জুমবাংলা ডেস্ক : সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে পুঁজিবাজারের কারসাজি চক্র। ফেসবুকে অসংখ্য গ্রুপ ও আইডির মাধ্যমে মূল্য সংবেদশীল তথ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে এসব চক্র পুঁজিবাজার থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তাদের থামাতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
নিয়ন্ত্রক সংস্থা নিশ্চুপ থাকায় দিন যত যাচ্ছে ফেসবুকে তত বেপরোয়া হয়ে উঠছে এসব কারসাজি চক্র। ফেসবুক গ্রুপে ‘হট আইটেম’, ‘গ্যারান্টি আইটেম’, ‘সাতদিনে তিনগুণ মুনাফা আইটেম’- এমন চটকদার পোস্ট দিয়ে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করা হচ্ছে। সেই সঙ্গে পোস্টে আইটেম পেতে ব্যক্তিগত ম্যাসেঞ্জারে নক করতেও বলা হচ্ছে। এমন চটকদার পোস্টে আকৃষ্ট হয়ে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ চক্রের খপ্পরে পড়ছেন। এতে কোনো কোনো বিনিয়োগকারী লাভের মুখ দেখলেও বেশির ভাগই প্রতারিত হচ্ছেন।
বিনিয়োগকারীদের অভিযোগ, এসব কারসাজি চক্রের সদস্যদের সঙ্গে বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তাদের যোগাযোগ থাকতে পারে। কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বড় কোনো বিনিয়োগকারী অথবা বিদেশিরা শেয়ার কিনলে, সেই তথ্য দেয়া হয়। এসব তথ্য তো সাধারণের পক্ষে পাওয়া সম্ভব নয়।
এছাড়া যেসব ফেসবুক গ্রুপের সদস্য সংখ্যা বেশি, ওইসব গ্রুপে গুজব ছড়িয়ে সহজেই কোনো বিশেষ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ানো সম্ভব। এ বিষয়ে উদাহরণ দিয়ে এক বিনিয়োগকারী বলেন, কিছু গ্রুপ আছে যার সদস্য কয়েক লাখ। ধরেন একটি গ্রুপে ১০-১১ লাখ সদস্য আছে। ওই গ্রুপ থেকে যদি কোনো একটি কোম্পানির পাঁচ হাজার টাকার শেয়ার কিনতে বলা হয় এবং ১০ শতাংশ সদস্য যদি শেয়ার কেনে তাহলে ৫০ কোটি টাকার মতো শেয়ার কেনা হবে। ভেবে দেখেন, এমনটা যদি বাস্তাবেই হয় তাহলে ওই কোম্পানির শেয়ারের দাম অবশ্যই বড়বে।
এদিকে বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, করসাজি চক্র বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের জন্য বিভন্ন ধরনের আইটেম দেয়ার পাশাপাশি মূল্য সংবেদশীল তথ্যও আগাম দিচ্ছে। এমনকি সূচকের উঠা-নামার পূর্বাভাসও দেয়া হচ্ছে। অনুমান নির্ভর দেয়া এসব তথ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাস্তবে মিলেও যাচ্ছে। আর আগাম দেয়া কোনো তথ্য বাস্তবে মিলে গেলে পরবর্তীতে সেটা ফলাও করে পোস্ট দেয়া হচ্ছে। এতে অতি মুনাফার লোভে কারসাজি চক্রের ফাঁদে পা দিচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা।
ফাঁদে পা দেয়া বিনিয়োগকারীদের এসব চক্র টাকার বিনিময়ে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য দেয়ার পাশাপাশি কখন কোন কোম্পানির শেয়ার কিনতে হবে অথবা বিক্রি করতে হবে, সে বিষয়ে পরামর্শ দিচ্ছে। অবশ্য কিছু কিছু ফেসবুক গ্রুপ থেকে বিনা মূল্যেও তথ্য দেয়া হচ্ছে। এসব চক্রের সদস্যরা ফেসবুকে নিজেদের বিশ্লেষক হিসেবে দাবি করছে। তবে সিকিউরিটিজ আইনে বিএসইসির সনদ ছাড়া বাজার বিশ্লেষক হওয়ার সুযোগ নেই। কেউ এ ধরনের কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হলে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ড এবং ন্যূনতম পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে আইনে।
এদিকে গুজব থেকে পুঁজিবাজার রক্ষায় বিএসইসি ২০০১ সালে একটি নির্দেশনা জারি করে। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিনিয়োগকারী ও পুঁজিবাজারের সঙ্গে যে কোনো উপায়ে জড়িত ব্যক্তি কোনো গুজব ছড়ানো এবং গুজব ছড়াতে সহায়তা করা থেকে বিরত থাকবেন। যে কোনো উপায়েই অর্থাৎ আচার-আচরণ বা মৌখিকভাবে তথ্য অথবা ঘটনা বিকৃত করা, ভুলভাবে পরিচালিত করা কিংবা কোনো তথ্য গোপন করা, যা পুঁজিবাজারকে প্রভাবিত করতে পারে- এমন ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। গুজবের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিকে ন্যূনতম এক লাখ টাকা জরিমানাসহ তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আইন ও বিএসইসির নির্দেশনায় এমন শাস্তির বিধান রাখা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা ‘কাজীর গরু কেতাবে আছে গোয়ালে নেই’ অবস্থাতে দাঁড়িয়েছে। অসংখ্য ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত অসংখ্য গুজব ছড়ানো হলেও ব্যবস্থা নিচ্ছে না বিএসইসি।
বিএসইসির একটি সূত্র বলছে, ফেসবুক ও খুদে বার্তার মাধ্যমে গুজব ছড়ানো বন্ধ করতে ২০১৩ সালের অক্টোবরে একটি নির্দেশনা জারি করে বিএসইসি। ওই নির্দেশনায় বলা হয়, একটি মহল ফেসবুক, খুদে বার্তাসহ বিভিন্নভাবে পুঁজিবাজার নিয়ে গুজব ছড়িয়ে বিনিয়োগকারীদের বিভ্রান্ত করছে। বিষয়টি সিকিউরিটিজ আইনের পরিপন্থী। তই এসব কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্টদের সতর্ক করা হচ্ছে। অন্যথায় সিকিউরিটিজ আইনে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিএসইসির ওই নির্দেশনা জারির পর ২০১৫ সালে একটি ব্রোকারেজ হাউজের কর্মকর্তাকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। এর আগে ২০০৯ সালে গুজব ছড়ানোর দায়ে দুই ব্যক্তিকে দুই লাখ টাকা জরিমানা করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা। তবে ২০১৫ সালের পর গুজব ছড়ানোর অভিযোগ আর কারও বিরুদ্ধে তেমন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সাইফুর রহমান বলেন, ফেসবুকে যারা গুজব ছড়ায় তাদের শনাক্ত করা কঠিন কাজ। এটি নিয়ে আমরা একবার তদন্ত করেছিলাম। যখন তদন্তে নেমেছিলাম তখন এগুলো সব উধাও হয়ে গিয়েছিল। তারপর বিষয়টি টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) জানায়।
‘তবে বিটিআরসি আমাদের জানিয়েছে, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে খুব একটা সহায়তা করে না। যে কারণে তদন্ত আর এগোয়নি। আর আমাদের পক্ষে কারা ফেসবুকে এসব করছে তা বের করা টাফ (কঠিন)। এজন্য বিনিয়োগকারীদের সচেতন হতে হবে। আমরাও বিনিয়োগ শিক্ষা কর্যক্রম চালাচ্ছি।’
রহিম নামের এক বিনিয়োগকারী বলেন, কয়েক মাস ধরে পুঁজিবাজারে মন্দা চলছে। এর মধ্যেও বেশ কয়েকটি কোম্পানি থেকে বিনিয়োগকারীরা মোটা অঙ্কের মুনাফা তুলে নিয়েছে। বাজারে যেমন ভালো কোম্পানি আছে, তেমনি ‘জেড’, ‘বি’ গ্রুপের কোম্পানিও আছে। এসব কোম্পানির বেশির ভাগের শেয়ারের দাম বাড়ার তথ্য আগেই বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে ছড়ানো হয়েছে। বাস্তবেও দেখা যাচ্ছে দাম বাড়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।