জুমবাংলা ডেস্ক: বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল যা শয়তানের ত্রিভূজ নামেও পরিচিত। আটলান্টিক মহাসাগরের একটি বিশেষ অঞ্চল, যেখানে বেশ কিছু জাহাজ ও উড়োজাহাজ রহস্যজনক ভাবে নিখোঁজ হওয়ার কথা বলা হয়।
কিন্তু এমন একটি ট্রায়াঙ্গেল রয়েছে চাঁদপুরে। চারপাশ থেকে প্রবাহিত তীব্র স্রোত, মাঝে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিপাক। ভয়ঙ্কর ওই ঘূর্ণিপাকে কিছু পড়লে তার আর হদিস মেলে না। চাঁদপুরের ত্রিনদীর সঙ্গমস্থল এটি যা স্থানীয়ভাবে কোরাইলার মুখ নামেও পরিচিত।
পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া তিন নদী এসে মিলেছে এখানে। নদীগুলো তিনদিক থেকে প্রবাহিত হয়ে মিশে যাওয়ায় সেখানে পানির বিশাল এক ঘূর্ণিগর্তের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই ট্রায়াঙ্গেলে পড়েই নিখোঁজ হয়েছে শত শত মানুষ, লঞ্চসহ কার্গো কিংবা ট্রলার। তিন নদীর এ সঙ্গমস্থল যেন এক মৃত্যুকূপ।
মোহনাটি নদীর একেবারে তীরে অবস্থিত। সাধারণত নদীর তীর অগভীর থাকে। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, নদীর তীরে হওয়া স্বত্ত্বেও এই মোহনা অনেক গভীর। বর্ষাকালে এটি রূপান্তরিত হয় মৃত্যুকূপে। পানির ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি দেখে মানুষের মনে শিহরণ জাগে। এই মোহনা নিয়ে লোকমুখে অনেক গল্প প্রচলিত রয়েছে।
জনশ্রুতি আছে, এই মোহনা এক ছেলের অভিশাপে সৃষ্টি হয়েছে। সে হয়তো হাজার বছর আগের কথা। তখন মোহনাস্থলে কোনো নদী ছিল না। ছিল ছোটখাটো বাজার, হোটেল আর দোকানপাট। নদী ছিল কয়েক কিলোমিটার দূরে। একদিন বিকেলে ছোট এক দ্ররিদ্র ছেলে একটি হোটেলে গিয়ে খাবার চায়। হোটেলের মালিক তাকে তাড়িয়ে দেয়। ছেলেটি পুনরায় খাবার চাইতে গেলে তাকে তাড়িয়ে দেয়া হয়।
ছেলেটি আবারও ওই হোটেলে যায়। এবার হোটেলের লোকটি রেগেমেগে তার গায়ে গরম তেল ছুড়ে মারে। অসহ্য যন্ত্রণায় চিৎকার করে কাদঁতে কাঁদতে ছেলেটি চলে যায়। ওই রাতেই হোটেল অবধি কয়েক কিলোমিটার জায়গা নদীর অতলে হারিয়ে যায়। তৈরি হয় মোহনা। ওই ঘটনার বহু বছর পর ওই ঘূর্ণিপাকে পড়ে একটি লঞ্চ ডুবে যায়। তখন ডুবুরিরা লঞ্চের সন্ধানে নদীর তলদেশে গিয়ে দেখে একটি ছোট ছেলে চেয়ারে বসে আছে। ঘটনাগুলো আদৌ সত্যি কি-না তার কূল-কিনারা নেই।
তবে অবাক করা বিষয় হলো একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটে চলেছে এই ঘূর্ণিপাকে। সেই অতীতকাল থেকে এখন পর্যন্ত এলাকাটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ও জাহাজ চলাচলের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। সরকারিভাবেও চাঁদপুরকে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নৌপথ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বর্ষা মৌসুমে মোহনার চারপাশে এক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বৃত্তাকারে খুঁটি পুঁতে দেওয়া হয়। এখান দিয়েই প্রতিদিন চরাঞ্চলের বহু ট্রলার যাত্রী নিয়ে পদ্মা-মেঘনা পাড়ি দেয়।
চাঁদপুরে চার উপজেলায় প্রায় ৪০টি চরাঞ্চল রয়েছে। এসব এলাকার লোকজনকে দৈনন্দিন কাজ ও চিকিৎসার জন্য জেলা ও উপজেলা সদরে যেতে হয়। যোগাযোগের একমাত্র বাহন ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা ট্রলার। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিশু, নারী ও পুরুষ সবাই এসব ট্রলারে করে নিয়মিত জেলা সদরে যাতায়াত করেন। ফলে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে নিয়মিতই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে।
চাঁদপুর জেলার বড়স্টেশন মোলহেডে ২৪ ঘণ্টাই প্রবল ঘূর্ণিস্রোত বইতে থাকে। প্রতি সপ্তাহে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে এখানে। এই তো গত ৩০ সেপ্টেম্বর মেঘনা-পদ্মা-ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় ঘূর্ণন স্রোতের কবলে পড়ে নিখোঁজ হয় পাঁচ জেলে। জানা যায়, তিন নদীর মোহনায় ঘূর্ণন স্রোতে পড়ে জেলেদের নৌকাটি উল্টে যায়। এতে নৌকায় থাকা সাতজন জেলের মধ্যে দু’জন সাঁতরে পাড়ে আসতে সক্ষম হন। বাকি পাঁচজনকে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড। বলা যায়, ভাগ্যগুণে বেঁচে গিয়েছেন তারা।
তবে অতীতের বেশিরভাগ ঘটনার চিত্র একেবারেই উল্টো। মালবোঝাই জাহাজ কিংবা কার্গো ডুবির মতো ঘটনা ঘটেছে এখানে। আর এসব দুর্ঘটনাজনিত জাহাজের সন্ধান কোনোদিনই আর পাওয়া যায়নি। মোহনায় এত বেশি স্রোত থাকে যে এসব নৌযান উদ্ধার কখনোই সম্ভব হয়নি।
পূর্বের দুর্ঘটনার ইতিহাস সম্পর্কে স্থানীয়রা জানান, পাকিস্তান আমল থেকে এখানে বহু যাত্রীবাহী লঞ্চডুবির ঘটনা ঘটেছে। যার মূল কারণ মোহনার তীব্র স্রোত। এখানে এমভি শাহজালাল, মদিনা, দিনার ও নাসরিন-১ লঞ্চ ডুবে যায়। সবগুলো লঞ্চেই প্রচুর যাত্রী ছিল।
তীব্র স্রোতের কারণে অধিকাংশ যাত্রীই বেঁচে ফিরতে পারেননি। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে এমভি নাসরিন-১, যার প্রায় ৯০ ভাগ যাত্রীই মারা গেছে। এখন পর্যন্ত এখানে ডুবে যাওয়া কোনো লঞ্চের সন্ধান পায়নি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ।
চাঁদপুর নদীবন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, বড়স্টেশন মোলহেডের মোহনাটি সবসময়ই ঝুঁকিপূর্ণ। এ স্থানটি যতটুকু সম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত। আমরা বড় বড় মালবাহী জাহাজ কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দিয়েছি, যাতে পাইলট নিয়ে জাহাজ চলায়। এছাড়া, এই মোহনার পাশ দিয়ে ফিটনেসবিহীন লঞ্চ ও জাহাজ চলাচল সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, মোহনার পাশ দিয়ে বরিশাল, পটুয়াখালীসহ দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের লঞ্চ চলাচল করে। তাদেরকে অবগত করা হয়েছে, ঘূর্ণিস্রোতের সময় কীভাবে এ স্থান অতিক্রম করতে হবে। তবে স্রোত পরিবর্তন কিংবা চর ড্রেজিংয়ের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে কিছু জানানো হয়নি।
স্থানটিতে পর্যটনের সমাগম চোখে পড়ার মত
তিন নদীর এ সঙ্গমস্থল চাঁদপুর জেলা সদরের অন্যতম একটি পর্যটন স্পট। প্রতিদিনই এখানে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার মানুষের সমাগম ঘটে।
যেভাবে যাবেন
বাস: পদ্মা এক্সক্লুসিভ (সায়েদাবাদ)। ভাড়া: ২৭০ টাকা। বাস সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত প্রতি ৩০ মিনিট পরপর ছেড়ে যায়।
লঞ্চ: ঢাকা সদরঘাট থেকে সকাল ৭.২০ মিনিট থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত প্রতি ঘন্টায় লঞ্চ চাঁদপুরের উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
ভাড়া: ডেকঃ ১০০ টাকা, চেয়ার: ১৫০ টাকা (নন-এসি), চেয়ার: ২৫০-২৮০ টাকা (এসি), কেবিন (সিঙ্গেল): ৪০০-৫০০ টাকা।
চাঁদপুর ঘাট থেকে অটোতে ১০/১৫ টাকায় বড় স্টেশন, তিন নদীর মোহনা যাওয়া যেতে পারবেন।
যেখানে থাকবেন
চাঁদপুর শহরে থাকার জন্য মোটামুটি মানের কিছু হোটেল রয়েছে। ভাই ভাই আবাসিক হোটেল, তালতলা বাসস্টেশন হোটেল সকিনা, নতুনবাজার। ভাড়া: হোটেলভেদে ৪০০-৬০০ টাকা
যা খাবেন
চাঁদপুর শহরে গেলে অবশ্যই বড় স্টেশন সংলগ্ন হোটেলে ইলিশ মাছ দিয়ে ভাত খাবেন। তিন-চারজন বা এরচেয়ে বড় গ্রুপ হলে রেলস্টেশনের পাশের ইলিশের বাজার থেকে আস্ত ইলিশ মাছ কিনে হোটেল থেকে রান্না করিয়ে নিতে পারেন। এতে খরচ কম পড়বে এবং খেয়েও মজা পাবেন। কালিবাড়ি মোড়ে ওয়ান মিনিট দোকানের আইসক্রিম বেশ বিখ্যাত। দাম ৪০ টাকা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।