রঞ্জু খন্দকার, বগুড়া থেকে : পূর্বে ক্ষীণকায় করতোয়া। অনেকটা খালের মতো হয়ে গেছে। বেশ কিছু স্থান বোধহয় ‘দীর্ঘলম্ফ’ দিয়েও পার হওয়া যাবে। তার পশ্চিম তীর ধরে কয়েক কিলোমিটারজুড়ে ক্ষয়ে যাওয়া ‘সুরক্ষা’ প্রাচীর। ভেতরে ধ্বংসাবশেষ– নানা স্থাপনা, দুর্গের। সেখানে নেই কোনো প্রজা; নেই রানি, রাজা।
এটি এক সময় বাংলার রাজধানী প্রতাপশালী পুন্ড্রনগরের বর্তমান অবস্থা। সম্প্রতি সেখানে দুর্গের প্রাচীর ধরে হাঁটতে গিয়ে ‘ঐতিহ্য’ ও বর্তমানের নানা চিত্র ভেসে ওঠে।
পুন্ড্রনগর বগুড়া শহর থেকে থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার উত্তরে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের পাশে। এটি এখন মহাস্থানগড় নামে পরিচিত। শিবগঞ্জ উপজেলার অন্তর্ভুক্ত।
মহাস্থানগড়ের বাসস্ট্যান্ড থেকে নেমে পশ্চিমে পড়বে হযরত শাহ সুলতান মাহমুদ বলখীর (রহ.) মাজার। প্রচলিত আছে, তিনি আফগানিস্তানের বলখ রাজ্যের রাজা ছিলেন। তিনি মাছের মতো দেখতে বিরাট আকারের নৌকায় করে করতোয়া পাড়ি দিয়ে এখানে আসেন বলে ‘মাহী সাওয়ার’ নামেও পরিচিত। তিনি এখানে অত্যাচারী রাজা পরশুরামকে পরাজিত করে ইসলাম কায়েম করেন।
মাজার থেকে বের হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমে ২ কিলোমিটার গেলে প্রাচীন স্থাপনা গোকুল মেধ পাওয়া যাবে। এটি বেহুলার বাসর ঘর নামেও পরিচিত।
গোকুল মেধ থেকে সরাসরি অথবা মাজারে ফেরত এসে উত্তরে গেলে এখানকার প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘরের দেখা মিলবে। এখানে মৌর্য, পাল ও সেন আমলের নানা নিদর্শন সংরক্ষণ করা আছে। এখানে ঢুকতে টিকিট লাগবে।
মহাস্থানগড় যাদুঘরের ঠিক পূর্বপাশেই গোবিন্দর ভিটা। এ ভিটা ঘেঁষে পূর্ব-উত্তর বরাবর বয়ে গেছে করতোয়া, যা লাফ দিয়ে পার হওয়ার অবস্থায়। অথচ ইতিহাস বলছে, ১৩ শতকেও এই নদী বর্তমান গঙ্গার তিনগুণ চওড়া ছিল।
গোবিন্দর ভিটা থেকে বের হয়ে পশ্চিম পাশে এসে আপনি উঠতে পারেন দুর্গপ্রাচীরে। এই প্রাচীর ধরে হেঁটে যেতে পারেন দক্ষিণ বরাবর।
প্রাচীরপথে আপনার চোখে পড়বে, ভেতরের ক্ষয়ে যাওয়া দুর্গ, যা একসময় লোকলস্করে পরিপূর্ণ ছিল। ইতিহাস জানাবে, প্রাচীন পুন্ড্রনগরের কেন্দ্রে অবস্থিত এই দুর্গ উপর থেকে দেখতে আয়তাকার ছিল। এটি উত্তর-দক্ষিণে ১ দশমিক ৫২৩ কিলোমিটার ও পূর্ব-পশ্চিমে ১ দশমিক ৩৭১ কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল। এর প্রতি পাশে উঁচু ও প্রশস্ত সুরক্ষা প্রাচীর ছিল। দুর্গের আয়তন প্রায় ১৮৫ হেক্টর।
এক ফাঁকে পূর্ব পাশে এসে আপনি বেড়িয়ে আসতে পারেন শীর্ণকায় করতোয়া-তীরে শীলাদেবির ঘাট। এ ঘাটের পাশে এখন শ্মশান স্থাপন করা হয়েছে।
আবার দুর্গপ্রাচীরে ফিরে ঢুকতে পারেন রাজা পরশুরামের প্রাসাদে। এই প্রাসদের পাশেই দেখতে পাবেন একটি কূপ, যার নামকরণ করা হয়েছে জীয়ৎকুণ্ড।
প্রচলিত আছে, এই কূপের পানি পান করিয়ে যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সুস্থ করতেন পরশুরাম। হযরত শাহ সুলতানের (রহ.) বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে একটি কাক এখানে গরুর মাংসের টুকরা ফেলে। এরপর থেকে কূপটি তার ক্যারিশমা হারায়।
ইতিহাসবিদেরা বলছেন, ১৮০৮ সাল থেকে মহাস্থানগড়ের প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানটি আবিষ্কারের পর থেকে এর বিভিন্ন স্থাপনা লোককথার বিভিন্ন কাহিনি অনুসারে নামকরণ করা হয়েছে। ইতিহাসের সঙ্গে এসব মেলানো যাবে না। তবে প্রাচীন বাংলার রাজধানী যে এই পুন্ড্রনগর ছিল, তা ঐতিহাসিক। এখানকার স্থাপনাগুলো সেই আমলের।
প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মনে করেন, মহাস্থানগড়ে শহর পত্তনের মূল কারণ এটি দেশের অন্যতম উঁচু অঞ্চল। এখানকার ভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১১৮ ফুট উঁচু, যেখানে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মাত্র ২০ ফুট উঁচু।
রাজধানী হিসেবে এই স্থানটি বেছে নেওয়ার আরেকটি কারণ হলো করতোয়া নদীর অবস্থান ও আকৃতি। ইতিহাস বলছে, করতোয়া ১৩ শতকে বর্তমান গঙ্গা নদীর তিনগুণ বেশি প্রশস্ত ছিল। এ ছাড়া মহাস্থানগড় বরেন্দ্র অঞ্চলের লাল মাটিতে অবস্থিত যা পলিগঠিত অঞ্চল হতে কিছুটা উঁচু। ১৫-২০ মিটার ওপরের অঞ্চলগুলোকে বন্যামুক্ত ভূপ্রাকৃতিক অঞ্চল বলে ধরা হয়।
প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদেরা বলছেন, ১৯২০ সাল পর্যন্ত খননকাজের আগেও মহাস্থানগড় দুর্গের উচ্চতা আশেপাশের অঞ্চলের চেয়ে ৪ মিটার বেশি ছিল। এর সুরক্ষাপ্রাচীরটি আশেপাশের অঞ্চলের চেয়ে ছিল ৩৬-৪৩ ফুট উঁচু।
প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস থেকে আবার বাস্তবে ফিরি, পড়ন্ত বিকেলে আমরা দুর্গপ্রাচীর বরাবর হেঁটে যাই। প্রাচীর এখন নেই বললেই চলে। এটি এখন পায়ে চলা উঁচু পথ। দুর্গের ভেতরে নেই লোকলস্কর, রাজা, রানি, প্রজা। তবে খ্রিষ্টীয় ১৫ শতকে পরিত্যক্ত এ নগরী এখন শুধুই ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের পছন্দের খননস্থান নয়; সার্কের সাংস্কৃতিক এ রাজধানী পর্যটকদেরও প্রিয় গন্তব্য।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।