গোলাম মাওলা রনি : শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক ঘটনাবলি নিয়ে বাংলাদেশে যে অদ্ভুত উন্মাদনা সৃষ্টি হয়েছে তা আমি আমার ইহজন্মে দেখিনি বা শুনিনি। আমার এই ক্ষুদ্র জীবনে মুক্তিযুদ্ধ দেখেছি এবং ইতিহাসের প্রথম বিজয় দিবস দেখেছি। ১৯৭৫ সালের পূর্বাপর ঘটনা এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পূর্বাপর ঘটনা দেখেছি। খন্দকার মোশতাকের শাসন এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সামরিক শাসন দেখেছি। দেখেছি বাংলার ইতিহাসের কিংবদন্তির জনপ্রিয় রাষ্ট্রপতি জিয়ার উত্থানপর্ব, কর্ম এবং নির্মম মৃত্যু। এরশাদের উত্থান-পতন, নব্বই-পরবর্তী বিএনপি-আওয়ামী লীগের ক্ষমতার রাজনীতির উত্থান-পতনসহ কুখ্যাত ওয়ান-ইলেভেনের খলনায়কদের উত্থান-পতনের দৃশ্য। আমার জন্মের আগে বাংলার হাজার বছরের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রধানতম আলোচিত ঘটনাপঞ্জি পড়েছি, জেনেছি এবং সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি কল্পনার জগতে একটি দৃশ্যপট আঁকতে।
উল্লিখিত ঘটনাবলির সাথে যদি ২০০৯ সাল থেকে আজ অবধি আমার ব্যক্তিগত রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সংযুক্ত করি তবে এ কথা নিশ্চিত করে বলতে পারি যে, সব ঘটনার মধ্যেই একধরনের দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, রোমাঞ্চ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, হারানো কিংবা বঞ্চিত হওয়াসহ নানা রকম ট্র্যাজেডি-কমেডি, হরর এবং সাসপেন্স ছিল। তো সেসব অতীতের উপাখ্যান কেন যেন শ্রীলঙ্কার বর্তমান ঘটনার ব্যাপ্তিতে চাপা পড়ে যাচ্ছে। এক দল লোক বলছে- বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার চেয়েও ভয়াবহ পরিণতি হবে। অন্য দল বলছে- বাংলাদেশে কোনো দিনই শ্রীলঙ্কার ঘটনা ঘটবে না। কারণ এটা বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। এই কথার উত্তরে বিরুদ্ধবাদীরা বলেছেন যে, বঙ্গবন্ধু যেখানে নিজেই নিয়তির দায় শোধ করার জন্য নির্মম পরিণতি ভোগ করেছেন সেখানে তার দোহাই দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার অপচেষ্টার মতো হাস্যকর আর কিছুই হতে পারে না।
শ্রীলঙ্কা নিয়ে সুবে বাংলায় এত্তসব আলোচনা-সমালোচনার মূল কারণ হলো সেখানে একটি কর্তৃত্ববাদী এবং স্বৈরাচারী রাজনৈতিক পরিবারের নির্মম এবং অপমানজনক পতন হয়েছে। শুধু এই পরিবারের পতনই হয়নি, সাথে তাদের তাঁবেদার দোসর দালাল-চাটুকার এবং সুবিধাভোগীদের যে নির্মম পরিণতি হয়েছে তা নাটক-সিনেমার কাহিনীকেও হার মানায়। এমনকি গল্প-উপন্যাসেও এমনতর রাজনৈতিক পতনের বাস্তব পটভূমি কোনো কবি-সাহিত্যিক আজ অবধি রচনা করতে পারেননি। ফলে শ্রীলঙ্কার হাটে-মাঠে, ঘাটে, নদী-পুকুর-খাদে অথবা পাহাড়-পর্বত-জঙ্গলে স্বৈরাচারী রাজাপাকসে পরিবারের যে বাস্তব-দুর্ভোগ দুর্দশা মানুষ চর্মচক্ষু দিয়ে দেখতে পাচ্ছে তার ফলে বাংলাদেশের একশ্রেণীর মানুষ যেমন সর্বকালের সেরা বিনোদন লাভ করছে আর অন্য দিকে অপর শ্রেণীর বুকের মধ্যে কিয়ামতের ডিনামাইট বিস্ফোরিত হওয়ার আতঙ্ক নড়াচড়া করছে।
আমাদের দেশের আমোদপ্রিয় মানুষ খুব সহজে যেভাবে কোনো কারণ ছাড়াই ফুর্তিতে লাফাতে পারে, আবার তেমনই কেবল পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে কোনো বাছবিচার ছাড়াই হঠাৎ ক্রোধান্বিত হয়ে নির্মমতম ঘটনা ঘটিয়ে ফেলতে পারে। আমাদের দেশের হাটুরে মাইর গণপিটুনির মতো সমপর্যায়ের নির্মম ঘটনা যেমন সচরাচর অন্য দেশে ঘটে না, তদ্রƒপ খেজুরের কাঁটা দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জীবন্ত মানুষের অক্ষিগোলক বের করে আনার ঘটনাও পৃথিবীতে বিরল। সাধারণ চোর-ডাকাত যখন গ্রামবাসীর হাতে ধরা পড়ে তখন শত শত লোক জড়ো হয়ে সেই চোর-ডাকাতকে গণপিটুনি দিতে থাকে। এর বাইরে সত্তরের দশকে, এমনকি আশির দশকেও কোনো কোনো দাগি চোর বা ডাকাতকে গ্রাম্য বিচারে চোখ উপড়ে ফেলার সিদ্ধান্ত দেয়া হতো এবং ভিনগ্রাম থেকে অভিজ্ঞ লোকদের ভাড়া করে আনা হতো যারা খেজুরের কাঁটা দিয়ে নিখুঁতভাবে চোর-ডাকাতের চোখ উপড়ে ফেলতে পারতেন এবং এসব কাজের জন্য তারা কোনো দিনই থানা-পুলিশের কোনো ঝামেলার মধ্যে পড়েননি। নান্দাইলের জনৈক ব্যক্তি পাকিস্তান জমানায় চোখ তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন এবং তার সেই কাহিনী অবলম্বনে হুমায়ূন আহমেদ একটি নাটক পর্যন্ত রচনা করেছেন।
বাংলাদেশের মানুষের উল্লিখিত অভ্যাসের কারণে প্রায়ই বিভিন্ন জনপদে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে। একবার ঢাকার সাভার এলাকায় গরুচোরের উপদ্রব ভয়ানকভাবে বেড়ে গিয়েছিল। মানুষ গরুচোরদের ওপর ভীষণ রকম বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় একবার এক গরুচোর জনতার হাতে ধরা পড়ে। লোকজন গণপিটুনি দিয়ে চোরকে মেরে ফেলে। তারপর সেই চোরকে কেটে টুকরো টুকরো করে চোরের মাংস গরুকে দিয়ে খাওয়ায় এবং সাভারের অনেক গরু মানুষের বিক্ষুব্ধ সেন্টিমেন্টকে সমর্থন করে ঘাসের সাথে সে দিন চোরের মাংস খেয়েছিল।
আমাদের দেশের শান্তশিষ্ট জনতা কোনো কারণ ছাড়াই মাঝে মধ্যে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তারা কোনো কারণ ছাড়াই অন্যের কান্না দেখে যেমন অঝরে কাঁদতে পারে তদ্রƒপ অন্যের হাসি দেখে জটলা করে নিজেরাও গণহাসিতে যোগ দিয়ে খিলখিলিয়ে হাসতে থাকে। তারা গণহারে পাশাপাশি বসে বা পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যেভাবে প্রাকৃতিক কর্ম করে তা শ্রীলঙ্কায় হয় কি না আমি বলতে পারব না। নিষ্ঠুরতা প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও এ দেশের মানুষের রয়েছে নজিরবিহীন ইতিহাস। গত বছরের কোনো একসময় উত্তরবঙ্গের লোকজন সন্দেহবশত মসজিদ থেকে একজনকে আটক করে। তারা লোকটিকে গণপিটুনি দিয়ে মেরে ফেলে। এতেও তাদের ক্রোধ প্রশমিত হয় না। তারা প্রায় ১০ হাজার লোক একত্র হয়ে সেই হতভাগ্য লোকের লাশ প্রকাশ্য রাজপথে জ্বলন্ত চিতায় ফেলে ভস্ম বানিয়ে ফেলে। হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ জনতার সেই ক্রোধের সামনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নীরব দর্শক হওয়া ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না।
আমাদের দেশে বিয়ের আসরে মারামারি হয়। পূজা-পার্বণ, খেলাধুলা থেকে শুরু করে নানা রকম উৎসব আয়োজনেও মারামারি হয়। কোনো ক্ষেত্রে চেয়ারে বসা নিয়ে, কোনো ক্ষেত্রে খাবার বিতরণ নিয়ে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে বায়ুত্যাগের ঘটনা নিয়ে শুরু হওয়া ঝগড়াবিবাদের সূত্র ধরে শত শত লোকজন ঢাল-সড়কি নিয়ে আদিম কায়দায় যুদ্ধ আরম্ভ করে দেয়। এ দেশের গ্রামবাংলায় এখনো একশ্রেণীর লোক রয়েছে যারা গাঁজার নেশায় বুঁদ হয়ে আবোলতাবোল বলে এবং তাকে কেন্দ্র করে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিরাট জটলা হয়ে থাকে। লোকজন নেশায় বুঁদ হওয়া লোকটির ওপর জিনের আছর হয়েছে এবং সেই জিনের কাছ থেকে নিজের ভাগ্যলিপি জানার জন্য নেশাখোরের হাতে নগদ অর্থ পর্যন্ত গুঁজে দেয়।
আজকের শিরোনামের যথার্থতা আলোচনা করার আগে আমাদের কৃষ্টি-কালচার অভ্যাস নিয়ে বিস্তারিত বললাম এ কারণে যে, আমাদের দেশের পক্ষে কোনো অবস্থাতেই শ্রীলঙ্কা হওয়া সম্ভব নয় বা শ্রীলঙ্কা এক কোটি ৩৩ বছর চেষ্টা করেও হাল আমাদের বাংলাদেশ হতে পারবে না। শ্রীলঙ্কার পতিত প্রধানমন্ত্রী শত চেষ্টা করেও বাংলাদেশের মতো কোনো রেকর্ড স্থাপন করতে পারেননি। আমাদের দেশের রাতের ভোট, বিনা ভোট, ১০ লাখ কোটি টাকা পাচার, বালিশ কেলেঙ্কারি, পর্দা কেলেঙ্কারি, লাখ টাকা দিয়ে কলাগাছ ক্রয়, খিচুড়ি রান্না শেখার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ ইত্যাদি হাজারো দুনিয়া কাঁপানো কেলেঙ্কারি জন্ম দেয়া তো দূরের কথা ওসব কেলেঙ্কারির নাম লিখে তাবিজ বানিয়ে রাজাপাকসে এবং তার ভাই গোতাবায়ার গলায় ঝুলিয়ে দিলে তারা মুহূর্তের মধ্যে মৃগী রোগী হয়ে কাঁপতে কাঁপতে রাস্তায় পড়ে যেতেন এবং বেঘোরে প্রাণ হারাতেন।
বাংলাদেশে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে যে দু’টি নির্বাচন কমিশন ছিল তাদের সমপর্যায়ের নির্বাচন কমিশন গঠন করার হিম্মত রাজাপাকসের কোনো দিন ছিল না। রাজাপাকসে পেকে যদি পচেও যেত কিংবা পচে গলে দুর্গন্ধ ছড়াত তবুও তার নিয়োগকৃত প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য কমিশনার বাংলাদেশের উল্লিখিত কমিশনের বীর পুরুষদের মতো বীরত্ব প্রদর্শনে সাহসী হতো না। রাজাপাকসের পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে আপনি যদি তাকে দায়ী করতে চান তবে তাকে অকৃতজ্ঞ ও কৃপণ সন্তান হিসেবে আখ্যা দিতে পারেন। কারণ তিনি তার পিতা-মাতার সুনাম সুখ্যাতির জন্য ক্ষমতার চেয়ারে বসে কিছুই করেননি। ফলে আমরা তার বাবা-মায়ের নাম পর্যন্ত জানি না। ফলে তার পরিণতির সাথে পিতা-মাতার প্রতি কৃতজ্ঞ সুসন্তানদের পরিণতি যে একরকম হবে না এটা যেকোনো লোক চোখ বুজে বলে দিতে পারে।
বাংলাদেশে ক্ষমতাধর রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের সাথে দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্তাদের দহরম-মহরমের কারণে দুর্নীতিবাজ রাষ্ট্রীয় কর্মচারীদের মেদভুঁড়ির যে বহর দেখা যায় তা দেখে মনে হয় প্রায় সবাই গর্ভবতী এবং দুর্নীতির অর্থ, ক্ষমতা ও প্রভাবের ত্রিমাতিক সঙ্গমে তাদের পেট এতটাই স্ফীত হয়ে পড়েছে, যা দেখে মনে হয় সবার পেটের মধ্যে তিন-চারটি পরিচয়হীন ভ্রূণ নড়াচড়া করছে। আর আট-নয় মাসের গর্ভবতী পেট নিয়ে তারা যেভাবে প্রকাশ্যে রং-তামাশা করে সেটি শ্রীলঙ্কার কোনো নটী বিনোদিনীর পক্ষেও সম্ভব নয়। ফলে শ্রীলঙ্কার রাজাপাকসের পরিবার রাষ্ট্রীয় দুর্নীতি, দলীয় দুর্নীতি, ব্যক্তিগত দুর্নীতি, সরকারি দুর্নীতি প্রভৃতি দ্বারা রাষ্ট্রের চাকরবাকরদের গর্ভবতী করার ক্ষেত্রে কতটা নির্বোধ বালক ছিল তা তার পতনের মাধ্যমেই আমরা বুঝতে পেরেছি।
শ্রীলঙ্কার ঘটনায় আমরা যেসব দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমসহ বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে দেখতে পাচ্ছি তা আমাদের জন্য নিতান্ত বালখিল্য। ওখানে একজন বা কয়েকজন এমপিকে উলঙ্গ করা হয়েছে। উলঙ্গ হয়ে সেসব এমপি আবার ভদ্রলোকের মতো হাত ঝুলিয়ে রাস্তায় হেঁটেছে। এটা কি আমাদের দেশে সম্ভব! আমাদের দেশের চাঞ্চল্যকর বস্ত্রহরণ, গণপিটুনি, দৌড়, পালানো, হাউমাউ করে কান্না, ভয়ের কারণে দাঁতের পাটি লেগে যাওয়া, অনেকের পাতলা পায়খানা শুরু হওয়া এবং কাপড়চোপড় নষ্ট করার যেসব অহরহ ঘটনা রয়েছে এমনটি তো এখনো শ্রীলঙ্কায় ঘটেনি। সুতরাং শ্রীলঙ্কা কী করে বাংলাদেশ হবে বা বাংলাদেশে কিভাবে শ্রীলঙ্কার মতো ঘটনা ঘটবে তা আমার মাথায় ঢুকছে না।
লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।