রমজানের পবিত্রতা কেবল রোজা আর ইবাদতেই সীমাবদ্ধ নয়। এ মাসের অপার রহমত ও মাগফিরাতের অন্যতম সোপান হলো ফিতরা। নামাজের আগে অসহায়-দুঃস্থ মানুষের মধ্যে এই ফিতরা বণ্টন করা শুধু একটি বিধানই নয়; এটি সমাজের অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা, দারিদ্র্য দূরীকরণ এবং ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করার এক মহৎ প্রক্রিয়া। কিন্তু প্রতি বছর রমজান এলে প্রশ্ন জাগে – ফিতরা গণনার পদ্ধতি ঠিক কেমন? কাকে দেবেন? কত টাকা দেবেন? কীসের ভিত্তিতে হিসাব করবেন? এই বিভ্রান্তি দূর করতেই আজকের এই প্রয়াস – ফিতরা গণনার পদ্ধতি নিয়ে একটি পরিষ্কার, সহজবোধ্য ও শরিয়তসম্মত নির্দেশিকা।
ফিতরা কী ও কেন? ইসলামের সামাজিক নিরাপত্তা বলয়
ফিতরা, যাকে আরবিতে ‘সাদাকাতুল ফিতর’ বা বাংলায় ‘ফেতরা’ও বলা হয়, তা হলো রমজান মাসের রোজা শেষে ঈদের দিন সকাল বেলা (ঈদের নামাজের আগে) নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক প্রত্যেক মুসলমান নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধের পক্ষ থেকে গরিব-দুঃখী ও অভাবগ্রস্ত মানুষের মাঝে বিতরণের জন্য নির্ধারিত একটি বাধ্যতামূলক দান। হাদিস শরিফে এর গুরুত্ব অপরিসীম।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “রমজানের রোজা আসমান ও জমিনের মাঝে ঝুলন্ত থাকা অবস্থায় ফিতরা আদায় না করা পর্যন্ত তা (ওঠানো হয় না অর্থাৎ কবুল হয় না)।” (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ১৬০৯)। আরেক হাদিসে এসেছে, “রোজাদারের জন্য ফিতরা ঐ ব্যক্তির ন্যায়, যে অপরিচ্ছন্ন স্থানে পড়ে থাকা ময়লা অপসারণ করে।” (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস নং ১৮২৭)।
ফিতরার প্রধান উদ্দেশ্যগুলো হলো:
- রোজার ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণ: রমজানে অনিচ্ছাকৃত ভুলত্রুটি বা অশ্লীল কথাবার্তার কাফফারা স্বরূপ।
- গরিবের ঈদের আনন্দ নিশ্চিত করা: ঈদের দিন যেন অভাবী ব্যক্তিরাও প্রয়োজনীয় খাদ্য ক্রয় করে ঈদের আনন্দে শরিক হতে পারে।
- সামাজিক সম্প্রীতি ও সহমর্মিতা বৃদ্ধি: ধনী-গরিবের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন সুদৃঢ় করা।
- দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা: সমাজের সম্পদ পুনর্বণ্টনের একটি সুন্দর ব্যবস্থা।
ফিতরা কাদের উপর ফরজ? নিসাবের সহজ ব্যাখ্যা
ফিতরা দেওয়া ফরজ (বাধ্যতামূলক) প্রত্যেক সেই মুসলিম নারী-পুরুষের উপর, যিনি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক। নিসাব বলতে ইসলামি শরিয়ত দ্বারা নির্ধারিত একটি ন্যূনতম সম্পদ পরিমাণকে বোঝায়।
- নিসাবের পরিমাণ: বর্তমানে সাড়ে সাত ভরি (৭.৫ ভরি) সোনা অথবা সাড়ে বায়ান্ন ভরি (৫২.৫ ভরি) রূপা অথবা এগুলোর সমমূল্যের নগদ টাকা বা বাণিজ্যিক পণ্য কারো মালিকানায় থাকলে এবং ঋণমুক্ত থাকলে তিনি নিসাবের মালিক।
- যাদের উপর ফিতরা ফরজ:
- নিজের জন্য (প্রাপ্তবয়স্ক, বিবেকবান মুসলিম)।
- নিজের নাবালেগ (অপ্রাপ্তবয়স্ক) সন্তানদের জন্য।
- এমন স্ত্রীর জন্য, যিনি স্বামীর গৃহে বসবাস করেন এবং স্বামীরই ভরণপোষণে থাকেন।
- মহিলাদের ফিতরা: নিসাবের মালিকানা থাকলে প্রত্যেক নারীর জন্যই নিজের ফিতরা নিজে আদায় করা ফরজ। স্বামী স্ত্রীর ফিতরা দিলেও তা আদায় হয়ে যায়, তবে স্ত্রী নিজে দিতে পারলে সেটাই উত্তম।
- নাবালেগ সন্তান: পিতার সম্পদে নিসাব পূর্ণ হলে তিনি তার নাবালেগ সন্তানদের ফিতরা দেবেন। সন্তান নিজে নিসাবের মালিক হলে (উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া সম্পদ ইত্যাদি) তার সম্পদ থেকেই তার ফিতরা দিতে হবে।
- যাদের উপর ফরজ নয়: যে ব্যক্তি নিসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক নয়, তার উপর ফিতরা ফরজ নয়। তবে সাধ্যমত দান করলে সওয়াবের কাজ হবে।
গুরুত্বপূর্ণ নোট: ফিতরা দেওয়ার সময়কাল শুরু হয় রমজানের শেষের দিক থেকে (সাধারণত ২৬/২৭ রমজান থেকে) এবং ঈদের নামাজের আগেই আদায় করে ফেলা জরুরি। নামাজের পরে দিলে তা সাধারণ সদকার সওয়াব পাবে, কিন্তু ফিতরা হিসেবে আদায় হবে না। তাই সময়মতো আদায়ের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
ফিতরা গণনার পদ্ধতি: খাদ্যদ্রব্যের ভিত্তিতে সহজ হিসাব (২০২৪)
ফিতরা গণনার মূল ভিত্তি হলো নির্দিষ্ট পরিমাণ প্রধান খাদ্যদ্রব্য। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর যুগে ফিতরা আদায় হতো স্থানীয়ভাবে প্রচলিত প্রধান খাদ্যশস্য দিয়ে। হাদিসে সা (গম), যব (বার্লি), খেজুর ও কিশমিশের উল্লেখ আছে। বর্তমানে স্থান ও সময়ভেদে প্রধান খাদ্য ভিন্ন হতে পারে। বাংলাদেশে সাধারণত চাল বা গম অথবা তার নগদ মূল্য দ্বারা ফিতরা আদায় করা হয়।
ফিতরার পরিমাণ: ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী, ফিতরার ন্যূনতম পরিমাণ হলো এক সা’ (صاع) পরিমাণ খাদ্যশস্য।
- এক সা’ কী? এক সা’ হলো হাতের তালু দিয়ে মাপার একটি ঐতিহ্যবাহী পরিমাপ। আধুনিক হিসাবে এক সা’ প্রায় চার মুদ্দ (مُدّ) এর সমান।
- আধুনিক ওজন: ইসলামিক স্কলারদের ঐকমত্য অনুযায়ী, এক সা’ এর ওজন:
- গমের ক্ষেত্রে: প্রায় ২.১৭ কেজি (২ কেজি ১৭০ গ্রাম)।
- চাল, যব, খেজুর, কিশমিশ ইত্যাদির ক্ষেত্রে: প্রায় ৩.৩ কেজি (৩ কেজি ৩০০ গ্রাম)। (এটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য ও প্রযোজ্য পরিমাপ বাংলাদেশে)।
- সতর্কতা: কিছু কিছু ক্ষেত্রে গমের জন্য আলাদা হিসাব (২.৫ কেজির কাছাকাছি) থাকলেও, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ অধিকাংশ আলেম প্রধান খাদ্য হিসেবে চাল/গম/খেজুরের জন্য ৩.৩ কেজি নির্ধারণ করে থাকেন ফিতরা হিসাবের সুবিধার্থে এবং সতর্কতা অবলম্বনের জন্য।
ফিতরা গণনার ধাপ (চালের ভিত্তিতে – সর্বাধিক প্রচলিত):
- প্রতি ব্যক্তির জন্য ফিতরা: ৩.৩ কেজি চাল (বা স্থানীয় প্রধান খাদ্য)।
- চালের বাজারমূল্য নির্ধারণ: ঈদের আগেই (২৬/২৭ রমজান থেকে) স্থানীয় বাজারে প্রচলিত মধ্যম বা ভালো মানের (যা সাধারণ মানুষ খায়) চালের প্রতি কেজির মূল্য জেনে নিন। উদাহরণস্বরূপ, ধরা যাক ২০২৪ সালের রমজানে ভালো মানের চালের কেজি ৮০ টাকা।
- প্রতি ব্যক্তির ফিতরার নগদ মূল্য: ৩.৩ কেজি x প্রতি কেজির মূল্য (৮০ টাকা) = ২৬৪ টাকা।
বিকল্প পদ্ধতি (গমের ভিত্তিতে – কিছু এলাকায় প্রচলিত):
- প্রতি ব্যক্তির জন্য ফিতরা: ২.১৭ কেজি গম।
- গমের বাজারমূল্য নির্ধারণ: স্থানীয় বাজারে মধ্যম মানের গমের কেজি মূল্য (ধরা যাক ৫০ টাকা)।
- প্রতি ব্যক্তির ফিতরার নগদ মূল্য: ২.১৭ কেজি x প্রতি কেজির মূল্য (৫০ টাকা) = ১০৮.৫০ টাকা (প্রায় ১০৯ টাকা)।
ফিতরা দেওয়ার সময় নগদ টাকা দেওয়াই এখন সবচেয়ে সহজ, গ্রহণযোগ্য ও কার্যকর পদ্ধতি, যাতে গরিব ব্যক্তি তার সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে পারে।
বাংলাদেশে প্রচলিত ফিতরা গণনা: ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নির্দেশনা ও বর্তমান মূল্য
বাংলাদেশে ফিতরা গণনার পদ্ধতি এর জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও সর্বজনস্বীকৃত সূত্র হলো ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। প্রতি বছর রমজানের শেষ দিকে তারা দেশের বিভিন্ন বাজারে খাদ্যশস্যের মূল্য সমীক্ষা করে ফিতরার ন্যূনতম ও সর্বোচ্চ নগদ মূল্য ঘোষণা করে থাকে। এটি একটি গাইডলাইন মাত্র। মূলত ৩.৩ কেজি চালের মূল্যের ভিত্তিতেই এটি নির্ধারিত হয়।
- ২০২৪ সালের ফিতরা (ইসলামিক ফাউন্ডেশন ঘোষণা অনুযায়ী – উদাহরণস্বরূপ, প্রকৃত ঘোষণা অনুসরণ করুন): ইসলামিক ফাউন্ডেশন সাধারণত ন্যূনতম ও সর্বোচ্চ এই দুটি স্তর নির্ধারণ করে, যাতে লোকেরা সক্ষমতা অনুযায়ী দান করতে পারে।
- ন্যূনতম ফিতরা: সাধারণত মধ্যম মানের চালের মূল্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। (২০২৪ সালে ধরা যাক ঘোষিত ন্যূনতম ২৫০ টাকা)।
- সর্বোচ্চ ফিতরা: উন্নতমানের চালের মূল্যের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। (২০২৪ সালে ধরা যাক ঘোষিত সর্বোচ্চ ১৬৫০ টাকা)।
- কেন দুটি স্তর? সমাজে বিভিন্ন আর্থিক সক্ষমতার মানুষ আছেন। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী, ন্যূনতম থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ বা তার চেয়েও বেশি দান করতে পারেন। তবে ন্যূনতম পরিমাণটি আদায় করাই ফরজ দায়িত্ব। সক্ষম ব্যক্তি বেশি দিলে অধিক সওয়াবের অধিকারী হবেন।
- কোথায় পাওয়া যাবে: ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট (www.islamicfoundation.gov.bd) এবং তাদের প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতি বছর এর ঘোষণা দেওয়া হয়। জাতীয় দৈনিক পত্রিকাগুলোও এটি প্রকাশ করে।
গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ: নিজ এলাকার বাজারে যে চাল আপনি নিজে খান বা সাধারণ মানের চালের মূল্য দেখে, তার ভিত্তিতে ৩.৩ কেজির মূল্য হিসাব করাই উত্তম। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঘোষণা একটি সহজ গাইডলাইন মাত্র। যদি স্থানীয় বাজারে চালের দাম ইসলামিক ফাউন্ডেশনের নির্ধারিত ন্যূনতম মূল্যের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে স্থানীয় মূল্য অনুযায়ীই ফিতরা দিতে হবে, কারণ ফরজ পরিমাণ পৌঁছানো জরুরি।
ফিতরা কাকে দেবেন? যোগ্য গ্রহীতার পরিচয়
ফিতরা একটি বিশেষ ধরনের সদকা, তাই এর গ্রহীতাও বিশেষ শ্রেণির হওয়া উচিত। জাকাতের যোগ্য গ্রহীতারাই সাধারণত ফিতরারও যোগ্য। ফিতরা দেওয়ার ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত ব্যক্তিদের অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত:
- ফকির: যার সামান্য সম্পদ আছে, কিন্তু তা বছরের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।
- মিসকিন: সম্পদহীন, অভাবগ্রস্ত ব্যক্তি যিনি প্রয়োজনের তাগিদে মানুষের কাছে হাত পাতে। (সাধারণত ফকির ও মিসকিনই ফিতরার প্রধান গ্রহীতা)।
- জাকাত আদায়কারী কর্মী (আমিল): শরিয়তসম্মতভাবে জাকাত/ফিতরা সংগ্রহ ও বিতরণে নিয়োজিত ব্যক্তি (বর্তমানে এ ধারা প্রযোজ্য নয় বলেই মত রয়েছে)।
- নওমুসলিম: যাদের ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য প্রয়োজন হয়।
- দাসমুক্তির জন্য: বর্তমানে অপ্রাসঙ্গিক।
- ঋণগ্রস্ত ব্যক্তি: যে ব্যক্তি ঋণে জর্জরিত এবং তা পরিশোধ করতে অক্ষম।
- আল্লাহর পথে জিহাদকারী: আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সংগ্রামরত ব্যক্তি।
- মুসাফির: ভ্রমণরত অবস্থায় যার সম্পদ শেষ হয়ে গেছে, এমন ব্যক্তি।
ফিতরা দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা:
- নিজের নিকটাত্মীয়কে অগ্রাধিকার: প্রথমেই নিজের দরিদ্র আত্মীয়-স্বজন (যারা জাকাত/ফিতরা গ্রহণের যোগ্য), তারপর প্রতিবেশী, তারপর অন্যদের দেবেন। হাদিসে আত্মীয়তার হক রক্ষার বিশেষ তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
- সক্ষম ব্যক্তিকে নয়: যে নিজেই নিসাবের মালিক, তাকে ফিতরা দেওয়া যাবে না।
- সরাসরি গরিবকে দেওয়াই উত্তম: সম্ভব হলে সরাসরি গরিব-দুঃখীকে ফিতরা হাতে তুলে দিন। এতে আত্মীয়তা ও সহানুভূতি বাড়ে। সংগঠনের মাধ্যমে দিলে অবশ্যই বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠান বেছে নিন।
- এক ব্যক্তিকে একাধিক ফিতরা দেওয়া: একজন গরিব ব্যক্তি একাধিক ব্যক্তির ফিতরা গ্রহণ করতে পারে, যদি তার প্রয়োজন থাকে।
ফিতরা গণনার ভুল ধারণা ও সঠিক পদ্ধতি
ফিতরা গণনার পদ্ধতি নিয়ে কিছু প্রচলিত ভুল ধারণা রয়েছে, যা দূর করা জরুরি:
- “পরিবারের প্রধানই শুধু দেবেন”: ভুল। পরিবারের যাদের উপর ফিতরা ফরজ (নিজে, স্ত্রী, নাবালেগ সন্তান), তাদের প্রত্যেকের জন্য আলাদাভাবে ফিতরা দিতে হবে। পরিবারের প্রধান সাধারণত সবার পক্ষ থেকে আদায় করে থাকেন, কিন্তু প্রত্যেকের জন্য আলাদা হিসাবই সঠিক।
- “শুধু পুরুষদের দিতে হয়”: ভুল। নিসাবের মালিক নারীদের জন্যও ফিতরা দান করা ফরজ। তিনি নিজে দিতে পারেন অথবা তার পক্ষে স্বামী বা অন্য কেউ দিতে পারেন।
- “চাল দিলেই হবে, টাকা দেওয়া যাবে না”: ভুল। মূলত খাদ্যশস্য দিয়েই আদায় করা হতো। কিন্তু বর্তমানে নগদ টাকা দেওয়াই সর্বাধিক প্রচলিত, সহজ এবং গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। কারণ নগদ টাকা দিয়ে গরিব ব্যক্তি তার সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন মেটাতে পারে। অধিকাংশ ইসলামিক স্কলারই নগদ টাকায় ফিতরা আদায়কে জায়েজ বলেছেন।
- “ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঘোষিত টাকাই একমাত্র সঠিক”: ভুল। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঘোষণা একটি গাইডলাইন। স্থানীয় বাজারে যদি চালের মূল্য তাদের নির্ধারিত ন্যূনতমের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে স্থানীয় মূল্য অনুযায়ীই ফিতরা দিতে হবে, যাতে গরিব ব্যক্তির হাতে প্রকৃত ৩.৩ কেজি চালের সমমূল্য টাকা পৌঁছায়। সক্ষম ব্যক্তি সর্বোচ্চ সীমা বা তার চেয়েও বেশি দিতে পারেন।
- “ঈদের পরে দিলেও চলবে”: ভুল। ফিতরা আদায়ের সঠিক সময় হলো রমজানের শেষ দিক (২৬/২৭ রমজান) থেকে শুরু করে ঈদের নামাজের আগ পর্যন্ত। নামাজের পরে ফিতরা দিলে তা ফিতরা হিসেবে আদায় হবে না, সাধারণ সদকার সওয়াব পাবে। তাই সময়মতো আদায় করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজনে রমজানের শেষ দশকের শুরু থেকেই আদায় করে রাখা যায়।
ফিতরা দেওয়ার সর্বোত্তম পদ্ধতি: সওয়াব বৃদ্ধির উপায়
ফিতরা শুধু একটি ফরজ ইবাদতই নয়, এটি আল্লাহর নৈকট্য লাভেরও মাধ্যম। তাই এর আদায়ে কিছু আদব ও পদ্ধতি মেনে চললে এর সওয়াব বহুগুণে বৃদ্ধি পেতে পারে:
- নিয়ত ঠিক করা: কেবলমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য এবং তাঁর বিধান পালনের উদ্দেশ্যে ফিতরা আদায় করতে হবে। লোক দেখানো বা রিয়া (প্রদর্শনেচ্ছা) থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত থাকতে হবে।
- উত্তম খাদ্য/টাকা দেওয়া: নিজে যে মানের খাবার খান, তার চেয়ে কম মানের না দেওয়া উত্তম। নগদ টাকা দিলে এমন পরিমাণ দেওয়া যাতে গরিব ব্যক্তি ভালো মানের খাদ্য কিনতে পারে।
- গোপনে দেওয়া: সম্ভব হলে গোপনে দান করা উত্তম। আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা প্রকাশ্যে দান করলে তা ভালো, আর যদি গোপনে দান করো এবং অভাবগ্রস্তদের দাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম।” (সুরা আল-বাকারা, ২৭১)। তবে সংগঠনের মাধ্যমে দিলে বা সামাজিক উদ্যোগে অংশ নিলে তা ভিন্ন।
- সদাচরণ ও সদয় ব্যবহার: ফিতরা দেওয়ার সময় গ্রহীতার সাথে অত্যন্ত সম্মানজনক, সদয় ও ভদ্র আচরণ করা জরুরি। তার মনোবেদনা বা লজ্জা যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। হাসিমুখে ও আন্তরিকতার সাথে দান করুন।
- প্রতিবেশী ও আত্মীয়ের খোঁজ নেওয়া: প্রথমে নিজের দরিদ্র প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনের খোঁজখবর নিন। তাদের মধ্যে যারা যোগ্য, তাদের অগ্রাধিকার দিন। এতে আত্মীয়তার বন্ধন সুদৃঢ় হয়।
- বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেওয়া: সরাসরি দেওয়া সম্ভব না হলে, কোনো বিশ্বস্ত ও সুপরিচিত ইসলামিক সংগঠন বা মসজিদ কমিটির মাধ্যমে ফিতরা আদায় করুন। প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুন। (ইসলামিক রিলিফ বাংলাদেশের বা বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির মতো প্রতিষ্ঠানগুলো গরিবদের মাঝে সাহায্য পৌঁছে দেয়)।
জেনে রাখুন (FAQs)
জেনে রাখুন
প্রশ্ন: ফিতরা কী শুধু পরিবারের প্রধানকেই দিতে হয়?
- উত্তর: না। ফিতরা পরিবারের প্রত্যেক নিসাবপ্রাপ্ত সদস্যের জন্য আলাদাভাবে ফরজ। পরিবারের প্রধান (সাধারণত পিতা/স্বামী) নিজের পাশাপাশি তার স্ত্রী এবং নাবালেগ সন্তানদের পক্ষ থেকেও ফিতরা আদায় করেন। তবে নাবালেগ সন্তান নিজে যদি নিসাবের মালিক হয়, তবে তার নিজের সম্পদ থেকেই তার ফিতরা দিতে হবে। নারী নিজে নিসাবের মালিক হলে তার নিজের ফিতরা নিজে দেবেন বা কাউকে দিয়ে দিতে পারেন।
প্রশ্ন: ঈদের নামাজের পরে ফিতরা দিলে কী হবে?
- উত্তর: ফিতরা আদায়ের নির্দিষ্ট সময় হলো রমজানের শেষ দিক (২৬/২৭ রমজান) থেকে ঈদের নামাজের আগ পর্যন্ত। নামাজের পরে ফিতরা দিলে তা ফিতরা হিসেবে আদায় হবে না, বরং তা একটি সাধারণ নফল সদকা হিসেবে গণ্য হবে এবং এর সওয়াব ফিতরার সওয়াবের সমান হবে না। তাই সময়মতো আদায় করা অত্যন্ত জরুরি। সম্ভব হলে রমজানের শেষ দশকের শুরুতেই আদায় করে ফেলা ভালো।
প্রশ্ন: ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ঘোষিত মূল্যের চেয়ে স্থানীয় বাজারে চালের দাম বেশি হলে কী করব?
- উত্তর: ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মূল্য একটি গাইডলাইন মাত্র। ফিতরার প্রকৃত পরিমাণ নির্ভর করে স্থানীয় বাজারে প্রচলিত প্রধান খাদ্য (সাধারণত চাল) এর মূল্যের উপর। যদি স্থানীয় বাজারে চালের দাম ফাউন্ডেশনের নির্ধারিত ন্যূনতম মূল্যের চেয়ে বেশি হয়, তাহলে আপনাকে অবশ্যই স্থানীয় বাজারমূল্য অনুযায়ী ৩.৩ কেজি চালের সমমূল্য টাকা ফিতরা হিসেবে দিতে হবে। ফরজ পরিমাণ পূর্ণ করার জন্য এটি আবশ্যক। ফাউন্ডেশনের মূল্য কেবল একটি ন্যূনতম পরামর্শ।
প্রশ্ন: নগদ টাকার বদলে সরাসরি চাল/গম দিয়ে ফিতরা আদায় করব কি?
- উত্তর: হ্যাঁ, নগদ টাকা বা খাদ্যশস্য উভয় পদ্ধতিতেই ফিতরা আদায় করা যায় এবং উভয়ই শরিয়তসম্মত। রাসূল (সা.)-এর যুগে খাদ্যশস্য দিয়েই আদায় করা হতো। তবে বর্তমানে নগদ টাকা দেওয়াই অধিকতর সহজ, ব্যবহারিক ও প্রয়োজনভিত্তিক। কারণ গরিব ব্যক্তি নগদ টাকা পেলে তার সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন (চাল, ডাল, তেল, ঔষধ, সন্তানের বই ইত্যাদি) মেটাতে পারে। অনেক স্কলার নগদ টাকায় ফিতরা দিতেই অধিকতর পছন্দ করেন।
প্রশ্ন: ছোট শিশু বা নবজাতকের ফিতরা দিতে হয় কি?
- উত্তর: যে শিশু ঈদের দিন ফজরের আগে জন্মগ্রহণ করেছে এবং তার পিতা নিসাবের মালিক, সেই শিশুর জন্যও ফিতরা দিতে হবে। শিশু নিজে নিসাবের মালিক নয়, কিন্তু তার পিতার সম্পদে নিসাব পূর্ণ হয়েছে বিধায় পিতার উপর তার পক্ষ থেকে ফিতরা আদায় করা ফরজ। নবজাতকসহ পরিবারের সকল নাবালেগ সন্তানের ফিতরা পিতাকে দিতে হয়।
- প্রশ্ন: ফিতরা দেওয়ার পর যদি টাকা ফেরত পাওয়া যায়?
- উত্তর: ফিতরা একবার সঠিক ব্যক্তিকে বা প্রতিষ্ঠানকে দেওয়ার পর তা ফেরত নেওয়া যায় না। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ দান। তবে যদি পরে জানা যায় যে ফিতরা অযোগ্য ব্যক্তি (যেমন ধনী ব্যক্তি) পেয়েছে, অথবা দেওয়ার সময় ভুলবশত অযোগ্য ব্যক্তিকে দিয়ে ফেলেছেন, তবে সেই ফিতরা আদায় হবে না। সেক্ষেত্রে পুনরায় যোগ্য ব্যক্তিকে ফিতরা দিতে হবে। তাই দেওয়ার আগে যাচাই-বাছাই করে নেওয়া উচিত।
ফিতরা গণনার পদ্ধতি জানা এবং সময়মতো সঠিক ব্যক্তিকে আদায় করার মধ্যেই নিহিত রয়েছে রমজানের রোজার পূর্ণতা ও ঈদের প্রকৃত আনন্দ। শুধু নিজের জন্য নয়, বরং অসহায় প্রতিবেশীর মুখে হাসি ফোটানোর এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করবেন না। আসুন, ফিতরা গণনার পদ্ধতি অনুসরণ করে সঠিক হিসাব করে, আন্তরিকতার সাথে, সঠিক সময়ে আমাদের ফরজ দায়িত্ব পালন করি। মনে রাখবেন, আপনার দেওয়া সামান্য টাকাই একজন গরিব মানুষের ঈদকে করে তুলতে পারে আনন্দময়। এই পবিত্র রমজানে, ফিতরা গণনার পদ্ধতি বুঝে নিয়ে, সবাই মিলে গড়ে তুলি একটি দয়াময় ও সুন্দর সমাজ। আজই স্থির করুন কাকে, কখন, কত টাকার ফিতরা দেবেন এবং ঈদের আগেই তা আদায় করে ফেলুন। কারণ, অসহায়ের মুখে হাসি ফোটানোই তো ঈদের সবচেয়ে বড় শিক্ষা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।