নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর: বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে বাংলাদেশ পরিচিত হলেও, এই খাতের সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি—নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ দিন দিন কমে যাচ্ছে। এক সময় দেশের তৈরি পোশাক শিল্পে মোট শ্রমিকের ৮০ শতাংশই ছিলেন নারী। বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৫৭ শতাংশে।
গবেষণা ও মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানে দেখা যায়, গাজীপুরের শিল্প এলাকায় অবস্থিত ১ হাজার ১৫৪টি পোশাক কারখানায় লাখো নারী শ্রমিক কাজ করলেও, আগ্রহ ও উপস্থিতির হার কমছে দ্রুত গতিতে। গত এক দশকে পরিস্থিতি আরও স্পষ্ট হয়েছে। অন্তত ৫০ জন নারী শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অংশগ্রহণ কমে যাওয়ার পেছনে রয়েছে সন্তান লালন-পালনের অসুবিধা, স্বামীর আয় বৃদ্ধি, কম মজুরি, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, পারিবারিক দায়িত্ব, ও তুলনামূলক ভালো কর্মপরিবেশে অন্য খাতে কাজের সুযোগ।
তৈরি পোশাক শিল্পে কাজ করা নারীরা জানান, অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা, উৎপাদনের চাপ এবং কম পারিশ্রমিক তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত করে তোলে। তারা আরও বলেন, এখন অনেকেই চায় কর্মঘণ্টা ও কাজের পরিবেশ ভালো এমন জায়গায় কাজ করতে, যাতে পরিবার ও সন্তানকে সময় দেওয়া যায়।
অন্যদিকে, তৈরি পোশাক শিল্পে প্রযুক্তিগত পরিবর্তন ও অটোমেশনের ফলে নারী শ্রমিকদের কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের সুযোগও সীমিত হয়ে পড়ছে। স্পিনিং, উইভিং, ডাইং ও ফিনিশিং—এই সেক্টরগুলোতে পুরুষদের আধিপত্য বাড়ছে, কারণ সেখানে কাজের ধরণ ও প্রযুক্তিগত দিকগুলোতে নারী শ্রমিকদের অনুপ্রবেশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
শ্রমিক তাসলিমা খাতুন জানান, “দুজনে পরিশ্রম করে কিছু টাকা জমিয়েছি। তখন পরিশ্রম সইতো, এখন চাপ নিতে কষ্ট হয়। ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি, তাকে মানুষ করতেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।”
এমন অভিজ্ঞতা আরও অনেক নারীর। জামালপুর থেকে আসা আরেক শ্রমিক আলফাজ হোসেন বলেন, “বেতন বাড়লেও এখন স্ত্রী আর গার্মেন্টসে কাজ করতে চায় না। শরীর আগের মতো নেই। গ্রামে ফিরে গেছে।”
এ প্রসঙ্গে শ্রমিক ও নারী অধিকারকর্মী তাসলিমা আক্তার বলেন, “নারী শ্রমিকদের সামনে একসাথে ঘর ও কাজ সামলানোর চ্যালেঞ্জ। ফলে তারা অটোমেশনের মতো নতুন দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পায় না। পাশাপাশি ডে কেয়ার ও মাতৃকালীন ছুটি ব্যবস্থায় উন্নয়ন প্রয়োজন।”
বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ)-এর ২০২৪ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮০ সালে পোশাক শিল্পে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল ৮০ শতাংশ। ২০২১ সালে তা কমে ৫৩.৭ শতাংশে দাঁড়ায়। এখন তা ৫৭ শতাংশের আশেপাশে।
শ্রমিক নেতা আরমান হোসাইন বলেন, “নারীরা সংখ্যায় অনেক হলেও নেতৃত্বে নেই। পরিবার ও সন্তানের দায়িত্ব, প্রশিক্ষণের অভাব, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি এবং ঘরোয়া দায়িত্বে অধিক মনোযোগই তাদের অংশগ্রহণ কমিয়ে দিচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, নারীর অংশগ্রহণ টিকিয়ে রাখতে হলে কর্মপরিবেশ উন্নয়ন, নারী নেতৃত্বের সুযোগ তৈরি, ডে কেয়ার সুবিধা ও প্রশিক্ষণ ব্যবস্থার বিস্তৃতি জরুরি। নয়তো, দেশের রপ্তানির প্রধান খাতটি শ্রমিক সংকটে পড়তে পারে এবং এর অর্থনৈতিক প্রভাবও হতে পারে দীর্ঘমেয়াদি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।