বৃষ্টির ফোঁটার শব্দে চমকে উঠলেন রেহানা আপা। কুড়িগ্রামের বাসিন্দা, বর্ষা মানেই তার জন্য আতঙ্কের নতুন নাম। গত বছর বন্যায় হারিয়েছিলেন সংসারের সঞ্চয়, ছোট ছেলেটির স্কুলের বই। পাশের বাড়ির শফিক ভাই কিন্তু এবার অন্য রকম। তার বাড়ির উঠানে মজুদ আছে শুকনো খাবার, ওষুধপত্র, জরুরি নথির জলরোধী ব্যাগ। ঘূর্ণিঝড় সিত্রার পূর্বাভাস আসতেই তিনি পরিবারকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে চলে গিয়েছিলেন। এই পার্থক্যটাই তৈরি করে দেয় জীবন-মরণের ব্যবধান। প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি শুধু সরকারি নির্দেশিকা নয়, এটি প্রতিটি পরিবারের জন্য আত্মরক্ষার অপরিহার্য কৌশল। জলবায়ু পরিবর্তনের এই যুগে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে এই সচেতনতা এখন বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি: কেন এত জরুরি? (বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে)
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর একটি। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, নদীভাঙন – এগুলো আমাদের নিত্যসঙ্গী। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের (ডিএমএম) তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র ২০২০-২০২৩ সালেই দেশে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হেনেছে ১৫টিরও বেশি বার, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে কয়েক কোটি মানুষের জীবনে। বিশ্বব্যাংকের একটি প্রতিবেদন (২০২৩) ইঙ্গিত দেয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে দুর্যোগের তীব্রতা ও ফ্রিকোয়েন্সি বাড়বে। এখানে প্রস্তুতি শুধু সম্পদ বাঁচায় না, মূল্যবান জীবন রক্ষা করে। একটি সঠিক পরিবারের সুরক্ষা গাইড অনুসরণ করে আপনি পারেন:
- জীবনহানি রোধ করা: সময়মতো সতর্কতা ও সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা প্রাণ বাঁচায়।
- আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি কমানো: ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, ফসল ও মূল্যবান দলিলপত্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
- মানসিক আঘাত প্রশমিত করা: পূর্বপ্রস্তুতি দুর্যোগ-পরবর্তী মানসিক চাপ ও ট্রমা কমাতে সাহায্য করে।
- পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা: প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম ও নথি হাতে থাকলে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সহজ হয়।
বাস্তব উদাহরণ: ২০২০ সালের সুপার সাইক্লোন আম্পান আঘাত হানার আগে খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটের উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপকভাবে মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। ডিএমএম, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি (বিডিআরসিএস) এবং স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বিত প্রচেষ্টা ও জনসচেতনতার ফলে প্রাণহানির সংখ্যা আশঙ্কার চেয়ে অনেক কম ছিল। এটি প্রমাণ করে, প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি এবং সময়মতো পদক্ষেপ কতটা কার্যকরী।
আপনার পরিবারের জন্য সুরক্ষা গাইড: ধাপে ধাপে প্রস্তুতি (বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা)
একটি কার্যকর পরিবারের সুরক্ষা গাইড তৈরির জন্য এই ধাপগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ:
১. ঝুঁকি চিহ্নিতকরণ ও তথ্য সংগ্রহ (Know Your Risk)
- আপনার এলাকার ঝুঁকি বুঝুন: আপনি কোন ধরনের দুর্যোগের (বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, ভূমিকম্প, নদীভাঙন ইত্যাদি) সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন? স্থানীয় সরকার অফিস, ইউনিয়ন পরিষদ বা ডিএমএম এর ওয়েবসাইট (https://dmm.gov.bd/) থেকে নির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করুন।
- দুর্যোগের পূর্বাভাসের উৎস চিহ্নিত করুন:
- বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (BMD): (https://bmd.gov.bd/) – ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, তাপপ্রবাহের পূর্বাভাসের প্রধান উৎস।
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর (DMM): (https://dmm.gov.bd/) – সতর্কতা সংকেত, নির্দেশনা ও আশ্রয়কেন্দ্রের তথ্য।
- স্থানীয় প্রশাসন: ইউএনও অফিস, ইউপি চেয়ারম্যান অফিস – সরাসরি নির্দেশনা ও সহায়তার জন্য।
- বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন: জরুরি সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণা প্রচার করে।
- সাম্প্রতিক তথ্য: আবহাওয়া অধিদপ্তর সম্প্রতি (২০২৪) তাদের পূর্বাভাস সক্ষমতা বাড়িয়েছে, বিশেষ করে স্বল্পমেয়াদী বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে। তাদের মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েবসাইট নিয়মিত চেক করুন।
২. পারিবারিক দুর্যোগ পরিকল্পনা তৈরি করুন (Make a Plan)
একটি লিখিত পরিকল্পনা সবাইকে একই পৃষ্ঠায় নিয়ে আসে। আলোচনা করুন এবং লিখে রাখুন:
- যোগাযোগের পরিকল্পনা:
- জরুরি যোগাযোগ নম্বরের তালিকা: পরিবারের সদস্যদের মোবাইল নম্বর, নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী, স্থানীয় থানা/হাসপাতাল/আশ্রয়কেন্দ্রের নম্বর। নিশ্চিত করুন সবাই এই তালিকা জানে এবং ফোনে সেভ করে রেখেছে।
- মিটিং পয়েন্ট নির্ধারণ: দুর্যোগে পরিবারের সদস্যরা যদি আলাদা হয়ে পড়ে, কোথায় মিলিত হবে? (১) বাড়ির কাছাকাছি নিরাপদ স্থান (উঁচু ভূমি, শক্তিশালী স্থাপনা), (২) আশ্রয়কেন্দ্র, (৩) এলাকার বাইরে কোন আত্মীয়ের বাড়ি)।
- আউট-অফ-এরিয়া যোগাযোগ ব্যক্তি: এমন একজন আত্মীয় বা বন্ধুর নাম ও নম্বর যিনি এলাকার বাইরে থাকেন। দুর্যোগে স্থানীয় নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হলে তার কাছ দিয়ে সবাই একে অপরের খবর পাঠাতে পারে।
- নিরাপদ আশ্রয় ও সরিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা:
- নিকটতম আশ্রয়কেন্দ্র চিহ্নিত করুন: কোথায়, কীভাবে যাবেন? রাস্তা চিনে রাখুন। (ডিএমএম ওয়েবসাইট বা স্থানীয় ইউপি অফিসে আশ্রয়কেন্দ্রের তালিকা পাওয়া যায়)।
- পরিবহনের বিকল্প: নিজের গাড়ি, রিকশা, ভ্যান, নৌকা – কোনটি কী পরিস্থিতিতে ব্যবহার করবেন? জ্বালানি মজুদ আছে কি?
- বিশেষ চাহিদা: পরিবারে শিশু, গর্ভবতী নারী, প্রবীণ, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা দীর্ঘমেয়াদি রোগী থাকলে তাদের নিরাপদ সরিয়ে নেওয়ার বিশেষ ব্যবস্থা কী?
- পোষা প্রাণীর যত্ন: আশ্রয়কেন্দ্রে সাধারণত পোষা প্রাণী নেওয়া যায় না। তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার বা আশ্রয় দেওয়ার ব্যবস্থা আগে থেকে করুন।
গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ: প্রতি ৬ মাস অন্তর পারিবারিক সভা ডাকুন, পরিকল্পনাটি রিভিউ করুন এবং প্রয়োজনে আপডেট করুন। শিশুদেরও এই আলোচনায় অংশ নিতে দিন, তাদের বুঝিয়ে বলুন।
৩. জরুরি প্রস্তুতি কিট (ইমার্জেন্সি কিট) প্রস্তুত করুন (Build Your Kit)
আপনার পরিবারের চাহিদা অনুযায়ী এই কিট তৈরি করুন। মনে রাখবেন, এটি এমন জিনিসপত্রের সমাহার যা ছুটে যাওয়ার সময় বা দুর্যোগ-পরবর্তী ৭২ ঘন্টা পর্যন্ত আপনাকে টিকিয়ে রাখবে। কিটটি একটি সহজে বহনযোগ্য, জলরোধী ব্যাগ বা পাত্রে রাখুন এবং সবাই জানুন কোথায় রাখা আছে।
- জল ও খাবার (অন্তত ৩ দিনের জন্য):
- জল: প্রতি ব্যক্তির জন্য দিনে অন্তত ৪ লিটার (পান, রান্না, স্বাস্থ্যবিধি মিলিয়ে)। মিনারেল ওয়াটারের বোতল বা নিজে বিশুদ্ধ পানি সংরক্ষণ করুন। নিয়মিত পানি পরিবর্তন করুন।
- খাবার: নন-পেরিশেবল, সহজে রান্না করা যায় বা না করেই খাওয়া যায় এমন খাবার। যেমন: বিস্কুট, চাল, ডাল, শুকনো খাবার (চিড়া, মুড়ি, খই), ক্যানড ফুড (মাছ, মাংস, সবজি), শুকনো ফল, চিনি, লবণ, শুকনো দুধ/পাউডার দুধ, চকলেট বা এনার্জি বার। শিশু থাকলে তার জন্য বিশেষ খাবার (ফর্মুলা, বেবি ফুড)। ক্যান ওপেনার ভুলবেন না!
- প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জাম (ফার্স্ট এইড কিট):
- জীবাণুমুক্ত গজ, ব্যান্ডেজ (বিভিন্ন সাইজ), কাঁচি, পিন, চিমটি।
- প্যারাসিটামল, অ্যান্টিহিস্টামিন, ডায়রিয়ার ওষুধ (ওআরএস), অ্যান্টাসিড, চামড়ার ফাঙ্গাল ক্রিম, এন্টিসেপটিক ক্রিম/লোশন (স্যাভলন, ডেটল)।
- থার্মোমিটার, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান।
- পরিবারের সদস্যদের জন্য নিয়মিত খাওয়ার প্রেসক্রিপশনের ওষুধ (অন্তত ১ সপ্তাহের মজুদ)।
- জরুরি সরঞ্জাম ও জিনিসপত্র:
- আলোর উৎস: টর্চলাইট (এক্সট্রা ব্যাটারিসহ), ক্যান্ডেল, দেশলাই/লাইটার। সৌরচালিত বা হ্যান্ড-ক্র্যাঙ্ক টর্চলাইট খুব কার্যকরী।
- যোগাযোগ: হ্যান্ড-ক্র্যাঙ্ক বা সোলার পাওয়ারড রেডিও (বাংলাদেশ বেতারের ফ্রিকোয়েন্সি সেট করে রাখুন)। পাওয়ার ব্যাংক (ফুল চার্জড রাখুন)।
- ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি: টুথব্রাশ-পেস্ট, স্যানিটারি ন্যাপকিন/ট্যাম্পন, টয়লেট পেপার, ওয়েট টিস্যু, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান, তোয়ালে। মাস্ক (N95/KN95 ভালো)।
- বহুমুখী সরঞ্জাম: সুইস আর্মি ছুরি বা বহুমুখী ছুরি, ডাক্ট টেপ, প্লাস্টিকের শিট, দড়ি, হুইসেল (সাহায্যের জন্য সংকেত দেওয়া)।
- গুরুত্বপূর্ণ নথির সুরক্ষিত কপি: জলরোধী ব্যাগে রাখুন – জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন, জমির দলিল, বীমা পলিসি, ব্যাংক একাউন্ট ডিটেইলস, চিকিৎসা রেকর্ড, পাসপোর্ট, বিবাহ সনদ, ছবিসহ পরিবারের সদস্যদের তালিকা। স্ক্যান করে ক্লাউডে বা পেনড্রাইভেও সংরক্ষণ করুন।
- নগদ টাকা: ছোট নোট ও কয়েন (টাকা ভাঙানোর জন্য), কিছু পরিমাণ জরুরি টাকা আলাদা করে রাখুন। এটিএম কাজ নাও করতে পারে।
- অন্যান্য: শিশু ও বৃদ্ধদের জন্য বিশেষ জিনিস (ডায়াপার, দুধের বোতল, চশমা, হিয়ারিং এইডের ব্যাটারি), স্থানীয় মানচিত্র, কাগজ-কলম, পোকামাকড় তাড়ানোর ক্রিম, ভারী দস্তানা, ছোট হাতুড়ি বা কুড়াল (ভাঙা দরজা/জানালায় পথ তৈরি করতে)।
- বাড়তি আইটেম (যদি সম্ভব হয়):
- টেন্ট বা তাবু, স্লিপিং ব্যাগ বা কম্বল (পানি প্রতিরোধী), ক্যাম্পিং স্টোভ ও জ্বালানি (বাড়ির বাইরে রান্নার জন্য), জল শোধন ট্যাবলেট বা ফিল্টার, ছোট শাবল।
গুরুত্বপূর্ণ টিপস: কিটটি বাড়ির সহজলভ্য স্থানে রাখুন (প্রস্থানের পথের কাছাকাছি)। শিশুরা যেন খেলতে না পারে। নিয়মিত (বছরে অন্তত দুবার) মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার, ওষুধ, ব্যাটারি চেক করুন ও পরিবর্তন করুন।
৪. বাড়ি ও সম্পত্তি সুরক্ষা (Protect Your Home)
দুর্যোগ আসার আগেই কিছু পদক্ষেপ সম্পদ রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখে:
- ঘূর্ণিঝড়/জলোচ্ছ্বাসের জন্য:
- জানালা ও দরজায় শক্তিশালী শাটার বা সাইক্লোন বোর্ড লাগান। না থাকলে পুরু কাঠের তক্তা বা মোটা রশি দিয়ে শক্ত করে বেঁধে রাখার ব্যবস্থা করুন।
- ছাদে বা উঠানে ফেলে রাখা ভারী জিনিস (টব, ইটের স্তূপ) নিরাপদ স্থানে সরিয়ে ফেলুন, যেন বাতাসে উড়ে গিয়ে ক্ষতি না করে।
- গাছের ডালপালা ছাঁটাই করুন, বিশেষ করে বাড়ির কাছাকাছি দুর্বল ডাল যা ভেঙে পড়তে পারে।
- বন্যার জন্য:
- মূল্যবান আসবাবপত্র, ইলেকট্রনিক্স, দলিলপত্র বাড়ির উঁচু তাকে বা আলমারির উপরে তুলে রাখুন।
- বিদ্যুৎ বক্স, সেফটি সুইচ উঁচুতে স্থাপন করুন। বন্যার পানি আসার আগেই মেইন সুইচ অফ করে দিন।
- নর্দমা পরিষ্কার রাখুন যেন পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা ঠিক থাকে।
- বন্যাপ্রবণ এলাকায় বাড়ি উঁচু প্লিনথে নির্মাণের চেষ্টা করুন।
- ভূমিকম্পের জন্য:
- ভারী ফার্নিচার (আলমারি, র্যাক, টিভি স্ট্যান্ড) দেয়ালে বোল্ট দিয়ে শক্ত করে আটকান।
- সিলিং ফ্যান, লাইট ফিক্সচার মজবুতভাবে লাগানো আছে কিনা নিশ্চিত করুন।
- শোবার ঘরের বিছানার পাশে ভারী ফার্নিচার, জানালা বা ঝাড়বাতি না রাখার চেষ্টা করুন।
- ‘ড্রপ, কাভার, হোল্ড অন’ পদ্ধতি সবাইকে শেখান (ভূমিকম্পের সময় মেঝেতে শুয়ে পড়ুন, মজবুত ফার্নিচারের নিচে আশ্রয় নিন এবং ধরে থাকুন)।
৫. দুর্যোগ চলাকালীন করণীয় (During the Disaster)
- নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে নিয়মিত তথ্য নিন: বাংলাদেশ বেতার, টেলিভিশন বা ডিএমএম/বিএমডির অফিসিয়াল অ্যাপ/ওয়েবসাইট। গুজবে কান দেবেন না।
- সরকারি নির্দেশনা মেনে চলুন: সতর্কতা সংকেত, সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ বা আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান অক্ষরে অক্ষরে পালন করুন। “এবার তো কিছু হয়নি” এই মনোভাব বিপজ্জনক।
- জরুরি কিট হাতের কাছে রাখুন: প্রস্থান করতে হলে সাথে নিতে হবে।
- বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ নিরাপদে বন্ধ করুন: আগুনের ঝুঁকি কমাতে।
- নিরাপদ স্থানে অবস্থান করুন:
- ঘূর্ণিঝড়/জলোচ্ছ্বাস: শক্তিশালী কংক্রিটের আশ্রয়কেন্দ্রের অভ্যন্তরীণ কক্ষে। জানালা/দরজা থেকে দূরে থাকুন।
- বন্যা: বাড়ির সবচেয়ে উঁচু তলায় উঠুন। দ্রুত পানির স্রোতে পা বা গাড়ি চালিয়ে প্রবেশ করা থেকে বিরত থাকুন (মাত্র ১৫ সেন্টিমিটার চলমান পানিও মানুষকে ভাসিয়ে নিতে পারে!)।
- ভূমিকম্প: ভেতরে থাকলে “ড্রপ, কভার, হোল্ড অন”। বাইরে থাকলে খোলা জায়গায় সরে যান, বিল্ডিং, গাছ, বৈদ্যুতিক তার থেকে দূরে থাকুন।
- শান্ত থাকার চেষ্টা করুন: আতঙ্কিত হয়ে অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেবেন না। শিশুদের আশ্বস্ত করুন।
৬. দুর্যোগ-পরবর্তী করণীয় (After the Disaster)
- নিরাপত্তা নিশ্চিত করুন: কর্তৃপক্ষের “নিরাপদ” ঘোষণার আগে বাড়ি ফেরবেন না। ভাঙা বৈদ্যুতিক তার, ক্ষতিগ্রস্ত স্থাপনা, সাপ বা অন্যান্য বিপদের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন।
- জরুরি কিট ব্যবহার করুন: খাবার-পানি শেষ হয়ে গেলে, শুধুমাত্র নির্ভরযোগ্য উৎসের পানি পান করুন। সন্দেহ হলে ফুটিয়ে নিন বা শোধন ট্যাবলেট ব্যবহার করুন।
- আহতদের সাহায্য করুন: প্রাথমিক চিকিৎসা দিন। গুরুতর আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নিন।
- ক্ষয়ক্ষতি মূল্যায়ন ও নথিভুক্ত করুন: বাড়ি, সম্পত্তির ক্ষতির ছবি তোলুন। বীমা দাবির জন্য বা সরকারি সাহায্যের জন্য এটি প্রয়োজন হতে পারে।
- মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন নিন: দুর্যোগ পরবর্তী মানসিক চাপ, দুঃখ, উদ্বেগ স্বাভাবিক। পরিবার ও প্রতিবেশীদের সাথে কথা বলুন। প্রয়োজনে কাউন্সেলিং সেবা নিন। শিশুদের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিন।
- অন্যদের সাহায্য করুন: নিরাপদে থাকলে, প্রতিবেশী, বিশেষ করে বৃদ্ধ, প্রতিবন্ধী ও অসহায় মানুষদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিন। স্থানীয় ত্রাণ কার্যক্রমে অংশ নিন।
বিশেষ গুরুত্ব: শিশু ও প্রবীণদের সুরক্ষা: তাদের জন্য আলাদা করে প্রস্তুতি নিন। শিশুদের জরুরি কিটে প্রিয় খেলনা, বই, রং-পেনসিল রাখুন মানসিক চাপ কমাতে। প্রবীণদের চলাচল সহজ হয় এমন স্থানে রাখুন, তাদের ওষুধ ও চশমা হাতের কাছে রাখুন। তাদের আশ্বস্ত করুন এবং নির্দেশনা বারবার বুঝিয়ে বলুন।
সাম্প্রতিক উদ্যোগ ও সম্পদ: বাংলাদেশ সরকার ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান’ এর আওতায় দুর্যোগ সহনশীল অবকাঠামো ও প্রস্তুতি বাড়ানোর উপর জোর দিচ্ছে। ডিএমএম এর ‘স্ট্যান্ডিং অর্ডারস অন ডিজাস্টারস’ ডকুমেন্টটি তাদের ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়, যা বিভিন্ন দুর্যোগের জন্য করণীয় বিস্তারিত বলে। বিডিআরসিএস এর স্থানীয় ইউনিটগুলো প্রস্তুতি বিষয়ক প্রশিক্ষণ দেয়।
জেনে রাখুন (FAQs)
- প্রশ্ন: প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি হিসেবে জরুরি কিটে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কী কী?
- উত্তর: সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল বিশুদ্ধ পানি (প্রতি জনে দিনে ৪ লিটার, ৩ দিনের), নন-পেরিশেবল খাবার (চাল, ডাল, বিস্কুট, ক্যানড ফুড), টর্চলাইট (এক্সট্রা ব্যাটারি), ফার্স্ট এইড কিট, গুরুত্বপূর্ণ নথির জলরোধী কপি, নগদ টাকা, হ্যান্ড-ক্র্যাঙ্ক/সোলার রেডিও এবং পাওয়ার ব্যাংক। পরিবারের সদস্যদের নিয়মিত ওষুধও অপরিহার্য।
- প্রশ্ন: ঘূর্ণিঝড়ের সতর্ক সংকেত (১ থেকে ১০) দেখলে কী বুঝব? প্রস্তুতি নেব কখন?
- উত্তর: সংকেত ১-৩ (দূরবর্তী ঝড়, সম্ভাব্য বিপদ): সতর্ক থাকুন, সংবাদ শুনুন, কিট চেক করুন। সংকেত ৪ (আসন্ন বিপদ): উপকূলের নিম্নাঞ্চলে বাসিন্দারা প্রস্তুত থাকুন। সংকেত ৫-৬ (মহাবিপদ আশঙ্কা): দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে বা নিরাপদ স্থানে চলে যান। সংকেত ৭-১০ (মহাবিপদ): আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করুন, বাইরে বের হবেন না। ডিএমএম এর ওয়েবসাইটে সংকেতের বিস্তারিত ব্যাখ্যা আছে।
- প্রশ্ন: বন্যার পানি বাড়তে থাকলে বাড়িতেই থাকব, নাকি সরিয়ে নেব? কিভাবে সিদ্ধান্ত নেব?
- উত্তর: স্থানীয় প্রশাসন সরিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিলে অবশ্যই মানুন। নির্দেশনা না থাকলে নিরাপত্তার বিচারে সিদ্ধান্ত নিন। যদি আপনার বাড়ি খুব নিচু এলাকায় হয়, পানি দ্রুত বাড়ছে এবং আশ্রয়কেন্দ্র বা উঁচু স্থানে যাওয়ার নিরাপদ রাস্তা ও পরিবহন আছে, তাহলে আগেই চলে যাওয়া নিরাপদ। বাড়ি শক্তিশালী ও উঁচু হলে, এবং পানি ধীরে বাড়লে, বাড়ির উঁচু তলায় নিরাপদে থাকতে পারেন, তবে জরুরি কিট ও পানির মজুদ নিশ্চিত করুন।
- প্রশ্ন: দুর্যোগের সময় পোষা প্রাণীকে কিভাবে সুরক্ষা দেব? আশ্রয়কেন্দ্রে কি নিয়ে যাওয়া যাবে?
- উত্তর: বেশিরভাগ সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে পোষা প্রাণী নেওয়া নিষেধ (স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার কারণে)। অগ্রিম পরিকল্পনা করুন: নিকটাত্মীয় বা বন্ধুর বাড়ি যারা নিরাপদ এলাকায় আছে, তাদের সাথে কথা বলে রাখুন। কিছু প্রাইভেট পশু হাসপাতাল বা এনজিও জরুরি সময়ে আশ্রয় দিতে পারে – তাদের খোঁজ রাখুন। জরুরি কিটে পশুখাদ্য, পানি, ওষুধ, মুগি, খেলনা রাখুন। দুর্যোগের পূর্বাভাস পেলেই তাদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে দিন।
- প্রশ্ন: দুর্যোগের পরে বিশুদ্ধ পানি পাওয়া না গেলে কি করব?
- উত্তর: দূষিত পানি পান করা মারাত্মক রোগের কারণ। সম্ভব হলে বোতলজাত পানি কিনুন। না পেলে, পানি ফুটিয়ে নিন (উচ্চ তাপমাত্রায় কমপক্ষে ১ মিনিট টগবগ করে ফোটান, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে উঁচু এলাকায় হলে ৩ মিনিট)। জরুরি কিটে জল শোধন ট্যাবলেট (যেমন: পটাশ বা ক্লোরিন ট্যাবলেট) রাখুন এবং নির্দেশনা মেনে ব্যবহার করুন। পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ছেঁকে নিন। সৌর পানি শোধন পদ্ধতিও (SODIS) কার্যকরী হতে পারে।
- প্রশ্ন: দুর্যোগের সময় শিশুদের মানসিকভাবে কিভাবে সাপোর্ট দেব?
- উত্তর: তাদের ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। সত্যি কথা বলুন কিন্তু ভয়াবহ বিবরণ দেবেন না। আশ্বস্ত করুন যে আপনি তাদের রক্ষা করবেন। তাদের রুটিন বজায় রাখার চেষ্টা করুন (খেলা, গল্প বলা)। তাদের অনুভূতি প্রকাশ করতে দিন, কথা শুনুন। জরুরি কিটে তাদের প্রিয় জিনিস (খেলনা, বই, রং) রাখুন। নিজে শান্ত থাকার চেষ্টা করুন, আপনার আচরণ তাদের উপর প্রভাব ফেলে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রস্তুতি কোনও এককালীন কাজ নয়, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া, একটি জীবন রক্ষাকারী অভ্যাস। বাংলাদেশের মাটি ও মানুষ বারবার প্রমাণ করেছে তার সহনশীলতা। কিন্তু সেই সহনশীলতাকে সাফল্যে পরিণত করতে প্রয়োজন সচেতনতা, প্রস্তুতি এবং সম্মিলিত প্রচেষ্টা। প্রতিটি পরিবার যদি এই পরিবারের সুরক্ষা গাইড অনুসরণ করে নিজেদের দায়িত্ব নেয়, তাহলে দুর্যোগের আঘাত কখনোই আমাদের সাহস ও প্রস্তুতিকে ভাঙতে পারবে না। আজই বসে পড়ুন আপনার পরিবার নিয়ে। ঝুঁকি বুঝুন, পরিকল্পনা করুন, জরুরি কিট গুছিয়ে রাখুন, আশ্রয়কেন্দ্রের পথ চিনে রাখুন। কারণ, আগামীকালের নিরাপত্তা গড়ে ওঠে আজকের এই সচেতন পদক্ষেপের মধ্য দিয়েই। আপনার প্রস্তুতিই হতে পারে প্রিয়জনের জীবন বাঁচানোর সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। শুরু করুন এখনই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।