জুমবাংলা ডেস্ক : ছাত্রলীগের দুই কেন্দ্রীয় নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নেতাকে থানায় নিয়ে নির্যাতনের ৭২ ঘণ্টা পার হলেও অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা হারুন-অর-রশীদসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে এখনও ফৌজদারি মামলা হয়নি। বহুল আলোচিত এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত সাময়িক বরখাস্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করা হয়েছে।
অথচ লিখিত অভিযোগ বা গ্রেপ্তার ছাড়াই ছাত্রলীগের তিন নেতাকে থানার অভ্যন্তরে অকথ্য নির্যাতন করা হয়েছে, যা ফৌজদারি কার্যবিধির ৩২৬ ও ৩০৭ ধারা অথবা নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩-এর ১৩ ধারার সুস্পষ্ট অপরাধ। ফৌজদারি আইনের ৩২৬ ধারায় স্বেচ্ছাকৃতভাবে মারাত্মক অস্ত্রের মাধ্যমে গুরুতর আঘাত দান এবং ৩০৭ ধারায় নির্যাতনে মৃত্যু ঘটতে পারে– এমন শঙ্কার কথা বলা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ড হতে পারে। অন্যদিকে, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনের আওতায় বিচার হলে অপরাধীর অন্যূন পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা অন্যূন ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে।
আইনজ্ঞরা বলছেন, আইন সবার জন্য সমান। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দু-একজনের অপরাধ কোনোভাবেই পুরো বাহিনী নিতে পারে না। র্যাবের নির্যাতনে ঝালকাঠিতে লিমনের পা হারানো বা নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা ভুলে গেলে চলবে না। এডিসি হারুসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হলেও ফৌজদারি মামলা অবশ্যই হওয়া উচিত। কারণ, লিখিত অভিযোগ বা গ্রেপ্তার ছাড়াই ছাত্রলীগের তিন নেতাকে থানার অভ্যন্তরে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, সেটি আইনের শাসনের পরিপন্থি। এ ব্যাপারে উচ্চ আদালতেরও একাধিক নির্দেশনা রয়েছে। তাই সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা না হলে ব্যক্তির অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে।
সাবেক আইজিপি মুহাম্মদ নুরুল হুদা বলেন, যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ। কিন্তু এজন্য তো নির্যাতিতদের মামলা করতে হবে। তারা মামলা না করলে পুলিশের কিছু করার নেই।
পুলিশ মামলা করতে পারে কিনা– এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, পুলিশ ক্ষেত্র বিশেষ মামলা করে থাকে। কিন্তু এখানে নির্যাতিতরা অনুপস্থিত নেই। তাই তার প্রয়োজন হবে না। আর মামলা না করলেও সমস্যা নেই, ইতোমধ্যে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। সেখানেও চাকরিচ্যুতিসহ বিভিন্ন ধরনের শাস্তি রয়েছে।
গত শনিবার রাজধানীর একটি হাসপাতালে এডিসি হারুনের সঙ্গে তাঁর এক নারী সহকর্মীর আড্ডাকে কেন্দ্র করে বাদানুবাদে জড়ান ছাত্রলীগের দুই নেতা। ওই নারীর স্বামী রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হকের ডাকে তারা হাসপাতালে যান। এ ঘটনার জেরে এদিন রাতে ছাত্রলীগের ওই দুই নেতাকে শাহবাগ থানায় আটকে অকথ্য নির্যাতন চালান এডিসি হারুনসহ বাহিনীর অন্যরা। খবর পেয়ে ছাত্রলীগের আরেক নেতা থানায় গেলে তাঁকেও নির্যাতন করা হয়।
নির্যাতিতরা জানিয়েছেন, হারুন সাধারণ পোশাকে ছিলেন। তিনি পিস্তলের বাট দিয়ে মুখে উপর্যুপরি আঘাত করেছেন। নির্যাতনে একজনের সামনের অংশের কিছু দাঁত ভেঙে গেছে। তাঁর সঙ্গে বাহিনীর ১০-১২ জন সদস্য ছিলেন। আহত ব্যক্তিরা হলেন– ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফজলুল হক হলের সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাঈম, কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনীম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু হল শাখার সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুর রহমান।
এডিসি হারুনের অপরাধ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু আইন অনুযায়ী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ভুক্তভোগীকে মামলা দায়ের করতে হবে। এখানে ফৌজদারি অপরাধ হয়েছে। সেখানে হারুনের বিরুদ্ধে যে প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে; তাতে তিরস্কার, বেতন কমানো, ডিমোশন বা চাকরিচ্যুতি হতে পারে। কিন্তু অপরাধ থেকেই যাচ্ছে। প্রশাসনিক ব্যবস্থাকে অপরাধের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রচার করে এবং ফৌজদারি মামলা না করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করছে।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, নির্যাতনের ঘটনায় এডিসি হারুনের তিনটি অপরাধ দৃশ্যমান হয়েছে। তিনি পরোয়ানা ছাড়াই তিনজনকে থানায় বীভৎসভাবে নির্যাতন করেছেন। একজনের সামনের পাটির সব দাঁত পড়ে গেছে। যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে, সেটি অবশ্যই ফৌজদারি অপরাধ। দাঁত ভাঙা ও নির্যাতনের বিষয়টি ৩২৬ ধারা এবং হত্যার উদ্দেশ্যে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে সেটিও ৩০৭ ধারার অপরাধ। এ ঘটনায় এডিসি হারুনসহ যারা জড়িত রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ফৌজদারি মামলা করা উচিত। নির্যাতিত বা পুলিশ যে কেউ মামলা করতে পারেন। এখন যদি ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা না হয়, সেটি হবে অবশ্যই আইনের শাসনের পরিপন্থি।
তাঁর মতে, আইন সবার জন্য সমান। ব্যক্তি বিশেষের জন্য ভিন্নভাবে প্রয়োগ হলে সেটি ভবিষ্যতের জন্য বাজে নজির হয়ে থাকবে। র্যাবের নির্যাতনে ঝালকাঠীতে লিমনের পা হারানো বা নারায়ণগঞ্জের সাত খুনের ঘটনা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। ব্যক্তির অপরাধ বাহিনীর টেনে নেওয়াটা সমীচীন নয়। এডিসি হারুনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হলেও ফৌজদারি মামলা অবশ্যই হওয়া উচিত।
জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য হিসেবে এডিসি হারুনসহ সংশ্লিষ্টরা যে অপরাধ করেছেন, সেটি গুরুতর অপরাধ। সংশ্লিষ্টরা আইন লঙ্ঘন করেছেন। নির্যাতিত ব্যক্তিদেরও মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়েছে। তাই নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হতে হবে। নয়তো ব্যক্তির অপরাধকে প্রশ্রয় দেওয়া হবে।
তিনি আরও বলেন, কাউকে দায়িত্ব থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা কোনো শাস্তি নয়। অপরাধের ধরন অনুযায়ী অপরাধীদের চাকরিচ্যুতি করা এবং ফৌজদারি অপরাধের জন্য তাদেব বিচারের মুখোমুখি করাই উচিত।
এদিকে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন গত সোমবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, হারুন-অর-রশীদসহ অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ছাত্রলীগ বা নির্যাতিত পরিবারের কেউ মামলা করবে না। এ ঘটনায় ডিএমপির বিভাগীয় তদন্ত ও ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রাখতে চায় সংগঠনটি। তবে গতকাল মঙ্গলবার রাতে মামলা করার বিষয়ে জানতে চাইলে নির্যাতনের শিকার শরীফ আহমেদ মুনীম বলেন, এখনও নাঈম ভাই অসুস্থ, হাসপাতালে আছেন। তিনি সুস্থ হলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।