জুমবাংলা ডেস্ক : প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো নড়াইলের টেংরাখালীর মাঘী পূর্ণিমা মেলার পাশাপাশি বহু বছর আগ থেকেই গড়ে উঠেছে বউমেলা। উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপিত হলো প্রাচীনতম ‘বউমেলা’। মূল মেলার পরের দিন একই স্থানে বউমেলায় পুরুষরা ঢুকতে পারেন না। তাই এ মেলায় নারী শিশুরা নির্বিঘ্নে কেনাকাটা করতে পারেন। শুধু তা-ই নয়, এই মেলার অনেক বিক্রেতাও নারী।
নড়াইলের সদর উপজেলার সিঙ্গাশোলপুর ইউনিয়নের বড়কুলা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মাঘী পূর্ণিমা উৎসবে বৃহস্পতিবার সকালে বউমেলা অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে বুধবার একই স্থানে ঐতিহাসিক মাঘী পূর্ণিমা মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এ মেলা উপলক্ষে মেয়ে জামাই ও আত্মীয়স্বজনদের নিয়ে মেতে উঠেন হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাবাসী। মেলা উপলক্ষে এলাকায় চলে নানান আনন্দ উৎসব। চিত্রা নদীর উপশাখা তীরে টেংরাখালী ডোবে (বিল) অনুষ্ঠিত এ মেলায় হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।
ধর্মীয় শাস্ত্রমতে, প্রতিবছর নিয়মিত বড়কুলা গ্রামের ঐতিহ্যবাহী টেংরাখালী হাজরাতলা সার্বজনীন মন্দিরে মাঘী পূর্ণিমা উৎসব উদযাপিত হয়। মাঘী পূর্ণিমার দিনে অতীত জীবনের পাপ মোচনসহ পূণ্যলাভের আশায় হাজার হাজার ভক্ত নর-নারী ও শিশু কিশোর মন্দির ঘেঁষা পুকুরে স্নান করেন।
অপরদিকে এ উপলক্ষে প্রতি বছর ওই মন্দিরের সন্নিকটে টেংরাখালী ডোবের প্রায় ২৫ বিঘা পতিত জমিতে বিশাল মেলা বসে। এ মেলার বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে শেষদিনে বউমেলা বসে।
স্থানীয়রা জানান, পুরনো এই মেলায় ঐতিহ্য ধরে রাখতেই মেলার আয়োজন অব্যাহত আছে। বাংলা বছরের মাঘী পূর্ণিমা উপলক্ষে এই মেলা বসে। দুই দিনব্যাপী এ মেলার প্রথম দিনে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ অংশ নেন। দ্বিতীয় দিনের সকাল থেকে ‘বউমেলা’ শুরু হয়। তবে ওমিক্রন সংক্রমণের কারণে এবার বউমেলার সময়সীমা দুপুর ১২টা পর্যন্ত করা হয়।
মেলা উপলক্ষে আশপাশের গ্রামগুলোর বাড়ি বাড়ি শুরু হয় উৎসব। মেলাকে কেন্দ্র করে জামাইদের দাওয়াত করে আনা হয় শ্বশুরবাড়িতে। প্রতিটি বাড়িতে বউ-জামাই বেড়াতে আসেন। এ ছাড়া তাদের আত্মীয়স্বজনকেও নিমন্ত্রণ করে বাড়িতে আনা হয়। পুকুরের বড় বড় মাছ রান্না করা হয় জামাইদের আপ্যায়নের জন্য।
এ মেলায় নেই কোনো চাকচিক্য কিংবা আধুনিক সাজসজ্জা। কিন্তু গ্রামীণ আবহে সত্যিকারের আনন্দ যাকে বলে তারই স্বচ্ছ প্রতিচ্ছবি যেন এই মেলা। যার বেশীর ভাগ দর্শনার্থী নারী। এ জন্য এটি বউমেলা নামে পরিচিত।
জমজমাট হয়েছে টেংরাখালীর বহু আলোচিত ‘বউমেলা’। মেলার মূল অংশে পুরুষদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। খোলা টেংরাখালী মেলাজুড়ে উপচেপড়া ভিড়। মেলায় সব ধর্মের মানুষের মহামিলন ঘটে।
বউমেলায় পুরুষদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিষিদ্ধ থাকায় দৃষ্টির সীমানাজুড়ে শুধুই নারীদের চোখে পড়ে। নারী শিশুদের নিরাপত্তা বিধানে বেশ সজাগ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবক দল।
মেলায় আসা ছন্দা বিশ্বাস ও রেখা রাণী সরকার জানান, ‘পুরোনো স্মৃতির পটভূমিতে নতুন করে আঁচড় কাটে মেলাটি। তাই বছর ঘুরে এ দিনটির জন্য অপেক্ষায় থাকি।’
টেংরাখালী হাজরাতলা মন্দিরের পুরোহিত ক্ষিতিশ চন্দ্র বিশ্বাস জানান, ‘মেলায় বউ-ঝিরা কেনাকাটা করতে আসেন বলেই এর নাম দেওয়া হয়েছে বউ মেলা। মেলার মূল অংশে পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ। জনশ্রুতি আছে ৫০০ বছরেরও অধিক সময় ধরে এই মেলার আয়োজন করে আসছেন পূর্ব পুরুষেরা। করোনার কারণে এবার ভারতসহ দেশের দূরবর্তী স্থান থেকে পূণ্যার্থীরা ও দর্শনার্থীরা আসতে পারেননি।
মেলায় আসা সোনিয়া নামের এক গৃহবধূ জানান, আমার বিয়ে হওয়ার পর থেকে প্রতিবারই এ মেলাতে এসেছি। এটা শুধু মেলা নয়, উৎসব। এই দিনটির জন্য আমরা বছরজুড়ে অপেক্ষা করি। মেলাটিতে শুধু নারীদের আগমন থাকায় কেনাকাটা, ঘোরাফেরাতে আনন্দ পাই।
মেলার আয়োজক কমিটির অন্যতম সদস্য ভক্ত দাস মল্লিক জানান, গ্রামীণ ঐতিহ্য ধরে রাখতে তারা যুগ যুগ ধরে শান্তিপূর্ণভাবে মেলাটির আয়োজন করে আসছেন। প্রথম দিনে দিনভর সর্বসাধারণের মেলা চলার পর শেষদিনে ‘বউমেলা’ অনুষ্ঠিত হয়। পুরুষবিহীন মেলাতে নারীরা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। যে কারণে তাদের কথা চিন্তা করেই বউমেলার আয়োজন করা হয়। সকাল থেকেই মেলা প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে। পুরো এলাকায় এক উৎসবমুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয় বউমেলা ঘিরে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।