রাত তিনটা। মনির চোখের সামনে ভাসছে ল্যাপটপের স্ক্রিন আর একের পর এক পেন্ডিং প্রজেক্ট। হঠাৎই ফেসবুক ফিডে চোখ আটকে গেল—”ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেয়ার শেষ তারিখ ঘনিয়ে আসছে!” গলদঘর্ম অবস্থায় হিসাব করার চেষ্টা করলেন, গত বছর আপওয়ার্ক, ফাইভারে আর স্থানীয় ক্লায়েন্টদের থেকে আয় করেছেন প্রায় ১২ লাখ টাকা। কিন্তু টাকা ব্যাংকে জমা হয়েছে বিভিন্ন উৎস থেকে, খরচ হয়েছে অফিস সেটআপ, ইন্টারনেট বিল, সফটওয়্যার কিনতে। ট্যাক্স রিটার্ন ফাইল করতে গেলে এইসব কিভাবে প্রুফ দেবেন? কোন ফর্ম ব্যবহার করবেন? ভাবতেই কপালে চিন্তার ভাঁজ। মনির মতো হাজারো ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স রিটার্ন ফাইলের ভীতি যেন এক অদৃশ্য শৃঙ্খল, যা তাদের সৃজনশীলতা আর আয়ের স্রোতে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়।
বাংলাদেশে ফ্রিল্যান্সিং সেক্টর এখন বিপ্লবের মুখে। আইডিইএ, এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৬ লাখেরও বেশি তরুণ-তরুণী প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ফ্রিল্যান্সিংয়ের সাথে যুক্ত, যাদের বার্ষিক আয় ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। কিন্তু এই বিশাল আয়ের একটি বড় অংশই সরকারি কোষাগারে পৌঁছায় না শুধুমাত্র জ্ঞানের অভাব আর প্রক্রিয়াজনিত জটিলতার কারণে। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই গাইড আপনাকে ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স রিটার্ন ফাইল করার পুরো প্রক্রিয়াটি এতটা সহজ করে বুঝিয়ে দেবে, যেন আপনি ক্লায়েন্টের জন্য পরের প্রজেক্ট ডেলিভারি দিচ্ছেন!
ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স রিটার্ন: কেন জরুরি এবং আপনার জন্য প্রযোজ্য নীতিমালা
ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স রিটার্ন শুধু আইনি বাধ্যবাধকতা নয়, এটি আপনার আর্থিক সুস্থতা ও ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশে, কোনো ব্যক্তির করযোগ্য আয় (যেকোনো উৎস থেকে) যদি ন্যূনতম করমুক্ত সীমা অতিক্রম করে (যা প্রতি বছর অর্থবিলে ঘোষিত হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য সাধারণ নাগরিকের জন্য ৩,৫০,০০০ টাকা), তবে তার জন্য আয়কর রিটার্ন ফাইল করা বাধ্যতামূলক। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আপনি যখন আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেস (Upwork, Fiverr, Freelancer.com) বা স্থানীয় ক্লায়েন্টদের থেকে সেবা বিক্রি করে আয় করেন, সেটিই আপনার পেশাগত আয় বা “বাণিজ্যিক আয়”। এই আয় সম্পূর্ণরূপে করযোগ্য।
গুরুত্বপূর্ণ তথ্য: বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (NBR) এর “আয়কর অধ্যাদেশ, ১৯৮৪” এর ধারা ৭৫(ক) অনুযায়ী, একজন স্বতন্ত্র পেশাজীবী (যার মধ্যে ফ্রিল্যান্সাররা অন্তর্ভুক্ত) হিসেবে আপনার আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে IT-10GA ফর্ম ব্যবহার করে। এটি বেসিক জ্ঞান।
অনেক ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে ভুল ধারণা কাজ করে:
- “বিদেশি ক্লায়েন্ট থেকে আয়, তাই বাংলাদেশে ট্যাক্স দিতে হবে না”: এটি সম্পূর্ণ ভুল। আপনি বাংলাদেশে বসবাস করছেন এবং আয় করছেন, তাই এই আয় বাংলাদেশে করযোগ্য (NBR এর ডাবল ট্যাক্সেশন এভয়েডেন্স এগ্রিমেন্ট সংক্রান্ত নির্দেশিকা ব্যতীত)।
- “ছোট আয়, তাই ট্যাক্স রিটার্ন ফাইলের দরকার নেই”: করমুক্ত সীমার নিচে আয় করলেও, ব্যাংক লোন, ভিসা অ্যাপ্লিকেশন বা উচ্চতর আয়ের প্রমাণের জন্য রিটার্ন ফাইল উপকারী।
- “খরচ বাদ দিলে তো আয়ই থাকে না”: হ্যাঁ, আপনি বৈধ ব্যবসায়িক খরচ (Business Expenses) আয় থেকে বাদ দিতে পারবেন, কিন্তু সেগুলোর সঠিক ডকুমেন্টেশন থাকতে হবে।
ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স রিটার্ন ফাইলের সুবিধাগুলো আপনার ক্যারিয়ারকে গতিশীল করবে:
- আইনি সুরক্ষা: এনবিআর-এর সাথে আপনার সম্পর্ক হবে স্বচ্ছ, জরিমানা বা আইনি জটিলতা এড়ানো যাবে।
- আর্থিক সুযোগ: ব্যাংক লোন, ক্রেডিট কার্ড, বা বড় অংকের বিনিয়োগের জন্য আয়ের প্রমাণপত্র হিসেবে ট্যাক্স সার্টিফিকেট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
- ভবিষ্যত পরিকল্পনা: সঠিকভাবে আয়-ব্যয় ট্র্যাক করলে আপনার আর্থিক লক্ষ্য নির্ধারণ ও অর্জন সহজ হবে।
- সামাজিক দায়বদ্ধতা: আপনি দেশের উন্নয়নে অবদান রাখছেন, যা সুযোগ-সুবিধা ফিরে পেতে সহায়ক।
ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স রিটার্ন ফাইলের প্রস্তুতি: ডকুমেন্টেশনই সাফল্যের চাবিকাঠি
ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স রিটার্ন প্রক্রিয়া শুরু হয় সঠিক ডকুমেন্টেশন গোছানোর মধ্য দিয়ে। ভয় পাবেন না, এটি আপনার কাজের ফাইল ম্যানেজমেন্টের মতোই!
- আয়ের প্রমাণপত্র সংগ্রহ (Track Your Income):
- বৈদেশিক রেমিট্যান্স: পেপ্যাল, ওয়্যার ট্রান্সফার, স্ক্রিল, পেওনিয়ার বা ব্যাংক সুইফট কপি। প্রতিটি লেনদেনের তারিখ, পরিমাণ, ক্লায়েন্টের নাম নোট করুন। (উৎস: আপনার ব্যাংক স্টেটমেন্ট, পেমেন্ট গেটওয়ে ড্যাশবোর্ড)।
- স্থানীয় আয়: ক্লায়েন্টের কাছ থেকে প্রাপ্ত চালান/রশিদ, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, মোবাইল ফাইন্যান্স রিসিপ্ট। বিকাশ, নগদ, রকেটের লেনদেনের স্ক্রিনশট সংরক্ষণ করুন।
- মার্কেটপ্লেস রিপোর্ট: Upwork, Fiverr ইত্যাদি প্ল্যাটফর্মের মাসিক বা বার্ষিক আয়ের সারাংশ (Earnings Summary) ডাউনলোড করুন।
- মোট আয়ের সারসংক্ষেপ: মাসওয়ারী বা প্রজেক্ট ভিত্তিতে আপনার মোট আয়ের একটি এক্সেল শীট বা ডায়েরি তৈরি করুন।
- ব্যবসায়িক খরচের প্রমাণপত্র সংরক্ষণ (Document Your Expenses): এই খরচগুলো আপনার আয় থেকে বাদ যাবে (Tax Deductible)।
- সরাসরি খরচ (Direct Expenses): ক্লায়েন্টের কাজের জন্য সরাসরি প্রয়োজনীয় খরচ। যেমন: সাবকন্ট্রাক্টর ফি (অন্য ফ্রিল্যান্সারকে কাজ দিলে), স্টক ইমেজ/ভিডিও ক্রয়, সফটওয়্যার লাইসেন্স (Adobe Creative Cloud, Microsoft Office, Canva Pro), প্রজেক্ট স্পেসিফিক টুলস ক্রয়।
- পরোক্ষ খরচ (Indirect Expenses/Overheads): ব্যবসা পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় খরচ। যেমন:
- ইন্টারনেট বিল: আপনার ইন্টারনেট বিলের ৮০-৯০% (বাড়িতে কাজ করলে) দাবি করা যেতে পারে।
- বিদ্যুৎ বিল: হোম অফিসের জন্য ব্যবহারের আনুপাতিক অংশ।
- মোবাইল/ল্যান্ডফোন বিল: ব্যবসায়িক কলের অংশ।
- হোম অফিস খরচ: আপনি যদি বাড়ির একটি নির্দিষ্ট অংশ শুধু কাজের জন্য ব্যবহার করেন, তবে বাড়ি ভাড়া বা বাড়ির মূল্যহ্রাসের (যদি নিজের বাড়ি হয়) একটি অংশ দাবি করতে পারেন। প্রমাণ হিসেবে ফ্লোর প্ল্যান বা রেন্টাল এগ্রিমেন্টের কপি দরকার হতে পারে।
- অফিস সরঞ্জাম ক্রয়/ভাড়া: ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, প্রিন্টার, ক্যামেরা, ফার্নিচার। এগুলো মূলধনী সম্পদ (Capital Asset), একবারে পুরো খরচ বাদ না গিয়ে বার্ষিক অবচয় (Depreciation) হিসাবে দাবি করতে হয় (NBR এর নির্দেশিত হার অনুযায়ী)।
- স্টেশনারি ও অফিস সাপ্লাইজ: কাগজ, কালি, পেন্সিল, নোটবুক ইত্যাদি।
- বিজ্ঞাপন ও মার্কেটিং খরচ: নিজের সার্ভিস প্রচারের জন্য ওয়েবসাইট হোস্টিং, ডোমেইন রিনিউয়াল, অনলাইন এডস (ফেসবুক, গুগল), বিজনেস কার্ড প্রিন্টিং খরচ।
- ব্যাংক চার্জ ও লেনদেন ফি: আন্তর্জাতিক ট্রান্সফারের ফি, মার্চেন্ট একাউন্ট ফি।
- পেশাগত উন্নয়ন: আপনার স্কিল ডেভেলপমেন্টের জন্য কোর্স ফি (Coursera, Udemy, লোকাল ট্রেনিং), বই ক্রয়, প্রাসঙ্গিক সেমিনার/কনফারেন্সে অংশগ্রহণের খরচ।
- ভ্রমণ খরচ: সরাসরি ক্লায়েন্ট মিটিং বা ব্যবসায়িক ইভেন্টে যাওয়ার খরচ (যানবাহন ভাড়া, জ্বালানি, থাকা-খাওয়া – প্রমাণসহ)।
অভিজ্ঞ ফ্রিল্যান্সার রিয়াজের পরামর্শ: “প্রতিদিনের ছোট ছোট রশিদও জমা রাখুন। শুরুতে একটি সাধারণ ফোল্ডার বানিয়ে সেখানে মাস অনুযায়ী সব রশিদ ফেলে রাখতাম। এখন ডিজিটাল স্ক্যান করে গুগল ড্রাইভে রাখি। ক্লায়েন্টের কাজের সাথে সরাসরি যুক্ত খরচের স্ক্রিনশট বা ইমেইল প্রুফও সংরক্ষণ করি। এতে বছরের শেষে হিসাব করতে সময় লাগে না।”
- ব্যক্তিগত তথ্য প্রস্তুত করুন:
- জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) কপি।
- টিন সার্টিফিকেট (ট্যাক্সপেয়ার আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার) – যদি না থাকে, জেনে নিন কিভাবে টিন নম্বর পাবেন।
- ব্যাংক একাউন্ট নম্বর ও IFSC কোড (ট্যাক্স রিফান্ড বা জরিমানা পরিশোধের জন্য)।
- পূর্ববর্তী বছরের আয়কর রিটার্নের কপি (যদি থাকে)।
সতর্কতা: সব ধরনের রশিদ, চালান, ব্যাংক স্টেটমেন্ট, ডিজিটাল রিপোর্টের ফিজিকাল বা ডিজিটাল কপি (PDF, স্ক্রিনশট) কমপক্ষে ৬ বছর সংরক্ষণ করুন। এনবিআর যেকোনো সময় এই ডকুমেন্টেশন চাইতে পারে (অধ্যাদেশের ধারা ১৮৫ অনুযায়ী)।
ধাপে ধাপে ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স রিটার্ন ফাইলিং: e-TIN সিস্টেমের সহজ পদ্ধতি
ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স রিটার্ন ফাইলিং এখন আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (NBR) অনলাইন e-TIN সিস্টেমের মাধ্যমে। আসুন ধাপে ধাপে জেনে নেই পুরো প্রক্রিয়াটি:
- e-TIN পোর্টালে লগইন করুন:
- NBR এর অফিসিয়াল e-TIN ওয়েবসাইটে যান:
https://etin.gov.bd
- আপনার ইউজার আইডি (টিন নম্বর) এবং পাসওয়ার্ড দিয়ে লগ ইন করুন। নতুন ইউজার হলে প্রথমে নিবন্ধন করুন (রেজিস্ট্রেশন)।
- ড্যাশবোর্ড থেকে “রিটার্ন প্রস্তুত করুন” (Prepare Return) অপশনে ক্লিক করুন।
- NBR এর অফিসিয়াল e-TIN ওয়েবসাইটে যান:
- সঠিক ফর্ম নির্বাচন করুন (IT-10GA):
- ফ্রিল্যান্সার/স্বতন্ত্র পেশাজীবী হিসেবে আপনার জন্য প্রযোজ্য ফর্ম হল IT-10GA (“বাণিজ্যিক” বা “Commercial” আয়ের জন্য)। এটি ড্রপডাউন মেনু থেকে সিলেক্ট করুন।
- সংশ্লিষ্ট আয় বছর (Assessment Year) সিলেক্ট করুন। মনে রাখবেন, আয় বছর হল যে বছর আপনি রিটার্ন ফাইল করছেন (যেমন, ২০২৪-২৫ আয় বছরের জন্য করযোগ্য আয় হল ২০২৩-২৪ অর্থবছরে অর্জিত আয়)।
- আয়ের বিবরণী পূরণ করুন (Particulars of Income):
- বাণিজ্যিক আয় (Commercial Income): এই অংশে আপনার ফ্রিল্যান্সিং থেকে অর্জিত মোট আয় (Gross Income) লিখুন। এটি আপনার সব ক্লায়েন্ট, সব প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রাপ্ত মোট অর্থের পরিমাণ (কর কাটার আগে)।
- বৈধ খরচ কাটা (Deductible Expenses): এখন আসে সুবিধার অংশ। আপনি যে সব বৈধ ব্যবসায়িক খরচ (Business Expenses) সংরক্ষণ করেছেন, সেগুলোর মোট পরিমাণ এখানে উল্লেখ করুন। এই খরচগুলো আপনার মোট আয় থেকে বাদ পড়বে। ধরা যাক, আপনার মোট আয় ১০,০০,০০০ টাকা। বৈধ খরচ ২,৫০,০০০ টাকা। তাহলে আপনার নিট ব্যবসায়িক আয় (Net Business Income) হবে ৭,৫০,০০০ টাকা।
- অন্যান্য আয় (যদি থাকে): বেতন (কোনো পার্টটাইম চাকরি থাকলে), বাড়ি ভাড়া, ব্যাংক সুদ ইত্যাদি আলাদাভাবে উল্লেখ করুন।
- মোট করযোগ্য আয়: সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপনার নিট বাণিজ্যিক আয় এবং অন্যান্য আয় যোগ করে মোট করযোগ্য আয় (Total Taxable Income) ক্যালকুলেট করে দেখাবে।
- কর হিসাব ও কর রেয়াত (Tax Calculation & Rebates):
- কর স্ল্যাব অনুযায়ী কর: আপনার মোট করযোগ্য আয় বর্তমান আয়কর স্ল্যাব অনুযায়ী কর গণনা করবে। সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই হিসাব করে দেবে।
- কর রেয়াত/ছাড় (Tax Rebates): এখানে আপনি দাবি করতে পারেন এমন ছাড়গুলো যোগ করুন। ফ্রিল্যান্সারদের জন্য প্রাসঙ্গিক ছাড়গুলোর মধ্যে রয়েছে:
- বিনিয়োগ ছাড়: জীবন বীমা প্রিমিয়াম, প্রভিডেন্ট ফান্ডে অবদান, ডব্লিউপিপি এফ/পেনশন সঞ্চয় তহবিল, স্বীকৃত মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ (সুনির্দিষ্ট সীমার মধ্যে)।
- মহিলা/প্রতিবন্ধী/গেজেটেড কর্মকর্তা ছাড়: প্রযোজ্য হলে।
- উৎসে কর (TDS) কাটা: যদি কোনো স্থানীয় ক্লায়েন্ট আপনার সার্ভিসের জন্য পেমেন্ট করার সময় উৎসে কর (TDS) কেটে থাকে (সাধারণত চুক্তির পরিমাণ ২ লক্ষ টাকার বেশি হলে), তাহলে সেই কাটা টাকার প্রমাণপত্র (TDS Certificate – Form 50) জমা দিতে হবে এবং তার পরিমাণ এখানে উল্লেখ করতে হবে। এই কাটা টাকা আপনার মোট প্রাপ্য কর থেকে বাদ পড়বে। বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে সাধারণত TDS কাটা হয় না।
- প্রাপ্য নিট কর: সিস্টেম কর রেয়াত/ছাড় এবং উৎসে কাটা কর (যদি থাকে) বাদ দিয়ে আপনার প্রাপ্য নিট কর (Net Tax Payable) বা প্রাপ্য রিফান্ড (Refund Due) হিসাব করে দেবে।
- ডকুমেন্ট আপলোড করুন (Attachment):
- এই ধাপে আপনার সংগৃহীত প্রমাণপত্রের স্ক্যান কপি আপলোড করুন। সাধারণত প্রয়োজন হয়:
- টিন সার্টিফিকেট কপি।
- জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) কপি।
- আয়ের প্রমাণপত্রের সারসংক্ষেপ (নিজে তৈরি করা)।
- উল্লেখযোগ্য খরচের রশিদ/প্রমাণপত্র (যেমন, বড় অংকের সফটওয়্যার ক্রয়, বড় অংকের সরঞ্জাম ক্রয়, উল্লেখযোগ্য মার্কেটিং খরচ)।
- উৎসে কর (TDS) কাটার সার্টিফিকেট (Form 50), যদি প্রযোজ্য হয়।
- বিনিয়োগের প্রমাণপত্র (বীমা প্রিমিয়াম রিসিপ্ট, পিএফ স্টেটমেন্ট ইত্যাদি), যদি ছাড় দাবি করা হয়।
- প্রতিটি আপলোডের জন্য সঠিক ক্যাটাগরি (যেমন, “আয়ের প্রমাণ”, “খরচের প্রমাণ”, “TDS সার্টিফিকেট”) সিলেক্ট করুন।
- ফাইল সাইজ ও ফরম্যাট (সাধারণত PDF, JPG) এর সীমা মেনে চলুন।
- এই ধাপে আপনার সংগৃহীত প্রমাণপত্রের স্ক্যান কপি আপলোড করুন। সাধারণত প্রয়োজন হয়:
- চূড়ান্ত পর্যালোচনা ও জমা দেওয়া (Review & Submit):
- সাবমিট করার আগে সব তথ্য বারবার যাচাই করুন। একবার সাবমিট করলে সংশোধন করা জটিল হতে পারে।
- তথ্য সঠিক হলে, “যাচাই করুন” (Verify) এবং তারপর “জমা দিন” (Submit) বাটনে ক্লিক করুন।
- সফলভাবে জমা দেওয়ার পর, আপনি একটি স্বীকারোক্তি (Acknowledgement) পাবেন যাতে একটি প্রাপ্তি নম্বর (Acknowledgement Number) থাকবে। এটি সংরক্ষণ করুন। এটি আপনার রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রমাণপত্র।
- ট্যাক্স পরিশোধ (যদি প্রাপ্য কর থাকে):
- যদি আপনার প্রাপ্য নিট কর শূন্যের বেশি হয়, তাহলে আপনাকে সেই টাকা পরিশোধ করতে হবে।
- e-TIN সিস্টেমের ড্যাশবোর্ড থেকেই অনলাইনে চালান জারি (Generate Challan) করে পেমেন্ট করতে পারবেন (ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড, মোবাইল ফাইন্যান্স, ইন্টারনেট ব্যাংকিং এর মাধ্যমে)।
- পেমেন্টের প্রমাণপত্র (চালানের কপি) সংরক্ষণ করুন।
বিশেষজ্ঞ পরামর্শ (আবুল কালাম আজাদ, কর পরামর্শক): “অনেক ফ্রিল্যান্সার ভুল করেন খরচের অংশে। মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র ব্যবসার সাথে সরাসরি সম্পর্কিত ও যুক্তিসঙ্গত (reasonable) খরচই দাবি করা যায়। ব্যক্তিগত ভ্রমণ, বিনোদন খরচ বা অতিরিক্ত ফ্ল্যাট ভাড়ার অংশ দাবি করলে পরবর্তীতে এনবিআর তলব করতে পারে। ডকুমেন্টেশনের কোন বিকল্প নেই।”
ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স রিটার্নে কমন ভুল এবং সেগুলো এড়ানোর উপায়
ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স রিটার্ন ফাইলিংয়ে কিছু সাধারণ ভুল বারবার দেখা যায়, যার জন্য পরবর্তীতে জরিমানা বা জটিলতার সম্মুখীন হতে হয়। সচেতন হোন:
- আয় কম দেখানো বা গোপন করা: এটি সবচেয়ে বড় ভুল। মার্কেটপ্লেস বা ব্যাংক স্টেটমেন্টে সব ট্রানজেকশন রেকর্ড থাকে। এনবিআর এর সাথে ডেটা শেয়ারিং বাড়ছে। আয় গোপন করলে বড় জরিমানা, অতিরিক্ত কর, এমনকি আইনি মামলার সম্মুখীন হতে পারেন।
- অযৌক্তিক বা অপ্রমাণিত খরচ দাবি করা: ব্যবসার সাথে সম্পর্কিত নয় এমন খরচ (যেমন, ব্যক্তিগত গাড়ির পুরো রক্ষণাবেক্ষণ, পারিবারিক ভ্রমণ) দাবি করলে তা প্রত্যাখ্যাত হবে। খরচ অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত এবং প্রমাণযোগ্য হতে হবে।
- সঠিক ফর্ম না ব্যবহার (IT-10GA এর পরিবর্তে IT-1): শুধুমাত্র বেতনভোগী কর্মচারীদের জন্য IT-1 ফর্ম। ফ্রিল্যান্সারদের বাণিজ্যিক আয়ের জন্য IT-10GA ফর্ম বাধ্যতামূলক। ভুল ফর্ম ব্যবহার করলে রিটার্ন বাতিল বা সংশোধনের নির্দেশ দেওয়া হতে পারে।
- উৎসে কর কাটা (TDS) উল্লেখ না করা বা ভুল উল্লেখ করা: স্থানীয় ক্লায়েন্ট কেটে নেওয়া TDS এর প্রমাণপত্র (Form 50) জমা না দিলে বা সঠিক পরিমাণ উল্লেখ না করলে, আপনাকে পুরো কর আবার দিতে হতে পারে।
- ডকুমেন্টেশন সংরক্ষণে অবহেলা: রিটার্ন জমা দেওয়া মানেই শেষ নয়। সংশ্লিষ্ট আয়বর্ষের পরবর্তী ৬ বছর পর্যন্ত সব প্রমাণপত্র সংরক্ষণ করতে হবে। এনবিআর যেকোনো সময় তলব করতে পারে।
- শেষ মুহূর্তে ভিড় করা: জুন-জুলাই মাসে e-TIN সার্ভার ধীরগতি বা ডাউন হওয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে। এপ্রিল-মে মাসেই প্রস্তুতি শেষ করে ফেলুন।
- আনুমানিক আয়ের (Presumptive Tax) সুবিধা না নেওয়া: ক্ষুদ্র ও মাঝারি ফ্রিল্যান্সারদের জন্য এনবিআর আনুমানিক করের সুবিধা দেয়। আপনার বার্ষিক মোট টার্নওভার (মোট আয়) যদি নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থাকে (প্রতি বছর অর্থবিলে ঘোষিত, সাধারণত ৭০ লাখ টাকার নিচে) এবং আপনি যদি চান, তাহলে নিট মুনাফা নির্ধারণ না করে সরাসরি মোট টার্নওভারের একটি নির্দিষ্ট শতাংশ (যেমন ৩%-৫%) কর হিসেবে পরিশোধ করতে পারেন। এটি হিসাবকে অনেক সহজ করে দেয়। তবে, এই পদ্ধতি বেছে নিলে আপনি খরচ বাদ দেওয়ার সুযোগ হারাবেন। আপনার আয় ও খরচের অনুপাত বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিন। (NBR ওয়েবসাইটে “Presumptive Tax” বা “আনুমানিক কর” নিয়ে সার্চ করুন)।
ভুল এড়ানোর টিপস:
- সারা বছর ধরে ট্র্যাক করুন: মাস শেষে আয়-খরচের সারসংক্ষেপ তৈরি করুন। এক্সেল বা অ্যাকাউন্টিং সফটওয়্যার (Wave, Zoho Books-এর ফ্রি ভার্সন) ব্যবহার করুন।
- প্রমাণপত্র স্ক্যান করুন: ফিজিকাল রশিদ হারানোর ভয়? মোবাইল দিয়ে স্ক্যান করে গুগল ড্রাইভ বা ড্রপবক্সে রাখুন।
- সহায়তা নিন: প্রথমবার গাইডেন্সের জন্য একজন রেজিস্টার্ড কর পরামর্শকের (Income Tax Practitioner – ITP) সাহায্য নিতে পারেন। খরচ কম।
- e-TIN হেল্পডেস্ক: সমস্যায় পড়লে
https://etin.gov.bd
সাইটে হেল্পডেস্ক নম্বর বা ইমেইল থেকে যোগাযোগ করুন। - NBR রিসোর্স: NBR এর অফিসিয়াল ইউটিউব চ্যানেল (
https://www.youtube.com/@nbrbdofficial
) ও ওয়েবসাইটে টিউটোরিয়াল ভিডিও ও গাইডলাইন রয়েছে।
ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স রিটার্ন ফাইলিং কোনো জটিল বিজ্ঞান নয়, বরং একটি শৃঙ্খলাপূর্ণ প্রক্রিয়া মাত্র। আপনি প্রতিদিন ডেডলাইন ম্যানেজ করেন, ক্লায়েন্টের জটিল রিকোয়েস্ট হ্যান্ডেল করেন – ট্যাক্স রিটার্ন তার চেয়ে সহজ! আপনার আয়ের স্বীকৃতি দিন, খরচের প্রমাণ রাখুন, e-TIN সিস্টেমের সহজ ধাপগুলো অনুসরণ করুন, আর ভুলগুলো থেকে সাবধান থাকুন। এই গাইড আপনার হাতের মুঠোয় থাকুক, প্রিন্ট করে নিন বা বুকমার্ক করুন। এখনই আপনার আয়-খরচের ফাইল গোছানো শুরু করুন, ক্যালেন্ডারে জুলাই মাসের শেষ তারিখটি মার্ক করুন। ফ্রিল্যান্সারদের ট্যাক্স রিটার্ন ফাইল করে আইনি সুরক্ষা নিন, আর্থিক সুযোগের দরজা খুলুন, আর আপনার কঠোর পরিশ্রমের আয়ের প্রতি দায়িত্বশীল হোন – কারণ আপনার সৃজনশীলতাই দেশের অর্থনীতির নতুন ইঞ্জিন, এর স্বীকৃতি দিন, ট্যাক্স দিন, সামনে এগিয়ে যান। আপনার সাফল্য আমাদের গর্ব!
জেনে রাখুন (FAQs)
ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আমার ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ কখন?
সাধারণত, বাংলাদেশে আয়বর্ষ (১ জুলাই থেকে ৩০ জুন) শুরুর পরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত (যেমন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের আয়ের জন্য রিটার্ন জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)। তবে, ভলান্টারি রিটার্নের জন্য পরবর্তী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হতে পারে (প্রতি বছর NBR প্রেস রিলিজ চেক করুন)। কোনো অবস্থাতেই দেরি না করাই ভালো। জরিমানা এড়াতে সময়মতো জমা দিন।
আমার বিদেশি ক্লায়েন্টরা পেমেন্ট করার সময় ট্যাক্স কাটছেন না। আমার ট্যাক্স দিতে হবে?
হ্যাঁ, অবশ্যই দিতে হবে। বিদেশি ক্লায়েন্টরা সাধারণত বাংলাদেশি ট্যাক্স আইন অনুযায়ী উৎসে কর (TDS) কাটেন না। কিন্তু আপনি বাংলাদেশে বসবাস করে এই আয় করছেন বলে এটি বাংলাদেশে করযোগ্য। আপনার মোট আয় করমুক্ত সীমা অতিক্রম করলে আপনাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে আয়কর রিটার্ন ফাইল করে কর পরিশোধ করতে হবে।
আমার বার্ষিক আয় ৫ লাখ টাকা। করমুক্ত সীমা ৩.৫ লাখ টাকা। আমি কি শুধু ১.৫ লাখ টাকার উপর কর দেব?
হ্যাঁ, মূলনীতি ঠিক তাই। আপনি করমুক্ত সীমার ঊর্ধ্বের আয়ের উপর কর দেবেন। তবে, শুধু আয়ের পরিমাণ নয়, কর স্ল্যাব অনুযায়ী কর নির্ধারিত হয়। প্রথম ৩.৫ লাখ টাকার উপর কর শূন্য। পরবর্তী ১ লাখ টাকার উপর ৫%, তার পরের ৩ লাখ টাকার উপর ১০% – এভাবে কর স্ল্যাব প্রযোজ্য হবে। আপনার ক্ষেত্রে প্রথম ৩.৫ লাখ করমুক্ত। পরবর্তী ১.৫ লাখ টাকার প্রথম ১ লাখে ৫% (৫,০০০ টাকা) এবং বাকি ৫০,০০০ টাকায় ১০% (৫,০০০ টাকা)। মোট প্রাপ্য কর ১০,০০০ টাকা। তবে, বিনিয়োগের ছাড় (জীবন বীমা, পিএফ ইত্যাদি) দাবি করলে এই কর আরও কমতে পারে।
আমি কি আমার ল্যাপটপ ক্রয়ের পুরো খরচ একবারেই আয় থেকে বাদ দিতে পারব?
সাধারণত পারবেন না, যদি না এটি খুব ছোট খরচ হয়। ল্যাপটপ, প্রিন্টার, ক্যামেরার মতো মূলধনী সম্পদ (Capital Asset)। এগুলোর খরচ একবারে না কেটে, সম্পদের ব্যবহারযোগ্য জীবনকাল ধরে বার্ষিক অবচয় (Depreciation) হিসাবে দাবি করতে হয়। NBR বিভিন্ন ধরনের সম্পদের জন্য নির্দিষ্ট অবচয় হার (যেমন কম্পিউটার হার্ডওয়্যারের জন্য সাধারণত ৩০%) নির্ধারণ করে। একজন রেজিস্টার্ড হিসাবরক্ষক বা কর পরামর্শকের সাহায্য নেওয়া ভালো এই হিসাবের জন্য।
আমি ফ্রিল্যান্সার হিসেবে রেজিস্টার্ড নই। ট্যাক্স রিটার্ন দিতে পারব?
হ্যাঁ, অবশ্যই পারবেন। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে রেজিস্ট্রেশন (যেমন BASIS, e-CAB এর সদস্য হওয়া) ট্যাক্স রিটার্ন ফাইলের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। আপনার যদি করযোগ্য আয় থাকে (বিভিন্ন উৎস থেকে বার্ষিক মোট আয় করমুক্ত সীমা ছাড়িয়ে যায়), তাহলে আপনাকে আইনত টিন নম্বর নিয়ে আয়কর রিটার্ন ফাইল করতে হবে, আপনি রেজিস্টার্ড ফ্রিল্যান্সার হোন বা না হোন। আপনার আয়ের উৎসই (ফ্রিল্যান্সিং) নির্ধারণ করে আপনি কোন ফর্ম (IT-10GA) ব্যবহার করবেন।
ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়ার পর রিফান্ড পেতে কতদিন লাগে?
সাধারণত, যদি আপনার রিটার্নে রিফান্ড প্রাপ্য দেখায় (যেমন, উৎসে কর বেশি কাটা পড়েছে), এবং রিটার্নটি ত্রুটিমুক্ত হয়, তাহলে প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে ২ থেকে ৬ মাস সময় লাগতে পারে। রিফান্ড সরাসরি আপনার e-TIN পোর্টালে রেজিস্টার্ড ব্যাংক একাউন্টে জমা হবে। দেরি হলে e-TIN পোর্টালে “রিফান্ড স্ট্যাটাস” চেক করুন বা সংশ্লিষ্ট কর অফিসে যোগাযোগ করুন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।