা দূর হতে। তারপর-অর্থাৎ ৪৫০ কোটি বছর আগ থেকে অবশ্য সবগুলো গ্রহ সূর্যের চারপাশে নিয়মিত গতিতেই প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে। এর পর থেকে এ ব্যবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি।ফ্রান্সের বোর্দো অ্যাস্ট্রোফিজিকস ল্যাবরেটরির জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং গ্রহবিশেষজ্ঞ শন রেমন্ড বলেন, ‘স্থিতিশীল হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত গ্রহগুলোর গতি ও কক্ষপথ ৯৮ থেকে ৯৯ শতাংশ আগের মতোই রয়েছে। তাই ওই সময় থেকে এ পর্যন্ত গ্রহগতিবিদ্যার হিসাব কষে, কোন গ্রহ সূর্যের চারপাশে কতবার ঘুরেছে, সেটা বের করে ফেলা সম্ভব।’পৃথিবীর কথাই ধরা যাক। আমাদের গ্রহটির জন্ম স্থিতিশীল যুগে। তখন থেকে মোটামুটি অপরিবর্তিত রয়েছে এর গতি কক্ষপথ। পৃথিবী প্রতি ঘণ্টায় প্রায় এক লাখ আট হাজার কিলোমিটার গতিতে নিজের কক্ষপথে সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে। প্রতি এক বছরে একবার করে ঘুরে আসছে সূর্যকে। তাই আপনি বলতেই পারেন, সূর্য মোটামুটি ৪৫০ কোটিবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করেছে।কিন্তু অন্য গ্রহের ক্ষেত্রে এই হিসাব খাটবে না। কারণ অন্য কোনো গ্রহের কক্ষপথ পৃথিবীর সমান নয়, আবার ঘূর্ণনের গতিও এক নয়। তাই পৃথিবীর এক বছর অন্য গ্রহগুলোর এক বছরের সমান নয়। কোনো গ্রহ সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর চেয়ে বেশি সময় নেয়, কোনো গ্রহ নেয় কম সময়।
যেমন-সূর্যের সবচেয়ে কাছের গ্রহ বুধ। মাত্র ৮৮ দিনে সূর্যকে একবার ঘূরে আসে গ্রহটি। অর্থাৎ পৃথিবীর এক বছরে গ্রহটি সূর্যকে ৪.১৫ বার প্রদক্ষিণ করে (এক বছরে ৩৭৫.২৫ দিন হিসাব করে)। তাহলে ৪৫০ কোটি বছরে গ্রহটি মোট ১৮৬৭ কোটিবার (প্রায়) সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে।
অন্যদিকে নেপচুন সূর্যের দূরতম গ্রহ। তাই এর কক্ষপথের আকার অনেক বেশি। ৬০,১৯০ দিনে একবার পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে। অর্থাৎ পৃথিবীর ১৬৪.৭ বছরে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে নেপচুন। এ গ্রহটির জন্ম ৫৫৯ কোটি বছর আগে। তখন থেকেই গ্রহটি দুই কোটি ৭৯ লাখবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে। অর্থাৎ বুধ নেপচুনের চেয়ে ৫৬৯ কোটি গুণ বেশি ঘুরেছে সূর্যের চারপাশে।
অন্যান্য গ্রহের কী অবস্থা সেগুলোও দেখে আসতে পারি। শুক্র গ্রহ ২২৫ দিনে একবার সূর্যের চারপাশে ঘুরে আসে, তাই এ গ্রহটি ৪৫০ কোটি বছরে ৭৩০ কোটিবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে। একই সময়ে মঙ্গল ২৪০ কোটিবার সূর্যের চারপাশ ঘুরে এসেছে। কারণ এ গ্রহটি ৬৮৭ দিনে একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে।
অন্যদিকে বৃহস্পতি, শনি ও ইউরেনাসের বর্তমান বয়স ৫৫৯ বছর করে। বৃহস্পতি একবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে ৪,৩৩৩ দিনে। তাই এখন পর্যন্ত মাত্র ৩৮ কোটি ৬৯ লাখবার সূর্যের চারপাশে ঘুরেছে গ্রহরাজ। শনি ঘুরেছে আরো কম—মাত্র ১৫ কোটি ৫৮ লাখবার। কারণ ১০,৭৫৯ দিনে সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করে শনি। ইউরেনাস সূর্যকে প্রদিক্ষণ করে ৩০,৬৮৭ দিনে। তাই এ পর্যন্ত মাত্র পাঁচ কোটি ৪৬ লাখবার সূর্যকে প্রদক্ষিণের সুযোগ পেয়েছে গ্রহটি।
এখন যেভাবে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করছে গ্রহগুলো, একই হার কিন্তু দূর ভবিষ্যতে থাকবে না। সূর্য জ্বালানি ফুরিয়ে নিভে যাওয়ার আগে ফুলে-ফেঁপে উঠবে। পরিণত হবে লোহিত দানবে। তখন এর আকার এতটাই বেড়ে যাবে যে বুধ, শুক্র ও পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলবে।
অন্য গ্রহগুলো সূর্যের তাপে যদি দূর থেকেই ঝলসে না যায়, তাহলে এদের কক্ষপথের আকার বদলে যাবে। তখন আর বর্তমান বা অতীতের গতিতে সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পারবে না সেগুলো। কম বা বেশি হবে প্রদক্ষিণের হার।
সূত্র : লাইভ সায়েন্স