মন্টি বৈষ্ণব : পোশাকের কারণে কথা শুনতে হয়নি, সমাজে এমন নারীর সংখ্যা খুব কম। এক অর্থে বলা যায়, খুঁজে পাওয়া কঠিন বটে। নারীর পোশাক ও কটু মন্তব্য একে অপরের সঙ্গে জড়িত। সমাজের তথাকথিত পুরুষেরা আর কিছু পারুক আর না পারুক, চলার পথে নারীকে নিয়ে কটু মন্তব্য বুক ফুলিয়ে করতে পারেন। এই ধরনের কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে এক ধরনের অহংবোধ কাজ করে। অহংবোধটা কেমন? সেটা হলো, রাস্তা দিয়ে বা বাসে নারী-পুরুষ উভয়েই যে যার মতো করে যাচ্ছেন। হঠাৎ একজন পুরুষ অতি আগ্রহী হয়ে কোনো না কোনো নারীকে কেন্দ্র করে অবান্তর আলাপ শুরু করে দেন। এসব অবান্তর আলাপের প্রায় সময় বিষয়বস্তু থাকে নারীর পোশাক নিয়ে।
সেই আলাপ এক পর্যায়ে অশ্লীল পর্যায়ে পৌঁছায়। সমাজের কিছু পুরুষ কোনো কালেই এই ধরনের আলাপ থেকে দূরে থাকতে পারেন না। এ কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে এক ধরনের দম্ভ কাজ করে। দম্ভটা হলো, তারা পুরুষ জাতির প্রতিনিধিত্ব করছেন। তাই নারীকে যখন যা খুশি তাই বলার অধিকার রাখেন। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, দেশের আনাচে-কানাচে অহরহ এই ধরনের ঘটনা ঘটছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, ঘটনা যখন ঘটে তখন আশপাশে উপস্থিত থাকা ভদ্রস্থ মানুষেরা হাত গুটিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে চুপচাপ দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য অবলোকন করেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ স্বরূপ একটা শব্দও তাদের মুখ থেকে বের করেন না। এই আমাদের সমাজের চিরাচরিত দৃশ্য।
নারীদের পোশাক নিয়ে এমনই এক ঘটনা গত ১৭ এপ্রিল উত্তরার উত্তর মেট্রোরেল স্টেশনে ঘটে। সেদিন সাবিনা ইয়াসমিন মাধবী নামে একজন উদ্যোক্তা প্রতিদিনের মতো বাসা থেকে শোরুমের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। পথে তাঁর পাশ দিয়ে একজন বয়স্ক ব্যক্তি সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। একপর্যায়ে বয়স্ক ব্যক্তিটি মাধবীকে বাড়ি কোথায় জানতে চাওয়ার পর তাঁর পোশাক নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য করেন।
সেদিন কী ঘটেছিল জানতে চাইলে মাধবী বলেন, ‘আমি সেদিন দুপুরে বাসা থেকে শোরুমের দিকে যাচ্ছিলাম। পথের মধ্যে এক বয়স্ক মানুষ আমার বাড়ি কোথায় জানতে চান। তিনি এই বিষয়টা কিছুটা রাগের স্বরে জানতে চান। তাই আমি অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, আমার বাড়ি কোথায় জেনে আপনি কী করবেন? তিনি তখন বলেন, ‘‘তোমার লেবাস ভালো না।’’ এই কথা শুনে আমার মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়। আমি তাঁর কাছে এ কথা কেন বলেছেন, তা জানতে চাইলে তিনি আমার সঙ্গে তর্ক–বিতর্ক শুরু করে দেন এবং আমাকে “বেয়াদব মেয়ে” বলেন। সেদিন আমার পাশ দিয়ে অনেকেই হেঁটে যান। তারা বারবার আমাকে বলেন, “বাদ দেন আপা বেশি তর্ক করার দরকার নেই।” কিন্তু আমি বয়স্ক মানুষটির কথার প্রতিবাদ করেছিলাম।’
মাধবী একজন নারী উদ্যোক্তা। খুব অল্প সময়েই তিনি একজন পরিশ্রমী নারী উদ্যোক্তা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। ২০১৭ সালে তিনি ‘মাধবী মার্ট’ এর যাত্রা শুরু করেন। মাধবী মার্টের সিগনেচার পণ্য নকশীকাঁথা। গত ৭ বছর ধরে ক্রেতারা নকশীকাঁথার জন্য মাধবীকে চেনেন। তিনি ‘মাধবী মার্ট’ এর লভ্যাংশ দিয়ে নারীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সচেতনতামূলক কাজও করেন। তিনি মূলত জরায়ু ক্যানসার ও ব্রেস্ট ক্যানসার নিয়ে কাজ করছেন।
আমাদের সমাজব্যবস্থা এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে, যেখানে নারীরা কোথাও নিরাপদ নন। রাস্তাঘাটে প্রায়ই নারীদের পোশাক কিংবা গায়ের রং নিয়ে কটু কথা শুনতে হয়। এসব তো এক প্রকারের অনধিকার চর্চা। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের পোশাক তার গায়ের রং নিয়ে কথা বলতে পারেন না। আমরা কি আমাদের বেড়ে ওঠার পরিবেশ থেকে এই শিক্ষা পেয়েছি? এই প্রশ্নের উত্তর যদি ‘না’ হয়ে থাকে, তবে কেন নারীরা রাস্তাঘাটে হয়রানির মুখোমুখি হচ্ছেন?
নারী উত্ত্যক্তকরণ বলতে মূলত কোনো নারী বা কিশোরীকে তার স্বাভাবিক চলাফেরা বা কাজকর্ম করা অবস্থায় অশালীন মন্তব্য করাকে বোঝায়। উত্তরায় বয়স্ক ব্যক্তিটি মাধবীর সঙ্গে যা করেছেন, তা মূলত নারী উত্ত্যক্তকরণের পর্যায়ে পড়ে। যা ইদানীং পথে ঘাটে অনেক বেশি চোখে পড়ে। উত্ত্যক্তকরণ এই সময়ে অনেক বড় আকারের ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আগে এমন একটা সময় ছিল, যখন সমাজের বখে যাওয়া ছেলেরা নারীদের উত্ত্যক্ত করত। কিন্তু এখন বখাটের পাশাপাশি উঠতি বয়সের তরুণ, বয়স্করাও নারী উত্ত্যক্তকরণের কাজে যুক্ত হচ্ছেন। এর পেছনে মূল কারণ সমাজের অবক্ষয়। যে অবক্ষয়ের কারণে কোনটি আমাদের চর্চা আর কোনটি অনধিকার চর্চা তা ভুলে যাচ্ছি। উত্তরার ঘটনার সে রকমের ইঙ্গিত দেয়।
উত্তরার ঘটনায় একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সেটা হলো, পোশাক নিয়ে কেন নারীকে বারবার হেনস্তার শিকার হতে হয়। পুরুষের পোশাক নিয়ে নারীরা তো তেমন কিছু বলেন না। কে কোন পোশাক পরবে, সে হোক নারী কিংবা পুরুষ। তা ব্যক্তির পছন্দ আর স্বাচ্ছন্দ্যের ওপর নির্ভর করে। এ ক্ষেত্রে কারোর উল্টোপাল্টা মন্তব্য করা তো অনুচিত। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, নারীর প্রতি এই আচরণ কি যুগ যুগ ধরে চলবে?
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদন (জানুয়ারি- মার্চ) থেকে জানা যায়, গত তিন মাসে যৌন হয়রানি কেন্দ্রিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৫৫ জন নারী। এ ছাড়া বখাটেদের কর্তৃক লাঞ্ছিত হয়েছেন ৪৫ জন, বখাটেদের উৎপাতকে কেন্দ্র করে সংঘাতে আহত হয়েছেন ২৬ জন। এ ছাড়া যৌন হয়রানির কারণে ১ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। অন্যদিকে, যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটে কর্তৃক ৪ জন পুরুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।
দিনশেষে আমরা আসলে মানবিক মানুষ হতে পারছি না। পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাটুকু আমরা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি। সবচেয়ে দুঃখের বিষয় ছিল মাধবী যখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনা লিখে প্রকাশ করেন, সেই স্ট্যাটাসের মন্তব্য ঘরে দেখা গেছে আজেবাজে, নোংরা কিছু মন্তব্য। সেসব মন্তব্যের বেশির ভাগ ছিল বয়স্ক ব্যাক্তিটিকে প্রশংসার বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়ার। এসব মন্তব্য এই সমাজকে প্রতিনিধিত্ব করে। এই ধরনের অবান্তর মন্তব্য দেখে মনে হয়, সমাজ মনস্তত্ত্বের পচন ঘটেছে। এর প্রমাণ হিসেবে ওপরে দেওয়া নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই চলবে, যার কোনো প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এই সমাজ করছে না। প্রতিটি মানুষ নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। নারীর পোশাক নিয়ে এই সমাজের পুরুষেরা যতটা চিন্তিত, তার কিছুমাত্র যদি এই অপরাধগুলোর বিরুদ্ধে হতো, তবে হয়তো অন্য রকম এক দেশ হতো আমাদের। মনস্তাত্ত্বিক এই পচন রোধ করতে চাইলে সমাজের আমূল পরিবর্তন দরকার। মাধবী এই ঘটনায় তুরাগ থানায় জিডি করেছেন। এই ঘটনার তদন্ত করছে ডিবি। আশা করি, মাধবীর ক্ষেত্রেও বিচারহীনতার সংস্কৃতি কাজ করবে না। তিনি সঠিক বিচার পাবেন, যাতে পরে আর কোনো নারীকে উত্তরার ঘটনার মতো উত্ত্যক্তকরণের শিকার হতে না হয়।
লেখক: সহসম্পাদক, ডিজিটাল বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট টেলিভিশন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।