জুমবাংলা ডেস্ক : চুয়াল্লিশ বছর আগে ধানমন্ডির বাসভবনে দুইমেয়ে বাদে সপরিবারে নিহত হন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা তখন বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। এ নিয়ে পরমানু বিজ্ঞানী ড: এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া লিখেছিলেন কিভাবে কখন স্ত্রী শেখ হাসিনা ও শ্যালিকা শেখ রেহানা পিতা, মাতা আর ভাইদের মৃত্যুর খবর পেয়েছিলেন। বিবিসি বাংলা
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছিলো শুক্রবার। বেলজিয়ামে তখনকার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের স্ত্রীর ডাকে ভোর ৬টার দিকে ওয়াজেদ মিয়ার ঘুম ভাঙ্গে। কারণ জার্মানির বন থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী তাঁর সঙ্গে টেলিফোনে জরুরী কথা বলতে চান। মি: চৌধুরীর সাথে কথা বলার জন্য ওয়াজেদ মিয়া তখন স্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাঠান। এর দুই-এক মিনিট পর শেখ হাসিনা ফিরে এসে স্বামী ওয়াজেদ মিয়ারকে জানান, রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চান। ওয়াজেদ মিয়া বলেন, ওই সময় শেখ হাসিনাকে ভীষণ চিন্তিত এবং উৎকণ্ঠিত দেখাচ্ছিলো। ওই টেলিফোন ধরার জন্য ওয়াজেদ মিয়া দ্রুত নিচে নামেন। নিচে নেমে দেখেন সানাউল হক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় মাথা নিচু করে পায়চারি করছেন।
ফোনের রিসিভার কানে ধরতেই রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তাঁকে বলেন, আজ ভোরে বাংলাদেশে ক্যু হয়েছে। রেহানা ও হাসিনাকে এ কথা জানাবেন না। আপনারাও প্যারিস যাবেন না। আপনারা এক্ষুনি আমার এখানে (বনে) চলে আসুন। টেলিফোনে কথা বলে ওয়াজেদ মিয়া বাসার উপরে গেলে শেখ হাসিনা অশ্রুজড়িত কণ্ঠে জানতে চান রশিদ চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর কী কথা হয়েছে। ওয়াজেদ মিয়া তখন স্ত্রীকে জানান, রাষ্ট্রদূত চৌধুরী প্যারিস যাত্রা বাতিল করে সেদিনই জার্মানির বনে ফিরে যেতে বলেছেন। এ কথা শুনে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দুজনই কাঁদতে কাঁদতে বলেন, নিশ্চয়ই কোন দুঃসংবাদ আছে। যা ওয়াজেদ মিয়া তাদেরকে বলতে চাইছেন না। তখন শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বলেন, প্যারিসের যাত্রা বাতিল করার কারণ পরিষ্কারভাবে না বললে তাঁরা এ বাসা ছেড়ে কোথাও যাবেন না। বাধ্য হয়েই ওয়াজেদ মিয়া তখন বলেন, বাংলাদেশে কি একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটেছে যার জন্য প্যারিস যাওয়া যুক্তিসংগত হবে না। এ কথা শুনে তারা দু’বোন আবারও কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। দু বোনের কান্নায় তখন হাসিনার ছেলেমেয়েরও ঘুম ভেঙ্গে যায়।
এরপর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তাঁরা ব্রাসেলস ছেড়ে জার্মানীর বনের উদ্দেশ্য রওনা হন। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে তাঁরা রাষ্ট্রদূত চৌধুরীর বাসায় পৌঁছান। সেদিন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড: কামাল হোসেন যুগোশ্লাভিয়া সফর শেষে বাংলাদেশে ফেরার পথে ফ্রাঙ্কফুর্টে যাত্রাবিরতি করেন এবং রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীর বাসায়ওঠেন। কান্নায় ভেঙ্গে পড়া শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে ধরাধরি করে ড: কামাল হোসেন, রশিদ চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী বাসার ভেতর নিয়ে যান।
ওই সময় ড্রইং রুমে বসে ড: কামাল, রশিদ চৌধুরী ও ওয়াজেদ মিয়া উৎকণ্ঠিত অবস্থায় বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকাসহ অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করছিলেন। এরই এক ফাঁকে ওয়াজেদ মিয়া রশিদ চৌধুরীকে ঘরের বাইরে নিয়ে ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। তখন নিরাপদ স্থানে না পৌঁছানো পর্যন্ত শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানাকে কোন কিছু জানানো হবে না, এই শর্তে রাষ্ট্রদূত রশিদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে বলেন, বিবিসি-এর এক ভাষ্যানুসারে রাসেল ও বেগম মুজিব ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই। আবার ওই সময় ঢাকাস্থ ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত এক বিবরণীতে বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউই বেঁচে নেই। এ অবস্থায় মি: চৌধুরী মনে করেন, একমাত্র ভারতেই আশ্রয় নেয়াটা তাঁদের জন্য নিরাপদ।
১৬ই আগস্ট ড: কামাল লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রার জন্য বন বিমানবন্দরে যান। বিমানবন্দর থেকে বিদায় নেবার সময় ড: কামালের হাত ধরে ওয়াজেদ মিয়া বলেন, খন্দকার মোশতাক খুব সম্ভবত আপনাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রাখার চেষ্টা করবেন। অনুগ্রহ করে আমার কাছে ওয়াদা করুন, আপনি কোনও অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে আপোষ করে তাঁর মন্ত্রিপরিষদে যোগদান করবেন না।
তখন ড: কামাল বলেন, ড: ওয়াজেদ, প্রয়োজন হলে বিদেশেই মৃত্যুবরণ করতে রাজি আছি। কিন্তু কোন অবস্থাতেই খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে আপোষ করে আমি দেশে ফিরতে পারি না। ১৬ই অগাস্ট রাত ১১টার দিকে রাষ্ট্রদূত চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী ওয়াজেদ মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে যান। উদ্দেশ্য ওয়াজেদ মিয়াকে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া।
এরপর নির্ধারিত স্থানে ভারতীয় দূতাবাসের সেই কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর রশিদ চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী সেখান থেকে চলে যান। তখন দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়াকে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের বাসায় নিয়ে যান। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত হিসেবে জার্মানিতে তখন একজন মুসলমান সাংবাদিক কর্মরত ছিলেন। তাঁদের আলোচনার এক পর্যায়ে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ওয়াজেদ মিয়াকে বলেন, ভারত সরকারের কাছে তাঁরা ঠিক কী চান, সেটি লিখে দিতে। এ কথা বলে রাষ্ট্রদূত একটি সাদা কাগজ ও কলম এগিয়ে দেন ওয়াজেদ মিয়ার দিকে। সে কাগজে ওয়াজেদ মিয়া লিখেছিলেন, শ্যালিকা রেহানা, স্ত্রী হাসিনা, শিশু ছেলে জয় ও মেয়ে পুতুল এবং তাঁর নিজের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং প্রাণ রক্ষার জন্য ভারত সরকারের নিকট তাঁরা রাজনৈতিক আশ্রয়কামনা করেন। সেই সময়ে ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার হাতে কোনো টাকা ছিলো না। শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা মাত্র ২৫ ডলার নিয়ে দেশ থেকে এসেছেন। এ কথা শুনে রাষ্ট্রদূত চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে জিজ্ঞেস করেন, তাঁদের টাকা-পয়সা লাগবে কি-না। তখন শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে ওয়াজেদ মিয়া জানান, হাজার খানেক জার্মান মুদ্রা দিলেই তাঁরা চালিয়ে নিতে পারবেন।
১৮ই আগস্ট বন শহর থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে কার্লসরুয়ে শহরে যান ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। সেখানে ওয়াজেদ মিয়ার গবেষণা সংক্রান্ত কিছু কাগজ ও বই ছিলো। এ ছাড়া কিছু কাজ সম্পন্ন করার প্রয়োজনও ছিলো। ২৩শে আগস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়াকে টেলিফোনে জানান, ভারতীয় দূতাবাসের একজন ফার্স্ট সেক্রেটারি কার্লসরুয়েতে তাঁদের সঙ্গে দেখা করবেন। সেদিনই দুপুর ২টার দিকে ওই কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে দেখা করে বলেন, পরের দিন ২৪অগাস্ট সকাল ৯টায় তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৪শে আগস্ট ভারতীয় দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা তাঁদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তবে তাঁদের গন্তব্যের বিষয় সম্পূর্ণ গোপন রাখার পরামর্শ দেয়া হয়। তারপর এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে ২৫অগাস্ট সকাল সাড়ে ৮টার দিকে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান শেখ রেহানা, শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া এবং তাঁদের দুই সন্তান। কিন্তু বিমানবন্দরে নামার পর তাঁদের প্রায় ৪ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। এরপর দুপুরের দিকে ভারত সরকারের ২কর্মকর্তা তূাঁদেরকে বিমানবন্দর থেকে নয়াদিল্লির ডিফেন্স কলোনীর একটি বাসায় নিয়ে যান। ওই বাসাটিতে একটি ড্রইং-কাম-ডাইনিং এবং ২’টি শয়নকক্ষ ছিলো। এরপর ভারতের কর্মকর্তারা তাঁদের এ বাড়ির বাইরে না যাওয়া, সেখানকার কারো কাছে পরিচয় না দেয়া এবং দিল্লির কারো সাথে যোগাযোগ না রাখা এই ৩টি পরামর্শ দেন।
ওই সময়ে ভারতেও জরুরী অবস্থা চলছিলো। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোন খবরাখবর ভারতের পত্র-পত্রিকায় ছাপা হচ্ছিলো না। এজন্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলেন তাঁরা। এভাবে প্রায় দু’সপ্তাহ কেটে যায়। ইতোমধ্যে ভারত সরকারের একজন যুগ্ম-সচিব শেখ হাসিনা এবং ওয়াজেদ মিয়াকে জানান, তাদের একটি বিশেষ বাসায় নেয়া হবে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারের জন্য। সেদিন রাত ৮টায় ভারতীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে ওয়াজেদ মিয়া এবং শেখ হাসিনা ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় যান। এর প্রায় ১০মিনিট পর ইন্দিরা গান্ধী কক্ষে প্রবেশ করে শেখ হাসিনার পাশে বসেন। ইন্দিরা গান্ধী ওয়াজেদ মিয়ার কাছে জানতে চান, ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে তাঁরা অবগত কি-না। এর জবাবে ওয়াজেদ মিয়া রাষ্ট্রদূত চৌধুরীর বরাত দিয়ে ‘রয়টার্স’ পরিবেশিত এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত দুটো ভাষ্যের কথা উল্লেখ করেন। ইন্দিরা গান্ধী তখন সেখানে উপস্থিত এক কর্মকর্তাকে ১৫ আগস্টের ঘটনা সম্পর্কে সর্বশেষ তথ্য জানাতে বলেন। তখন ঐ কর্মকর্তা ইন্দিরা গান্ধীকে জানান, শেখ মুজিবুর রহমানের পরিবারের কেউ-ই বেঁচে নেই। ওই কথা শুনে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শেখ হাসিনা। ইন্দিরা গান্ধী তখন শেখ হাসিনাকে জড়িয়েধরে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করেন।
ইন্দিরা গান্ধী শেখ হাসিনাকে বলেন, তুমি যা হারিয়েছো, তা আর কোনভাবেই পূরণ করা যাবে না। তোমার একটি শিশু ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। এখন থেকে তোমার ছেলেকেই তোমার আব্বা এবং মেয়েকে তোমার মা হিসেবে ভাবতে হবে। এ ছাড়াও তোমার সঙ্গে ছোট বোন ও স্বামী রয়েছে। এখন তোমার ছেলে-মেয়ে ও বোনকে মানুষ করার ভার তোমাকেই নিতে হবে। অতএব, তোমার কোন অবস্থাতেই ভেঙ্গে পড়লে চলবে না।
সূত্র : বিবিসি বাংলা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।