শরীফ হেলালী: বর্তমান বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে ফেসবুক, টুইটার, ইনস্টাগ্রাম, মেসেঞ্জার, ওয়াটসঅ্যাপ, ভাইবার, ইমো ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এগুলোর মাধ্যমে এখন দেশ-বিদেশের যে কোন প্রান্ত থেকেই অতি সহজে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। অনেক দূরে থাকলেও মনে হয় আমরা একসাথেই আছি। একেবারে সামনাসামনি না হলেও ভার্চুয়ালি প্রতি মুহূর্তেই সব কিছু শেয়ার করতে পারছি। আমাদের আবেগ, অনুভূতি, মতামত, প্রতিক্রিয়া, স্থিরচিত্র অথবা ভিডিও মুহূর্তের মধ্যেই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারছি এসব যোগাযোগ মাধ্যমে। অধিকাংশ ব্যবহারকারীরা তাদের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রায় প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয় শেয়ার করছেন। যারা দেখছেন তারাও তাদের মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া মুহূর্তের মধ্যেই জানাতে পারছেন। এছাড়া এসবের মাধ্যমে এখন অনেকে ঘরে বসেই অনলাইন ব্যবসা, শিক্ষামূলক কর্মসূচি, প্রচার-প্রচারণা, জনমত গঠন, সামাজিক সচেতনতামূলক কার্যক্রম ইত্যাদি পরিচালনা করছেন।
বেশি দিন আগের কথা নয়, দেশে-বিদেশে যোগাযোগ হতো সাধারণত চিঠি-পত্রের মাধ্যমে। একবার চিঠি-পত্র প্রেরণ করে উত্তরের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে করতে দূরত্বভেদে কয়েকদিন কিংবা মাস পার হয়ে যেতো। একসময় গ্রামজুড়ে এক-দুইটি টিভি ছিলো। গ্রামের কোনো কোনো দোকানদার তার বিক্রি বাড়াতে দোকানে টিভি রাখতেন। আমরা পাড়ার ছেলে-বুড়োরা শুক্রবারের সিনেমা কিংবা অন্য কোনো অনুষ্ঠান দেখতে ঐসব দোকানে ভিড় জমাতাম। তখন টিভি চ্যানেল ছিলো শুধু বিটিভি। বর্তমানে প্রায় প্রতি ঘরেই এক বা একাধিক টিভি রয়েছে। অসংখ্য দেশি-বিদেশি টিভি চ্যানেল চব্বিশ ঘন্টাই চালু আছে। কিন্তু এখন টিভির প্রতি সেই আকর্ষণ আর নেই! টিভির জায়গা দখল করে নিয়েছে স্মার্ট ফোন। এখন এটি প্রায় সকলের হাতে হাতে। মোবাইল ফোনে পারস্পরিক যোগাযোগ যেমন আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে গেছে, তেমনি স্মার্টফোনের সহজলভ্যতার ফলে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। অধুনা বিশ্বে তথ্য-প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে মানুষের জীবনযাত্রার ধরন ও যোগাযোগ ব্যবস্থারও ব্যাপক উন্নতি হচ্ছে। এটি অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
তবে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারের বাস্তবচিত্র থেকে বলা যায়, আমরা ফেসবুকের যথাযথ ব্যবহার, এর ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকগুলোর বিষয়ে এখনো পুরোপুরিভাবে সচেতন নই! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ফেসবুকের ব্যবহার এখন চরম নেশার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অনেকে যানবাহন, পড়ার টেবিল, ক্লাসরুম, ধর্মীয় উপাসনালয়, লাইব্রেরি, অফিস, সভা-অনুষ্ঠান, খাওয়ার টেবিল, বিছানা, বাথরুম, ছাদ ইত্যাদি সব জায়গাতেই সময়ে-অসময়ে ফেসবুকিং এ মগ্ন থাকেন, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অশোভনীয়, অনুচিত ও ক্ষতিকরও বটে। ফেসবুকে শেয়ার করা ছবি, ভিডিও বা স্ট্যাটাস এর কারণে অনেকে সময়ে-সময়ে বিব্রতকর অবস্থায় কিংবা বিপদে পড়ছেন। পারস্পরিক বিদ্বেষ বা শত্রুতাও সৃষ্টি হচ্ছে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তাও হুমকির মুখে পড়ছে। গোপনীয়তা রক্ষা হচ্ছে না। অনেক সময় ছোট বিষয় বড় আকার ধারণ করে।
ফেসবুক স্ট্যাটাসের কারণে ইতঃপূর্বে খুনের ঘটনাও ঘটতে দেখা গেছে। মাঝে মাঝে ভয়াবহ সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্যও সৃষ্টি হয়। অনেকের মধ্যে সামাজিক অপরাধ প্রবণতাও সৃষ্টি হয়। বিভিন্ন মাধ্যমে কোনো কোনো সংঘবদ্ধ দল গ্রুপ তৈরি করে নানান অপকর্মও সংঘটন করেন। মোবাইল ফোন বা ফেসবুকে বেশি নিমগ্নতা ও অসাবধানতার কারণে অনেকে রাস্তাঘাটে দুর্ঘটনারও শিকার হচ্ছেন! এটি খুবই উদ্বেগের বিষয় যে, ফেসবুক আমাদের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক এমনকি রাষ্ট্রীয় জীবনকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করছে! অনেক ক্ষেত্রে আমাদের মন ও মস্তিষ্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ফেসবুক ব্যবহারে আমাদের মধ্যে বিভিন্ন কারণে হীনমন্যতা, হতাশা, বিষণ্ণতা, ক্রোধ, ঈর্ষা ও হিংসার মনোভাব জাগ্রত হচ্ছে। অনেকের মধ্যে একাকিত্বতা ও অন্তর্মুখী প্রবণতা বাড়ছে। কারো কারো মাঝে আত্মজাহির করার মানসিকতাও বৃদ্ধি পায়। এটি অনেকের কর্মজীবনকেও প্রভাবিত করছে। শিক্ষার্থীদের মেধা ও মননের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে! এছাড়া জীবনের নানান ক্ষেত্রে এর প্রভাব দিন দিন ব্যাপকতা লাভ করছে। ফেসবুকে ব্যবসার ক্ষেত্রে কিছু ব্যবসায়ী কিছুটা নীতি ও সততা বজায় রাখলেও অনেক ব্যবসায়ী কর্তৃক ক্রেতারা প্রায়শই প্রতারিত হচ্ছেন বলে জানা যায়। বর্তমানে এই ফেসবুকের সুবাদে অনেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রেই মিথ্যা বা মেকির বেড়াজালে জড়িয়ে পড়ছেন।
অনেক পরিবারেই এখন ছোট ছোট বাচ্চাদেরকে প্রায় সারাদিন মোবাইল ফোনের স্ক্রিনে নিমগ্ন থাকতে দেখা যায়। ইউটিউবে নানান ধরনের ভিডিও দেখে। এতে বাচ্চাদের মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে এবং শারীরিক স্বাস্থ্য মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়ছে। অনেক পরিবারে মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে আলাদা আলাদা যার যার মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে পারিবারিক বন্ধনও সুদৃঢ় হচ্ছে না। এটি কোনোভাবেই সুখকর নয়। অনেক ছেলে-মেয়ে বা শিক্ষার্থী অল্প বয়সেই মোবাইল ফোন কিনে দেওয়ার জন্য মা-বাবাকে নানানভাবে বোঝানোর চেষ্টা করে। এতে অনেকের পড়াশুনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন বোর্ড পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের পর ফেসবুকে অনেক শিক্ষার্থীর স্ট্যাটাস দেখা যায় এরকম- ‘আই এম জিপিএ ফাইভ’ কিংবা আই এম গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ। আমাদের এসব শিক্ষার্থী জিপিএ ফাইভ, কিংবা গোল্ডেন জিপিএ ফাইভ পেতেই পারেন! তবে গবেষকদের মতে, তারা এখন বই-পুস্তক পড়া ছেড়ে দিয়েছে। প্রকৃত শিক্ষা অর্জন এবং ভালোভাবে শিক্ষা অর্জনে তাদের বিমুখতা রয়েছে। ফেসবুকে তাদের আসক্তি বেড়ে গেছে। ইদানীং অনেকের আবার টিকটকের প্রতিও আকর্ষণ ও আসক্তি তৈরি হচ্ছে।
ফেসবুকের এই যুগেও কেউ কেউ একটু ব্যতিক্রম আছেন। আমার পরিচিত এমন কয়েকজনের কথা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক মনে করছি। আমার এক সহকর্মী অতিসম্প্রতি অস্ট্রেলিয়া থেকে পড়াশুনা করে দেশে ফিরেছেন। তার সাথে ফেসবুক নিয়ে আলাপকালে সে বললো, ‘আমি ফেসবুক তেমন ব্যবহার করি না। আমি মনে করি, এতে আমার প্রচুর সময় নষ্টহয়! তবে ফেসবুকের ইতিবাচক দিকগুলোর সুফল পেতে হলে এর ব্যবহার সম্পর্কে অবশ্যই সকলকে সচেতন হতে হবে।’
সদ্য বিলেতফেরত বার-এ্যাট-ল’ ডিগ্রি অর্জনকারী আমার আরেক বন্ধুর কাছে ফেসবুক ব্যবহারে তাঁর উদাসীনতার বিষয়ে জানতে চাইলে সে জানালো, ‘অনেক দিন পর পর মন চাইলে ফেসবুকে একবার প্রবেশ করি, না হয় করি না। আগে একটু বেশি ব্যবহার করতাম। পরে মনে হয়েছে, অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমার পড়াশুনার মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে।’ আমার আরেক বিসিএস ক্যাডার বন্ধু বললেন, ‘আমি গত একবছর ফেসবুক, মেসেঞ্জার ব্যবহার করি নাই। তবে অতিসম্প্রতি আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি যে, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়া চলা কঠিন। তাছাড়া এগুলোর প্রতি দিন দিন মানুষের নির্ভরতা বাড়ছে। গত এক বছরে আমি চাকুরি সংক্রান্ত কিছু জিনিস মিস করেছি। এখন আবার আমি সীমিত আকারে ফেসবুক ব্যবহার করছি।’
অনেক গবেষক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতে, ইলেকট্রনিক যে কোনো ডিভাইস একটানা দীর্ঘ সময় ব্যবহারের ফলে ব্যবহারকারীর স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ে। এমনকি কারো কারো ক্ষেত্রে মারাত্মক বদ অভ্যাসের ফলে মৃত্যুর ঝুঁকিও বাড়ে। বাস্তবচিত্র দৃষ্টে বলা যায়, ফেসবুক ব্যবহারকারী অধিকাংশ লোকই প্রয়োজনের চেয়ে অপ্রয়োজনে ফেসবুক নিয়ে একটানা ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকেন। এতে অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হচ্ছে। দৈনন্দিন জীবন নানানভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। প্রকৃত জ্ঞান অর্জনের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ বাড়ছে এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জনের প্রবণতা কমে যাচ্ছে বলেও কোনো কোনো গবেষণায় দাবি করা হয়েছে। এটি ভবিষ্যতের জন্য অশনিসংকেত।
এই লেখার মাধ্যমে আমি ফেসবুক ব্যবহার করার বিষয়ে কাউকে নিরুৎসাহিত করছি না। ফেসবুকের ইতিবাচক দিক যেমন আছে নেতিবাচক দিকও আছে। মূলত কে কোন উদ্দেশ্যে ফেসবুক ব্যবহার করছে তার উপরই নির্ভর করে এর ফলাফল। তবে ফেসবুকসহ অন্যান্য যোগাযোগ মাধ্যমের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার ও অপব্যবহার অত্যন্ত ক্ষতিকর বলেই বিশেষজ্ঞরা মতামত পোষণ করেছেন। অতএব, এসব মাধ্যম ব্যবহারে আমাদের পরিমিতিবোধের চর্চা করা ও সচেতন থাকা জরুরি। পরবর্তী প্রজন্মকেও এবিষয়ে উদ্বুদ্ধ করা প্রয়োজন।
লেখক: সিনিয়র সহকারী কমিশনার, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, চট্টগ্রাম।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।