পৃথিবীর তিন ভাগ জল, এক ভাগ স্থল। প্রচলিত প্রবাদ। মিথ্যে নয়, তবে পুরোপুরি সত্যিও নয়। এখন পর্যন্ত পরিচালিত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য-প্রমাণ বলছে, পৃথিবীতে পানির পরিমাণ ৭১%, আর মাটি বা স্থলের পরিমাণ ২৯%। অর্থাৎ পানি: মাটি সমান ২.৫: ১। মানে, আড়াই ভাগ জল, এক ভাগ স্থল!
এই হিসাব থেকে বোঝা যায়, মাটির পরিমাণ পৃথিবীতে এমনিতে কিছুটা কম। তবে এর মধ্যেই তো অত মানুষের বাস। সেই সঙ্গে আরও কত বিপুল প্রাণবৈচিত্র! অথচ এই মাটি বা স্থলের—ইংরেজিতে বলা হয় ল্যান্ড মাস, বাংলায় বলা উচিত স্থলজ ভর—বেশির ভাগই কিনা উত্তর গোলার্ধে। স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞানে তাই মনে প্রশ্ন আসে, এতে তো পৃথিবীতে একটা ভারসাম্যহীনতা তৈরি হওয়ার কথা। যে পাশে বেশি ভর, সে পাশে মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বেশি হওয়া উচিত। এর ফলে প্রভাব পড়ার কথা পৃথিবীর কক্ষীয় বেগে।
বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলও তাই ভেবেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল বিষুবরেখার ওপারে, অর্থাৎ দক্ষিণ গোলার্ধে নিশ্চয় বিপুল পরিমাণের ভূমি আছে। বিষয়টা বোঝার জন্য গোলার্ধ ও বিষুবরেখার ধারণাগুলো একটু ঝালাই করে নেওয়া যাক।
পৃথিবীকে যদি একটা গোলক বা বল কল্পনা করেন, তাহলে এর ঠিক মাঝখান বরাবর একটা রেখা ভাবা যেতে পারে। অবশ্য বাস্তবে এমন কোনো রেখা নেই। তবে আমাদের হিসাবের সুবিধার জন্য ভূতত্ত্ববিদেরা মানচিত্রে এই রেখাটির মাধ্যমে পৃথিবীকে দুভাগ করেছেন। এই রেখাটিই বিষুবরেখা। এর এক পাশে পৃথিবী নামের গোলকটির উত্তর ভাগ বা উত্তর গোলার্ধ (মানে, গোল বা গোলকের উত্তরের অর্ধেক)। আর অন্য পাশে দক্ষিণ গোলার্ধ বা দক্ষিণ ভাগ।
যা বলছিলাম—অ্যারিস্টটল ভেবেছিলেন, দক্ষিণ গোলার্ধে বিশালাকৃতির এক ভূমি আছে। উত্তরের স্থলভাগের প্রায় সমান সেটা। অর্থাৎ দুইয়ে মিলে পৃথিবীর দুপাশে ভরের একটা ভারসাম্য তৈরি হয়। এই ভূমির নাম তিনি দিয়েছিলেন ‘টেরা অস্ট্রেলিস’। প্রায় ২ হাজার বছর মানুষ এই ভূমি আছে বলে ধরেই নিয়েছিল। ১৫ থেকে ১৮ শতকের মাঝে যেসব মানচিত্র আঁকা হয়েছে, সেগুলোতেও এই ভূমির উল্লেখ পাওয়া যায়।
১৭৭০-এর দশকে ইউরোপিয়ান নাবিক জেমস কুক যখন দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর ধরে অভিযান চালান, তখন প্রথমবারের মতো নিশ্চিতভাবে জানা যায়, এমন কোনো ভূমি আসলে নেই। জেমস কুকের সেই অভিযান ‘ফার্স্ট ভয়েজ অব জেমস কুক’ বা জেমস কুকের প্রথম অভিযান নামে পরিচিত। কারণ, তিনি এরকম মোট তিনটি অভিযান চালান। সেই প্রথম অভিযানের অন্যতম লক্ষ্য ছিল টেরা অস্ট্রেলিসের সন্ধান।
সেই সঙ্গে শুক্রের সরণ (ট্রানজিট অব ভেনাস) পর্যবেক্ষণও এর লক্ষ্য ছিল। শুক্রের সরণ একটি বিরল ঘটনা। এ সময় শুক্র সূর্য ও পৃথিবীর মাঝে একই তলে, একই সরলরেখায় চলে (সূর্যগ্রহণের সময় যেমন চাঁদ পৃথিবী ও সূর্যের মাঝখানে চলে আসে)। শুক্রকে তখন দেখে মনে হয় সূর্যের গায়ে একটি গোল কালো দাগ।
যাই হোক, জেমস কুকের সেই অভিযানে জানা গেল, টেরা অস্ট্রেলিসের কোনো অস্তিত্ব নেই। পৃথিবীর বেশিরভাগ ভূমি আসলেই উত্তর গোলার্ধে। তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে, এতে পৃথিবী ভারসাম্য হারাচ্ছে না কেন?
পৃথিবীর একদম ওপরের স্তরটির নাম ক্রাস্ট বা ভূত্বক। এই ভূত্বকের আপার ক্রাস্ট বা ওপরের অংশটায় রয়েছে পৃথিবীর সব মাটি ও পানি। যেটুকু মাটি গোটা পৃথিবীতে আছে, গড় হিসাবে পৃথিবীর ভূত্বকের ওপরের সামান্য পুরু অংশ বলা যায় সেটাকে। আর পৃথিবীর ভূত্বকের এই ওপরের অংশটার মোট আয়তনই গোটা পৃথিবীর আয়তনের তুলনায় নিতান্ত সামান্য, মাত্র ১ শতাংশের মতো। মাটির পরিমাণ তাহলে কত কম, বুঝতেই পারছেন!
কৃত্রিম উপগ্রহ থেকে পৃথিবীর ভর বিশ্লেষণ করেও সেটাই জানা গেছে। দেখা গেছে, পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে ভরের পার্থক্যের পরিমাণ অতি নগণ্য। এত কম যে তা অগ্রাহ্যই করা যায়। অর্থাৎ আমরা যাকে বলছি বিপুল ভূমি—এতগুলো মহাদেশ, তাতে মানুষসহ আরও কত প্রাণ—পৃথিবীর হিসাবে এই ভর অতি নগণ্য। ফলে পৃথিবীর ভরের ওপরে এর তেমন কোনো প্রভাব নেই বললেই চলে।
বিষয়টা আরও ভালো বোঝা যাবে যদি আমরা প্রায় ২০০ মিলিয়ন বা ২০ কোটি বছর আগের কথা চিন্তা করি। সে সময় পৃথিবীর সবটা ভূমি একসঙ্গে মিলে একটি মহাদেশ গঠন করেছিল। বিজ্ঞানীরা এ মহাদেশের নাম দিয়েছেন প্যানজিয়া। সেই প্যানজিয়ার পুরোটাই তখন ছিল দক্ষিণ গোলার্ধে।
কিন্তু এই মাটির ভর যেহেতু অতি সামান্য পৃথিবীর তুলনায়, তাই তখনো এটা পৃথিবীর মহাকর্ষীয় আকর্ষণ বা কক্ষীয় বেগ বা এরকম কিছুর ওপর সেরকম প্রভাব ফেলতে পারেনি। সেই প্যানজিয়া ভেঙেই কালে কালে তৈরি হয়েছে আজকের ভূখণ্ডগুলো। বিপুলা এই পৃথিবীর বিশালতার সামনে আমরা একেকটি মানুষ কত ক্ষুদ্র, বিষয়টা আমাদের সে কথাই আবারও মনে করিয়ে দেয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।