জুমবাংলা ডেস্ক: এক যে ছিলেন রানি। তার ঘোড়াশালে ঘো়ড়া, গাড়িশালে গাড়ি। দেশময় জমি আর প্রাসাদ। তার রূপকথার মতো বিয়ে। চার ছেলেমেয়ে। সেখানেই শুরু সমস্যা। রাজপাট বা রানিপাট ১৯৫২ সাল থেকে। ৭০ বছরের রাজত্ব। তার মধ্যে অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে টেমস নদীতে। ছেলেমেয়েদের নিজেস্ব জগৎ হয় সময়ের অমোঘ সূত্র ধরে। প্রতিটি ছেলেমেয়েকে নিয়েই তৈরি হয় বিতর্ক।
বড় ছেলে চার্লস বড় মাথাব্যথা। চার্লস বাঁচেন সার নিয়ে। জৈবিক সারের বদলে রাসায়নিক সার ব্যবহারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন। সে সব কিছু দিন চলার পর আবার উঠেপড়ে লাগেন স্থপতিদের বিরুদ্ধে। আধুনিক স্থাপত্য তার অপছন্দ। ২০০ বছরের পুরনো রীতি ফিরিয়ে আনতে চাইলেন তিনি। তবে দেশটা ইংল্যান্ড। তার প্রলাপে তাই কেউ বিচলিত হলেন না।
চার্লস বিয়ে করলেন সুদর্শনা এক তরুণীকে। তবে প্রাক্তন বান্ধবীদের সঙ্গ পরিহার করলেন না। যুবরানি আজকালকার মেয়ে। এসব মেনে নেবেন কেন! তার বিখ্যাত উক্তি, ‘আমাদের বিয়েতে তিন ব্যক্তি ছিলেন।’ সম্পর্কে চিড় ধরলে তার নানা রকম প্রতিক্রিয়াও হয়। ইংল্যান্ডের যুবরানির ক্ষেত্রেও ততটাই সত্যি।
শেষ পর্যন্ত বিয়েটি ভাঙল। তার আগে পরিবারের সুকথা-কুকথা ইংল্যান্ডের কাগজগুলো সোৎসাহে প্রচার করল। কাগজগুলো রাজপরিবারের সদস্যদের ব্যক্তিগত টেলিফোন ‘ট্যাপ’ করত। এবং কথোপকথনের বিবরণ প্রকাশ করত। সেখানে এই পর্যন্ত শোনা গিয়েছে যে, যুবরাজ চার্লস নাকি বান্ধবী ক্যামিলাকে বলেছেন, ‘আমি যেন পরের জন্মে তোমার ট্যাম্পান হয়ে জন্মাতে পারি।’ বোঝা গেল, রাজাই হোক বা প্রজা, সম্পর্কের অমোঘ নিয়মের ব্যতিক্রম কেউ নন। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো স্বার্থপর ও তুচ্ছ চর্চা নিয়েই তাদের বসবাস।
এভাবেই চলে যেত হয়তো। কিন্তু ইংল্যান্ডের বড়় ঘরের বড় কথা নিয়ে অধিবাসীদের উৎসাহের অন্ত নেই। কৌতুহল যেখানে আছে, সেখানে সংবাদপত্রও আছে। বিলেতের সাংবাদিকরা আগ্রাসী। হিংস্র নেকড়ের মতো ঝাঁপিয়ে পড়েন নতুন কোনও কেচ্ছার গন্ধ পেলেই। কৌতূহলের উৎস বার করতে যে হবেই! যুবরানি ডায়ানা এক বার মজা করে সে দেশের সম্পাদকদের বলেছিলেন, ‘এ কথা অস্বীকার করতে পারবেন না যে আমি আপনাদের সমৃদ্ধির একটা উৎস।’
সমৃদ্ধির উৎস হওয়ার অবশ্য নানা রকম ফ্যাচাং আছে। নেটফ্লিক্সে রাজপরিবার নিয়ে একটা সিরিয়াল হয়েছিল। ডায়ানা এবং চার্লসের দ্বিতীয় ছেলে হ্যারি খুব শীঘ্রই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেন। ‘দ্য ক্রাউন’ সিরিজ় দেখায় যুবরানি ডায়ানার সঙ্গে পরিবারের দূরত্ব তৈরি হওয়া। বিচ্ছেদের পর অনেক ক্ষেত্রেই যেমন হয়। রাজপরিবারও সে সবের ঊর্ধ্বে নয়। ১৯৮১ সালে চার্লসের বিয়ে হয় ডায়ানার সঙ্গে। ১৯৮২ সালে জন্ম হয় চার্লস-ডায়ানার প্রথম সন্তান উইলিয়ামের। দুই বছর পর ১৯৮৪ সালে উইলিয়ামের ভাই হয়। নাম দেওয়া হয় হ্যারি। সেই হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগানই এখন চর্চার কেন্দ্রে। রাজপরিবারের কেচ্ছার মূলস্রোতে এখন তারাই।
তৎকালীন আইন অনুযায়ী শুধু রাজপরিবার নয়, যেকোন সামন্ততান্ত্রিক পরিবারেই প্রতি প্রজন্মে বড় ছেলেই হন উত্তরাধিকারী। আর কারও কোনও অধিকার থাকে না। বিভিন্ন দেশে এই ‘ল অফ প্রাইমোগেনিচার’ স্বীকৃতিও পেয়েছে। সেই নিয়মে ব়ড় সন্তান ও তাঁর পরিবারকেই রাজপরিবারের তরফে নানা কর্তব্য পালন করতে বেশি দেখা যায়। গোটা দুনিয়া সেই পরিবারকেই চেনে রাজপরিবারের ‘প্রতিনিধি’ হিসাবে। পত্রপত্রিকায় তাদের ছবিই বেশি দেখা যায়। রাজা বা রানির বাকি পুত্র-কন্যারা ততটা প্রচারের আলোয় থাকেন না।
এক কালে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকতেন উইলিয়াম ও হ্যারি। রাজপরিবারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন তারা। ভবিষ্যতের রাজার দুই পুত্র। এখন হিসাব একটু বদলে গিয়েছে। রাজার ছেলে বটে হ্যারি। কিন্তু গুরুত্বে উইলিয়ামের পরিবার এগিয়ে গিয়েছে। কারণ, ভবিষ্যতের রাজা যে তিনিই! তাই ঠাকুরমার মৃত্যুর পর বাবা রাজা হলে উইলিয়াম হয়েছেন ‘প্রিন্স অফ ওয়েল্স’। তার স্ত্রী কেট এখন ‘প্রিন্সেস অফ ওয়েল্স’। তিনি ভবিষ্যতের রানি। হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগান রয়ে গেলেন সেই সাসেক্সের ডিউক এবং ডাচেস হয়েই।
‘প্রিন্স অফ ওয়েল্স’ উপাধি হয় তাদেরই, যারা পরে রাজা হবেন। প্রিন্স অফ ওয়েল্সের স্ত্রী পান ‘প্রিন্সেস অফ ওয়েল্স’-এর উপাধি। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু পর্যন্ত তৃতীয় চার্লস ছিলেন প্রিন্স অফ ওয়েল্স। এলিজাবেথের পর রাজপাট পাওয়ার কথা ছিল তৃতীয় চার্লসের। সেই মতোই ১৯৫২ সালে মা রানি হওয়ার পরে ১৯৫৮ সালে তাকে ‘প্রিন্স অফ ওয়েল্স’ ঘোষণা করা হয়। ১৯৮১ সালে চার্লসের সঙ্গে বিয়ের পর ডায়ানা হন ‘প্রিন্সেস অফ ওয়েল্স’।
রানির মৃত্যুর পর ব্রিটেনের রাজা হন তৃতীয় চার্লস। তার কিছুদিন পরেই প্রিন্স এবং প্রিন্সেস অফ ওয়েল্স হিসাবে উইলিয়াম ও তার স্ত্রী কেটের নাম ঘোষণা করা হয়। রাজা হওয়ার দৌড়ে হ্যারির জায়গা উইলিয়ামের পরেই ছিল। কিন্তু প্রিন্স অফ ওয়েলসের এক পুত্র পরবর্তী সময়ে ‘প্রিন্স’ হলেন। আর অন্য জন থেকে গেলেন সেই ডিউক হয়েই! উন্নতি হল না পদে। উল্টে দাদার তিন সন্তানের জন্মের পর রাজপরিবারে তার অবস্থান আরো পিছিয়ে গেল। এককালে ছিলেন সিংহাসনের দৌড়ে তৃতীয় স্থানে, এখন তার স্থান পঞ্চমে। কারণ, এ ক্ষেত্রে রাজার বড় সন্তানের পরিবারই অগ্রাধিকার পায়। ফলে বড় সন্তান উইলিয়াম যদি কোনও কারণে ব্রিটেনের রাজা না-ও হন, তখন সঙ্গে সঙ্গে তার ভাই হ্যারির নম্বর আসবে না। উইলিয়ামের তিন সন্তান রাজপুত্র জর্জ, রাজকন্যা শার্লট এবং রাজপুত্র লুইস তাদের কাকার আগে সুযোগ পাবে।
কালের নিয়মে খবরের বাইরে চলে যাওয়ার কথা ছিল হ্যারির। তা হয়নি। এখন ভবিষ্যতের রাজা জর্জের কাকা এগিয়ে। সিংহাসনের দৌড়ে না থাকলেও রাজবাড়ির সবচেয়ে চর্চিত সদস্য হয়ে উঠেছেন তিনিই। সঙ্গে কাকি মেগান। মাঝেমাঝে চিত্রনাট্যের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে ঢুকে পড়ছে কাকা-কাকিমার বড় ছেলে আর্চিও।
তৃতীয় চার্লস রাজা হওয়ার কিছু দিন পরেই প্রিন্স এবং প্রিন্সেস অফ ওয়েল্স হিসাবে উইলিয়াম ও তার স্ত্রী কেটের নাম ঘোষণা করা হয়। রাজা হওয়ার দৌড়ে হ্যারির জায়গা উইলিয়ামের পরেই ছিল। উইলিয়াম যদি কোনো কারণে ব্রিটেনের রাজা না-ও হন, এ বার আর সঙ্গে সঙ্গে ভাই হ্যারির নম্বর আসবে না। সুযোগ পাবে উইলিয়ামের সন্তানরা।
ডিসেম্বরের ৮ তারিখে ‘হ্যারি অ্যান্ড মেগান: বিকামিং রয়্যাল’ শীর্ষক ওয়েব সিরিজ় নেটফ্লিক্সে দেখানো শুরু হতেই ব্রিটেনের রাজপরিবারের এই শাখাকে নিয়ে চর্চা বেড়েছে। ব্রিটেনের সাসেক্স শাখাই আপাতত দুনিয়া কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। সাসেক্সের এই ডিউকের মা ডায়ানা রানি হওয়ার আগেই ছিলেন রানির মতো জনপ্রিয়। তবে রানি হওয়া হয়নি ডায়ানার। ১৯৯৬ সালে হয় বিবাহবিচ্ছেদ। ১৯৯৭ সালে গাড়ি দুর্ঘটনায় মৃত্যু। ২০০৫ সালে চার্লসের বিয়ে হয় বহু কালের বান্ধবী ক্যামিলার সঙ্গে।
নানা সময়ে ধাপে ধাপে রাজ পরিবার থেকে নানা কেচ্ছার কথা বেরিয়ে এসেছে। তার অনেকগুলোর কেন্দ্রেই ছিল ডায়ানার সংসার। ক্যামিলার (চার্লসের দ্বিতীয় স্ত্রী। ব্রিটেনের বর্তমান রানি) সঙ্গে ডায়ানার স্বামী চার্লসের বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জর্জরিত থেকেছে রাজকুমারী ডায়ানার জীবনের অনেকটা সময়। দ্বিতীয় এলিজাবেথের জীবন নিয়ে তৈরি হওয়া ওয়েব সিরিজ় ‘দ্য ক্রাউন’ সে সব ঘটনার অনেকটাই দেখিয়েছে। তা ঘিরে তৈরি হয়েছে বিতর্কও। হ্যারি-মেগানকে নিয়ে তৈরি ওয়েব সিরিজ় ঘিরে যখন থেকে হইচই শুরু হয়, তার কিছু দিন আগেই নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে ‘দ্য ক্রাউন’-এর পঞ্চম সিজ়ন।
ঐ সিজ়নে ‘দ্য ক্রাউন’ ভরে রয়েছে ডায়ানা-চার্লসের বিচ্ছেদের সময়ের কাহিনি। ক্যামিলিয়ার সঙ্গে চার্লসের সম্পর্ক, ডায়ানার অবসাদ, রাজপরিবারের কারো সাহায্য না পাওয়া— সবই ফিরে ফিরে আসে ‘দ্য ক্রাউন’-এ। তাই সেই সিরিজ় বিতর্কিত। শোনা যায়, নতুন সিজ়নের মুক্তির আগে রীতিমতো চাপ এসেছিল রাজপরিবারের পক্ষে। হয়তো বা কিছু কিছু কাটছাঁটও করা হয়ে থাকবে।
সূত্র: আনন্দবাজার
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।