শাশ্বত টিটো: ‘ভ্রমণ থেকেই হয় ভ্রমণ কাহিনী। কিন্তু ভ্রমণকারীদের সকলের হাত দিয়ে নয়।’
অন্নদাশঙ্করের এই কথা টেনে বলি ভ্রমণসাহিত্য সবাই হাজির করতে পারে না। সাহিত্য যেমন নানা অর্থ প্রকাশক (ওষুধের বিবরণও literature) ভ্রমণ রচনাও নানা ধাঁচের। বলতে পারি, যে-ভ্রমণরচনা আকর্ষণীয় পাঠযোগ্যতায়, জীবন পর্যবেক্ষণে, প্রকৃতি অবলোকনে, এবং বারংবার পড়ার কৌতূহল জাগিয়ে তোলে, সেটিকেই বলা চলে ভ্রমণ-সাহিত্য। বেড়ানোর প্রসঙ্গকথা হলেই চলবে না, সাহিত্যের স্বাদ চাই, তবেই আসে বেড়ানোর মতো, সাহিত্যপাঠে হাওয়াবদলের স্বাদ।
ভ্রমণ-তথ্য সর্বস্ব হলে রচনা ঝোঁকে গাইডবুকের দিকে, চরিত্র ও কাহিনী-বর্ণনা যদি বড়ো হয়ে ওঠে তাহলে তা হয়ে ওঠে ভ্রমণ-উপন্যাস। প্রবোধ সান্যালের ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, অবধূতের ‘মরুতীর্থ হিংলাজ’ ভ্রমণ-উপন্যাস।
এ প্রসঙ্গে বলা চলে উপন্যাসের নামকরণে ‘ভ্রমণ’ কথাটি বহু ব্যবহৃত। যেমন – জোনাথন সুইফট এর ‘Gulliver’s Travels’, স্টিভেনসন এর ‘Travels with a Donkey’ বানিয়ান এর ‘Pilgrim’s Progress’ (১৬৭৮), গ্রাহাম গ্রীন-এর ‘Travels with my Aunt’ (১৯৬৯) প্রভৃতি। বাংলায় কৃষ্ণকমল ভট্টাচার্য রচিত ‘দুরাকাঙ্খের বৃথা ভ্রমণ’ (১৮৫৮) কিন্তু উপন্যাস। অনেকেই জানেন শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ বইটি ধারাবাহিক বার হবার সময় নাম ছিল— ‘শ্রীকান্তের ভ্রমণ কাহিনী’। এ দুটি বই কিন্তু ভ্রমণসাহিত্য নয়। এই প্রসঙ্গে বলে নেওয়া যাক, অনেকে সাহিত্যিক হতে ভ্রমণকথা লিখেছেন কিন্তু ভ্রমণ-সাহিত্য লিখে স্বীকৃতি পেতে হলে সাহিত্যিক হতে হবে এমন কথা নেই। জলধর সেন, রবীন্দ্রনাথ, বিভূতি বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্নদাশঙ্কর, মুজতবা প্রভৃতি জনপ্রিয় ভ্রমণসাহিত্য উপহার দিয়েছেন। কিন্তু জগদীশচন্দ্র, বিবেকানন্দ, রামনাথ বিশ্বাস, প্রভৃতির ভ্রমণসাহিত্য, আমাদের সাহিত্য পাঠের অনুভব, জীবন ও প্রকৃতি পর্যবেক্ষণের মন্তব্যে বারংবার পাঠে আগ্রহী করে তোলে। ভ্রমণ-সাহিত্য, সে সাহিত্যিক লিখুন আর অন্য কেউ লিখুন সে লেখাকে হতে হবে ভ্রমণ-কাহিনী, কিন্তু সাহিত্য গুণান্বিত।
ভ্রমণকথা সব সাহিত্যেই সুপ্রাচীন, অনেক সাহিত্যে ভ্রমণ মোটিফ থাকে – এ দুটো আলাদা প্রসঙ্গে আমরা যাচ্ছি না। কালানুক্রমিক ভ্রমণসাহিত্য আলোচনায় যাব না, একটি ভ্রমণ বিষয়ক কাহিনী গ্রন্থ নিয়েই আমার আজকের আলোচনা। আমি কোনকালেই ভ্রমণ বিষয়ক গ্রন্থের তেমন পাঠানুরাগী ছিলামনা। তবে বিভিন্ন দৈনিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকায় ভ্রমণবিষয়ক কাহিনীগুলো পড়তাম, তবে তেমনভাবে কখনো গল্পের সাথে সংযোজিত হতে পারিনি। প্রায় সব কাহিনীতে লেখক কিভাবে ঐজায়গায় গিয়েছেন বা উল্লেখিত স্থানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের বর্ণনাতে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তাই কাহিনীগুলো কেমন যেন গৎবাঁধা ভঙ্গিতে বর্ণিত হয়েছে। তবে কিছুদিন আগে ফয়সাল আহমেদের লেখা ‘বাংলার পরিব্রাজক’ বইটি আমাকে অন্যরকম গল্পের স্বাদ দিয়েছে। লেখক ফয়সাল আহমেদ তাঁর কাহিনীতে গল্পের ভিতরে অন্য গল্প শুনিয়েছেন, আমাকে অনুভূতি দিয়েছেন উল্লেখিত স্থানের সৌন্দর্যে এবং ইতিহাসে।
সাহিত্য সৃষ্টিতে যেমন প্রতিভার প্রয়োজন হয় তেমনি সাহিত্য সমালোচনা বা গ্রন্থ পর্যালোচনাও সোজা কাজ নয়, তাতেও প্রতিভার প্রয়োজন হয়, অনুশীলনের প্রয়োজন হয়, প্রয়োজন হয় যথার্থ এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির। গ্রন্থ সমালোচনা করার মতো প্রতিভা আমার নেই কিন্তু কোন কিছু পড়ার আনন্দ আমি অনুভব করি যদি উল্লেখিত রচনা বা গ্রন্থে সেই আনন্দের উপকরণ থাকে। আমি নিঃসন্দেহে বলতে ‘বাংলার পরিব্রাজক’ সেই আনন্দ আমাকে দিয়েছে। নিঃসন্দেহে ধন্যবাদ প্রাপ্য লেখক ফয়সাল আহমেদের।
লেখক ফয়সাল আহমেদের ‘বাংলার পরিব্রাজক’ শীর্ষক ভ্রমণ কাহিনীগুলো মূলত: বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের গল্প। ‘গল্প’ শব্দটা আমি সচেতনভাবে ব্যবহার করছি। কারণ বইটি পড়তে পড়তে আমি যেমন ইতিহাসে হারিয়ে গেছি, তেমনি গল্পের স্বাদ পেয়েছি। পড়তে পড়তে আমার কখনোই মনে হয়নি, আমি কোনো ভ্রমণ বিষয়ক কাহিনী পড়ছি। লেখক বাংলার ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং প্রকৃতিক সৌন্দর্য্য নিখুঁতভাবে অঙ্কিত করেছেন তাঁর কলম দিয়ে। লেখক কাহিনীগুলো বর্ণনা করেছেন ‘ঢাকার কাছে’, ‘ঢাকা থেকে দূরে’, ‘ব্রহ্মপুত্র নদ ও গারো পাহাড়’, ‘উত্তরের জনপদে’, ‘দক্ষিণের যাত্রী’, ‘দক্ষিণ-পশ্চিমের বাতিঘর’, ‘দুটি পাতা, একটি কুঁড়ির দেশে’, ‘পাহাড় থেকে সমুদ্র’ শীর্ষক শিরোনামে। যেকোন পাঠক শিরোনামগুলো পড়লেই বুঝতে পারবেন যে লেখক কতটা যত্নসহকারে পুরো বাংলাদেশকে তুলে ধরেছেন তাঁর ভ্রমণ কাহিনীতে।
সাধারণতঃ ভ্রমণকারীর অভিজ্ঞতার গল্প সুখপাঠ্য হয়ে উঠলে সেটাকে ভ্রমণ কাহিনি বলা যায়। আর ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তথ্য, স্থানিক বিবরণ ইত্যাদি যখন আবেগ অনুভূতির স্পর্শে, ভাষার ঐশ্বর্যে, দার্শনিক জিজ্ঞাসায় ব্যক্তিগত কল্পিত স্তর থেকে উত্তীর্ণ হয় সব মানুষের আস্বাদন ও উপলব্ধির স্তরে তখন তাকে বলা হয় ভ্রমণ উপন্যাস। এ কথা অনস্বীকার্য যে, ভ্রমণ বৃত্তান্ত, ভ্রমণ কাহিনি, ভ্রমণ সাহিত্য, ভ্রমণ উপন্যাস ইত্যাদির একটিকে অন্যটি থেকে নিশ্চিতভাবে পৃথক করে ফেলা অনেক ক্ষেত্রেই অত্যন্ত কঠিন। ভ্রমণ বৃত্তান্তকে যিনি ভ্রমণ উপন্যাস মূল্যে মূল্যবান করতে চান তাঁকে এক নিরপেক্ষ ও সহৃদয় মানসিকতা নিয়ে স্থান-কাল, পাত্র-পাত্রীদের দেখতে হবে। কোনো বিশেষ অঞ্চলের প্রকৃতি, সমাজ ও মানুষের জীবনযাত্রার টুকরো টুকরো ছবির মধ্যেই নিরাসক্তভাবে লেখক দেখবেন ও দেখাবেন সত্য ও সুন্দরকে। তাই ভ্রমণ কাহিনি ও ভ্রমণোপন্যাস বিষয় ও রীতির দিক থেকে সমগোত্রীয়। শুধু ভ্রমণ কাহিনির সঙ্গে লেখকের নিজের মানসিকতা ও দৃষ্টিভঙ্গির কল্পিত অভিজ্ঞতা যখন মিলিত হয় তখন তাকে সরাসরি ভ্রমণ কাহিনি না বলে ভ্রমণ উপন্যাস বলা হয়। লেখক ফয়সাল আহমেদের ‘বাংলার পরিব্রাজক’ আমার মতে একটা পরিপূর্ণ ভ্রমণ কাহিনী। একই সাথে বলতে হয়, নাজমুল হক পাভেলের প্রচ্ছদ চমৎকার ও পরিশীলিত। বইটির প্রকাশক ‘বিশ্ব নাগরিক’।
বইমেলায় নিরুর গল্পগ্রন্থ ‘৩০ পয়সার ৩ লক্ষ স্মৃতি’র মোড়ক উন্মোচন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।