এ কে এম খায়রুল বাশার বুলবুল, বাসস: বরগুনার ফ্রিল্যান্সার নাদিম। ভার্চুয়াল বিশ্বের পণ্য বাজারে শীর্ষ মাপের পরিচিতি যার। ঘরে বসে কাজ করেই কোটিপতি এখন। তরুন উদ্যোক্তা নাদিম সম্ভাবনার আইকন হয়ে দাঁড়িয়েছে এই মফস্বল এলাকার। পুরো নাম তানবীর মোরশেদ নাদিম। শিক্ষক পিতা-মাতার সন্তান নাদিমের বাড়ী আমতলী উপজেলা শহরে। এই ছোট্ট শহরটিতে বসেই তার যত নাম যশ আয় উপার্জন।
নাদিম ২০০২ সালে আমতলী এম ইউ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি এবং ২০০৫ সালে আমতলী ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি স¤পন্ন করেন। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পবিপ্রবি) থেকে ক¤িপউটার সায়েন্সে বিসএসসি (সিএসই) স¤পন্ন করে ২০১০ সালে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন। বর্তমানে পুরোদমে ফ্রিল্যান্সিং এর মাধ্যমে সম্মানজনক আয় করছেন। সিএসই পাশ করে ইঞ্জিনিয়ার হয়েও গতানুগতিক চাকুরী পেশায় না গিয়ে ফ্রিল্যান্সিংকে একমাত্র ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেয়া নাদিমের গল্প বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ডিজিটাল ফ্রিল্যান্সারদের জন্য আশা জাগানিয়া।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন স¤পন্ন করে নাদিম চাকরি করাটা মন থেকে মেনে নিতে পারছিলেন না। অন্যদিকে ক¤িপউটার সায়েন্স থেকে পাশ করেও চাকুরী করবে না, এমনটি মেনে নিতে পারছিলেন না নাদিমের পরিবার ও শুভাকাঙ্খীরা। ধরাবাঁধা চাকুরীর প্রতি অনীহা ছিলো বরাবরই। তাই স্বাধীনচেতা নাদিম চাকুরির পেছনে ছোটেননি।
২০১০ সালের শেষ দিকের ঘটনা। সে সময়ে বিশ্বের জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্কের নাম ছিলো ‘ওডেস্ক’। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ওডেস্কের বিষয়ে কিছুটা ধারণা পেয়ে সেখানে একাউন্ট তৈরির মাস দেড়েকের মধ্যেই জুটে যায় ২৫০ ডলারের একটি অর্ডার। ফ্রিল্যান্সিং স¤পর্কে একটু-আধটু ধারণা পাওয়া অনভিজ্ঞ একজন মানুষের কাছে একই সাথে ছিল ঈর্ষণীয় এবং উৎসাহের ব্যাপার। যথারীতি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করে পেমেন্ট একাউন্টে জমা হলেও তুলতে গিয়ে ঘটে বিপত্তি। এরপর কিছুটা সময় কাজ বন্ধ রাখলেও একটা সময়ে পুরোদমে কাজ শুরু করেন নাদিম। প্রথম অর্ডারটি ২৫০ ডলারের হলেও এরপর তাকে পঁচিশ সেন্টের কাজও করতে হয়েছে প্রতিঘণ্টা হিসেবে। পঁচিশ সেন্ট থেকে কাজ শুরু করে এখন প্রতি ঘণ্টায় ২০ ডলার পর্যন্ত কাজের সুযোগ পান নাদিম। পরে চুক্তিভিত্তিক ইউএসএ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের বায়ারদের কাজ করার সুযোগ হয় তার।
একাজে গুগল ছিলো তার শিক্ষক। নাদিম কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন। নাদিম জানায় “যখনই সমস্যায় পড়েছি, তখনই গুগলকে প্রশ্ন করেছি। গুগলও ঠিকঠাক উত্তরই দিয়েছে। গুগল ইজ দ্য বেস্ট টিচার। গুগলের ব্যবহার সঠিকভাবে জানলে কোনো ধরণের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে না গিয়েও সফলভাবে কাজ শেখা এবং করা সম্ভব।” বায়ারদের চাহিদার ভিত্তিতে দীর্ঘসময় ধরে নাদিম মার্কেটপ্লেসে যে কাজগুলো করছে তাঁর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ওয়ার্ডপ্রেস থিম কাস্টোমাইজেশন, ই-কমার্স, শপিফাই ওয়েব ডিজাইন এন্ড ডেভেলপমেন্ট, ইয়াহু স্টোর, ওপেন কার্ট, বিগ কমার্স, ইবে এ্যান্ড অ্যামাজন, এসইওসহ মোটামুটি সব ধরনের কাজের অভিজ্ঞতা আছে তার। নাদিম ইতোমধ্যে দুইশ’র বেশি কাজ মার্কেটপ্লেস থেকে স¤পন্ন করেছেন এবং এর বাইরেও চুক্তিভিত্তিক কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। দুইশ’র বেশি বায়ারদের ফাইভ স্টার রিভিউ পেয়েছেন।
আপওয়ার্কের তিনটি একাউন্টে প্রায় ৩০ হাজার ঘণ্টা কাজের পাশাপাশি ভার্চুয়াল এজেন্সির মাধ্যমেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কাজের রেকর্ড রয়েছে নাদিমের। আর এইগুলো থেকে প্রায় এক লাখ পঞ্চাশ হাজার মার্কিন ডলার আয় করেছেন ২০১১ সাল থেকে।
কাজের ধরণ অনুযায়ী বিভিন্ন স্তর রয়েছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্কের। সর্বোচ্চ স্তরটি হচ্ছে ‘টপ রেটেড প্লাস’। শীর্ষস্থানীয় এই মার্কেটপ্লেসের বর্তমানে টপ রেটেড প্লাস স্তরে তানবীর মোরশেদ নাদিমের অবস্থান। এ ছাড়াও অন্যান্য প্রোফাইলগুলোও তার টপ রেটেড।
সফটওয়্যার ফ্রি ল্যান্সিং এ বেড়ে ওঠা অভিজ্ঞতার বছরগুলো নাদিমের জন্য খুব মসৃন ছিলো না। অনেক চড়াই উৎরাই এর মধ্যে দিয়ে পার হতে হয়েছে তাকে। তারই মতো আরেকজন ফ্রি ল্যান্সার আব্দুর রহমান নাদিম সম্পর্কে বলেন, ২০১৩-১৪ সালে ফ্রিল্যান্সিং এ হাতেখড়ির পর মোটামুটিভাবে কাজ করে গেলেও পরিচিতিজনদের বোঝা যাচ্ছিল না যে সে কি কাজ করছে। একটা সময় পরে যখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ক লেখালেখি শুরু হয় তখন ভিজিটিং কার্ডে ‘ফ্রিল্যান্স সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার’ লিখে পরিচয় সংকট কাটানোর কিছুটা চেষ্টা করেন নাদিম। ভিজিটিং কার্ডে শুধুমাত্র ‘ফ্রিল্যান্সার’ লেখার সাহস দেখানো সম্ভব হয়নি। তখনও ফ্রিল্যান্সিং শব্দটা অতটা পরিচিতি লাভ করেনি। ফ্রি-ল্যান্সার নিয়ে কাজ করছে এমন একটি সংগঠন পিপলস ভয়েস অব আমতলীর প্রধান নির্বাহি শাহাবুদ্দিন পাননা বলেন, সফল ফ্রিল্যান্সার নাদিমের আজকের অবস্থান সফলতায় পূর্ণ হলেও এই পর্যায়ে আসতে তাকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। যারা এই কাজ করতে আগ্রহী তাদের সব চেয়ে বেশি থাকতে হবে ধৈর্য্য ও অধ্যাবসায়।
বাসস’র সাথে আলাপকালে নাদিম নতুনদের উদ্দেশ্যে বলেন, মার্কেটপ্লেসে খুব সহজেই একাউন্ট তৈরি করা গেলেও, নতুনরা যারা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে এই মাধ্যমে আসতে চান, তারা যেন এক্ষেত্রে পুরোপুরিভাবে দক্ষতা অর্জন করে তারপর আসেন। তা না হলে হাজার হাজার ডলার আয় করার স্বপ্ন নিয়ে এই মাধ্যমে এসে এর বিপরীত অভিজ্ঞতা নিয়ে আশাহত হয়ে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনা আছে। এছাড়া ¯েপাকেন ইংলিশে মিড লেভেল এবং রাইটিং এ বেসিক লেভেলের জ্ঞানটাও থাকা দরকার।
তা না হলে বিভিন্ন দেশের বায়ারদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে অসুবিধা হবে। যা ক্যারিয়ারের ধ্বংসের অন্যতম কারণ হয়ে উঠতে পারে। তাই পুরোপুরি দক্ষ না হলে ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার হতে পারে অপ্রত্যাশিত রকমের স্বপ্নভঙ্গের কারণ।
নিজের প্রতিষ্ঠা করা সফটওয়্যার ফার্ম ‘ন্যানোসফট’ থেকে লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে চলছে নাদিম।
বরগুনার সাবেক সাংসদ ও বর্তমান জেলা চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন বলেন, আধুনিক তথ্য প্রযুক্তির জগতে বাংলাদেশের তরুনরা ভালো কাজ করছে। তবে সেই সুযোগ ও সুবিধা প্রাপ্যতা শহর অঞ্চলেই বেশি। বরগুনার আমতলী শহরের মতো ছোট্ট একটি জায়গা থেকে নাদিম আজকে যে পেশাগত নির্ভরতার অবস্থানে পৌঁছেছে তাতে তার অধ্যাবসায় তো রয়েছেই কিন্তু সুযোগটা করে দিয়েছে প্রযুক্তি বান্ধব সরকার। সরকারের ডিজিটাইজেশনের সুবিধায় বরগুনায় নাদিমের মতো আরও উদ্যোক্তা তৈরী হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।