প্রফেসর ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম গত ২৬ ও ২৭ মার্চ যে সহিংস আন্দোলন, ভাংচুর ও হরতাল পালন করেছে তার কি কোন সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল?
ইসলামের দৃষ্টিতে এ ধরণের আন্দোলন ও হরতালের বৈধতা কতটুকু? একদিকে গণতন্ত্রকে অস্বীকার, অপরদিকে গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অনুসঙ্গ হরতাল ও সহিংস আন্দোলন করাটা কি দ্বিচারিতা নয়? বিশ্বাস ও কর্মের বৈপরীত্য নয়?
আন্দোলনের জন্য কি হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির সময়টা ছাড়া অন্য কোন সময় পায়নি? এটি অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। তদুপরি এ সহিংস ঘটনাগুলো এমন এক সময়ে ঘটল যখন সারা বিশ্ব ভয়াবহ মহামারী ও অদৃশ্য বিপদের শিকার। এ সময় আমাদের উচিত ছিল খুব বেশী আল্লাহমুখী হওয়া এবং বেশি বেশি সালাতুল হাজত পড়া।
*মোদির বাংলাদেশ আগমন কেন ঠেকাতে হবে? ওআইসিভুক্ত ৫৭টি মুসলিম দেশের কোনো দেশে কি মোদির ভ্রমণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে? নাকি শুধু বাংলাদেশেই তার আগমন নিষিদ্ধ করতে হবে? কেন? মোদির বিরুদ্ধে সহিংসতা ও দাঙ্গার যে অভিযোগ আনা হয়, তা তো ৩৫ বছর বা তারও আগের? এখন কেন সে ইস্যু উস্কে দিতে হবে?
কুরআনের ২৬টি আয়াত বাতিল করার মামলাটি ভারতের কোর্ট খারিজ করে দিয়েছে। এখন হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কী হবে? বাংলাদেশে মুসলমানের সংখ্যা ১৬ কোটি আর ভারতে ২৫ কোটির চেয়ে বেশি মুসলমান রয়েছে। আপনারা কি তাদের অস্থিত্ব বিপন্ন করতে চান?
আপনারা কি চান ভারতের শত শত মাদরাসা ও ইসলামি ঐতিহ্য হুমকির মুখে পড়ুক?
ঐতিহাসিকরা বলেছেন, ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা ও সেবায় ভারতের আলেমগণ মাওয়ারাউন্নাহার বা মধ্য এশিয়ার আলেমদের চেয়েও এগিয়ে রয়েছেন। আল্লামা কারী তৈয়্যব (রহ.) বলেছিলেন, ‘কুরআন অবতীর্ণ হয়েছে আরবে, পড়া হয়েছে মিসরে আর বুঝা হয়েছে ভারতে।’
হেফাজতে ইসলামের নেতৃবৃন্দ চাইলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদির কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও যৌক্তিক দাবি পেশ করতে পারতেন। যেমন, বাংলাদেশের কওমি মাদরাসার ছাত্ররা যাতে দারুল উলুম দেওবন্দ ও নদওয়াতুল উলামায় বৈধভাবে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারে সে জন্য ভারতের সাথে এডুকেশন ভিসা চালু করা।
এ বিষয়টি নিয়ে বিগত বছরগুলোতে কিছু কাজ করাও হয়েছিল। এছাড়াও উভয় দেশে বিষয়ভিত্তিক ইসলামিক কনফারেন্স আয়োজন এবং উভয় দেশের আলেমদের অবাধ সফর বিনিময়ের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি দাবি উত্থাপন করা যেত।
- জিহাদ কী? জিহাদ কে ঘোষণা করবে? বাংলাদেশে কেন জিহাদ? জিহাদ কী মুসলমানদের বিরুদ্ধে হয়? তারা কারা? সমাজ সংস্কারে ইমাম আহমদ বিন হাম্বল, ইবনে তাইমিয়া ও ইমাম আবু হানিফার কর্মপদ্ধতি কী ছিল?
সমাজের প্রচলিত অন্যায়-অবিচার ও পাপাচারের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান কী ছিল? রাসুল (সা.) এর বাণী “তোমাদের মধ্যে কেউ যদি কোন অন্যায় ও পাপাচার দেখে সে যেন তার শক্তি দিয়ে তা প্রতিহত করে, যদি তা না পারে তবে যেন মুখে বাঁধা দেয়, আর যদি তাও না পারে তবে যেন অন্তরে ঘৃণা করে। এটি ঈমানের দুর্বলতম অবস্থা।” (সহীহ মুসলিম)
এ হাদিসের আলোকে সালফে সালেহীন কী করেছেন? তাদের কর্মপদ্ধতি কী ছিল? এসব বিষয় জানতে হলে পড়তে হবে সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) রচিত ‘তারিখে দাওয়াত ও আযিমত’ এবং ‘সীরাতে সায়্যিদ আহমদ বিন ইরফান শহীদ”।
আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা নিজেদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিওনা।” (সুরা বাকারা : ১৯৫)
অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা তাদের মোকাবেলার জন্য তোমাদের সামর্থ অনুযায়ী শক্তি ও সদাসজ্জিত অশ্ববাহিনী প্রস্তত কর, যা দ্বারা আল্লাহর শত্রু ও তোমাদের শত্রুদের ভীত সন্ত্রস্ত করবে, এছাড়া অন্যদেরকেও যাদেরকে তোমরা জান না, কিন্তু আল্লাহ জানেন।’(সুরা আনফাল : ৬০)
নির্দেশসূচক বাক্যে জিহাদের শর্ত উল্লেখ করে এ আয়াতে কাদের সম্বোধন করা হয়েছে যাদেরকে শক্র বলা হয়েছে ওরা কারা, মুসলিম না কাফের? আয়াতটি একটি সুনির্দিষ্ট উপলক্ষকে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হলেও এখানে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ও খরচের জোগাড় না করে আল্লাহর রাস্তায় বের হতে নিষেধ করা হয়েছে।
- সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রচিত ‘আল মুসলিমুনা ফিল হিন্দ’, ওবাইদুল্লাহ আসআদী রচিত ‘ তারিখে দারুল উলুম দেওবন্দ’ ও মানাযের আহসান গিলানী লিখিত ‘সাওয়ানেহে কাসেমী’ পড়ে দেখুন।
শাহ আব্দুল আযীয (রহ.) এর ঐতিহাসিক ফতোয়া, সায়্যিদ আহমদ বিন ইরফান শহীদ (রহ.) এর সংস্কার আন্দোলন ও জিহাদ ঘোষণা, হাজী এমদাদুল্লাহ মোহাজেরে মাক্কী (রহ.), কাসেম নানুতুবী (রহ.) ও রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) এর সিপাহী আন্দোলন এবং শামেলীর ময়দানে তাদের জিহাদ, শাইখুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী (রহ.) ও তার ছাত্র শাইখুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী (রহ.) এর রেশমী রুমাল আন্দোলন কার বিরুদ্ধে ছিল?
এসব জিহাদ ও আন্দোলন কী মুসলমানদের বিরুদ্ধে ছিল নাকি ইংরেজদের ? ১৮৫৭ সালের আগের ও পরের এসব জিহাদ ও আন্দোলনে কী মাদরাসা, এতিমখানা ও হিফজখানার ছাত্ররা অংশগ্রহণ করেছিল? নাকি আলেম-ওলামা ও সাধারণ মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল ?
- আপনারা কি দেওবন্দিয়তের পরিচয় ভালোভাবে জানেন? ১৯৮০ সালে দারুল উলুম দেওবন্দের শতবর্ষ উদযাপন অনুষ্ঠানে সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) দেওবন্দিয়তের পরিচয় দিতে গিয়ে বলেছিলেন, দেওবন্দিয়ত হচ্ছে চারটি বিষয়ের সমন্বয়: (ক) তাওহীদ বা একত্ববাদ (খ) এত্তেবায়ে সুন্নাত বা সুন্নাতের অনুসরণ (গ) তায়াল্লুক মা’আল্লাহ বা আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপন (গ) এ’লায়ে কালিমাতুল্লাহ বা আল্লাহর বাণীকে বিজয়ী করা।
কতজন আলেম দেওবন্দের ইতিহাস পড়েছেন ? কতজন উপরোক্ত গ্রন্থগুলো পড়েছেন? আপনারা যদি দারুল উলুম দেওবন্দ ও আল্লামা তাকী উসামনীর কাছে ফতোয়া চান, তারা কি এ সহিংস আন্দোলন ও হরতালের স্বপক্ষে ফতোয়া দেবেন?
আর দেওবন্দিয়তের স্বরূপ আমি ভালোভাবেই জানি। কারণ, আমার দাদা হযরত রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) এর প্রথম সারির ছাত্র ছিলেন, আমার আব্বা ছিলেন হযরত আশরাফ আলী থানভী (রহ.) এর অন্যতম শিষ্য। তারা উভয়ে তাদের হাতে বায়াত গ্রহণ করেছিলেন।
- কেউ যেন আবার মনে না করে যে, শাহ অলিউল্লাহ (রহ.) থেকে শুরু হয়ে বর্তমান পর্যন্ত দেওবন্দিয়তের যে ধারা চালু রয়েছে এ আন্দোলনের ফলে তা শেষ হয়ে গেছে, দেওবন্দিয়তের মান ও মর্যাদা ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে। কয়েকজন সহিংস মনোভাবাপন্ন ব্যক্তির অর্বাচীন কর্মকাণ্ডের কারণে দু’শত বছরের ইতিহাস ও অর্জন বিলীন হয়ে যেতে পারে না।
সহিংস কর্মকান্ড দ্বারা এদেশের দেওবন্দিয়তকে আপনারা প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। আমাদের মাথাকে নীচু করে দিয়েছেন। আমি গত ১২ বছর ধরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, সরকারের নীতি নির্ধারক ও সংসদে দেওবন্দিয়ত সম্পর্কে কথা বলে আসছি। এখন আমি কী বলব? আমার মাথা তো হেঁট হয়ে গেছে। ভবিষ্যতে আমি কিভাবে দেওবন্দিয়তের পক্ষে মুখ খুলব?
এ দেশে ইসলামের জন্য শেখ হাসিনা কী না করেছেন! ৫৬০টি মডেল মসজিদ, ১০১০টি দারুল আরকাম মাদরাসা, আলিয়া মাদরাসার শিক্ষকদের বেতন ভাতা ও সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধি, ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা এবং কওমি মাদরাসার সনদের স্বীকৃতি ইত্যাদি।
তিনি আর কী করতে পারেন ? দেওবন্দিয়তের জন্য শেখ হাসিনা যা করেছেন, পৃথিবীর কোন দেশে তা কেউ করেছে কি? অথবা বাংলাদেশের ৫০ বছরের ইতিহাসে কোন সরকার কি তা করেছে? দেওবন্দিয়তের পরিচয় ও আকাবিরে দেওবন্দের আদর্শ সম্বলিত একটি ছোট্ট পুস্তিকাও বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ থেকে প্রকাশিত হয়েছে?
- হেফাজতে ইসলামের মূল উদ্দেশ্যটা কী ? হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ সদস্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত। আপনারা কি মুফতি আযীযুল হক, খতীবে আযম মাওলানা সিদ্দিক আহমদ, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা আব্দুল ওয়াহহাব, হাজী ইউনুস (রহ.) সহ পূর্বসুরী আকাবিরদের নাম কখনো মুখেও নেন ?
বাংলাদেশের সর্বমোট জনসংখ্যা যদি ২০ কোটি ধরি, হেফাজতের আন্দোলন ও কর্মসূচিগুলোতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা কি ২% এর বেশী হবে ? ২% জনগোষ্ঠি নিয়ে কি আপনারা সরকার গঠন করতে পারবেন ?
এই ২% মানুষের মধ্যে ৩০% এতিমখানা ও হেফজখানার শিশু-কিশোর ছাত্র। এ ছাত্ররা আমাদের হাতে আমানত। আন্দোলনের নামে এ শিশু-কিশোরদের ভবিষ্যত নষ্ট করার কথা কোন বিবেকবান মানুষ বলতে পারেনা।
আপনারা কি এ দেশে ইরানের আয়াতুল্লাহ খোমেনির স্টাইলে বিপ্লব ঘটাতে চান ? আপনারা রাসুল (সা.) এর সীরাতকে আবার পড়ুন। কিতাবুল মাগাজি, কিতাবুস সিয়ার সমূহ পড়ুন।
ড. হামিদুল্লাহর লিখিত ‘রাসুল (সা) কি সিয়াসী জিন্দেগী’ পড়ুন। নিরাপরাধ ও বেসামরিক লোকজনের উপর হামলা, সরকারী সম্পদ, স্থাপনা ধ্বংস করা এবং বিশৃংখলা ও অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার অনুমতি কি কোন শরীয়ত দেবে?
- জীবনের সর্বক্ষেত্রে রাসুল (সা.) আমাদের জন্য উত্তম আদর্শ। তার জীবনাদর্শ, চরিত্র ও নৈতিকতা, মুসলিম ও অমুসলিমদের সাথে তার আচার-ব্যবহার আমাদের সামনে রয়েছে। আমাদের আচার-আচরন দেখে ইসলামের শত্রু ও সাধারণ নিরপেক্ষ মানুষ ইসলাম সম্পর্কে কী ধারণা পোষণ করবে?
নাকি আমরা তাদের অন্তরে ইসলাম সম্পর্কে খারাপ ধারনা সৃষ্টি করছি? রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমি উত্তম চরিত্রের পূর্ণতা বিধানের জন্যই প্রেরিত হয়েছি’ (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)।
অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমি শিক্ষক হিসেবেই প্রেরিত হয়েছি’ (ইবনে মাজাহ)। আমাদের মাদরাসাগুলোতে কি সেরকম যোগ্যতাসম্পন্ন ও চরিত্রবান আলেম তৈরী হচ্ছে ?
এ ব্যাপারে হাকিমুল উম্মত আশরফ আলী থানভী (রহ.) এর নির্দেশনা কি ছিল ? রাজনীতির ব্যাপারে তিনি কী বলেছেন? হযরত থানভী (রহ.) এর এ সংক্রান্ত একটি প্রবন্ধ আমি ছাত্র জীবনে আরবিতে অনুবাদ করেছিলাম। সেটি ১৯৮৪ সালে নদওয়াতুল উলামা থেকে প্রকাশিত আরবি পত্রিকা “আর রায়েদ” এ প্রকাশিত হয়েছিল। মাদরাসার ছাত্রদেরকে রাজনীতিতে জড়িত করে কেন মাদরাসাগুলো ধ্বংস করে দিতে চান?
এসব শিক্ষা আমি পেয়েছি বড় বড় আলেমদের সোহবত ও সংস্পর্শে থেকে, যাদের অনেকের সরাসরি ছাত্র হবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে, আবার অনেকের শিষ্যত্ব লাভ করতে না পারলেও তাদের মজলিশে বসে সরাসরি কথা শুনার ও উপকৃত হবার সুযোগ হয়েছে।
তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, শায়খ আবুল হাসান আলী নদভী, শায়খ আবরারুল হক হারদুয়ী, শায়খ মুহাম্মদ রাবে হাসানী নদভী, ক্বারী সিদ্দিক আহমদ বান্দবী, শায়খ এনামুল হাসান কান্দলভী, মুহাদ্দিস হাবিবুর রহমান আযমী, আল্লামা শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ প্রমুখ।
এছাড়াও গত শতাব্দীর আশির দশকের দিকে দারুল উলুম দেওবন্দের শায়খ সাঈদ আহমদ পালনপুরী ও মাজাহিরুল উলুম সাহারানপুরের শায়খ ইউনুস এর দরসে বসারও সুযোগ আমার হয়েছে।
সত্তরের দশকের শেষের দিকে এবং আশির দশকের শুরুর দিকে হাটহাজারী ও পটিয়া মাদরাসায় শায়খ আব্দুল ওয়াহহাব ও খতীব আজম সিদ্দিক আহমদ এর মজলিস থেকেও আমি উপকৃত হয়েছি।
দেশের যেসব প্রতিথযশা আলেমদের ছাত্র হবার সৌভাগ্য আমি লাভ করেছি তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন, শায়খ হাজী ইউনুস, মুহাদ্দিস আমির হোসাইন, শায়খ আলী আহমদ বোয়ালভী, আল্লামা নুরুল ইসলাম কাদীম, শায়খ আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভী, শায়খ আল্লামা আব্দুল হালিম বোখারী ও আমার পিতা আল্লামা আবুল বারাকাত মো: ফজলুল্লাহ।
নব্বই এর দশকের শুরুর দিকে শায়খ আব্দুল আযীয বিন বায (রহ.) এর ঘরে বসে এবং রিয়াদের দারুল ইফতায় বসে তার ইলম,আমল ও আখলাক থেকে উপকৃত হয়েছি প্রায় ১২দিন।
আল্লামা ড. ইউসুফ কারজাভী এর মজলিশে ও সান্নিধ্যে বহুবার বসার সুযোগ হয়েছে, তার গভীর পান্ডিত্য ও অভিজ্ঞতা থেকে অনেক উপকৃত হয়েছি।
২০০২ সালে একবার তিনি আমার চট্টগ্রাম শহরস্থ বাসায় এসে আমাকে ধন্য করেছিলেন। নিকট অতীত ও বর্তমান সময়ের এসব যুগশ্রেষ্ঠ আলেমদের কাছে আমি যা শিখেছি, তার সাথে আপনাদের সাম্প্রতিক কাজকর্মের কোন মিল খুঁজে পাচ্ছি না।
ছাত্রদেরকে এ ধরণের রাজনৈতিক আন্দোলনের কুফল সম্পর্কে সতর্ক করা এবং দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পর থেকে অদ্যাবধি এ কওমী মাদরাসাগুলো যে উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে সে সম্পর্কে সচেতন করা কি কওমী মাদরাসা কর্তৃপক্ষের কি দায়িত্ব ছিল না ?
- আল্লামা জুনাইদ বাবুনগরী ও মামুনুল হক কি দেওবন্দিয়তের সঠিক প্রতিনিধিত্ব করছেন? এভাবে দেওবন্দিয়তকে ধ্বংস করার অধিকার তাদের কে দিয়েছে? আল্লামা আহমদ শফী (রহ.) এর ইন্তেকালের কয়েকমাস পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত যেসব অনাকাংখিত ঘটনা ঘটেছে তা কিভাবে হলো, এর অন্তরালে কী ষড়যন্ত্রের জাল বুনা হয়েছে, কারা এর কলকাঠি নাড়ছে সবকিছু দলিল-প্রমাণসহ আমাদের জানা আছে।
শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী (রহ.) উপর হামলার আদ্যোপান্ত আমাদের জানা আছে। আমাকে তার জানাজায় শরীক হতে দেওয়া হয়নি। এ গর্হিত কাজের জন্য আপনারা কেউ কি কখনো একটু দু:খ প্রকাশ করেছেন?
আমাকে বারবার বলা হচ্ছিল, আমিরুল মুমেনীনের অনুমতি ছাড়া আপনি জানাজায় শরীক হতে পারবেন না। এটা কি ইসলামের আদর্শ? অথচ আমার সাথে শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী (রহ.) এর গভীর ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
আনাস মদানী যত বড় অপরাধীই হোক না কেন তার কি অধিকার ছিল না তার পিতার খাটিয়ার পাশ দাঁড়িয়ে জানাজার নামাজ পড়ার? অথচ আমার জানা আছে, সাতকানিয়ার সাবেক সংসদ সদস্য ও জামাতের গুরুত্বপূর্ণ নেতাসহ জামাতের অনেক নেতাকর্মী শুধু জানাজার নামাজ পড়েননি, বরং জানাজার নামাজ ব্যবস্থাপনায় নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং খাটিয়া কাধে নিয়েছেন।
এসময় শায়খুল ইসলামের হাজার হাজার ছাত্র ও মুরিদগণ কোথায় চলে গিয়েছিলেন ? আর আমিরুল মুমেনীন কে ছিল তা কি একটু স্পষ্ট করবেন ? আপনারা তো ভন্ড আক্বীদায় বিশ্বাসী নজিবুল বশর মাইজভান্ডারীকে অন্তরঙ্গ বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেছেন। এটি কি দেওবন্দিয়তের জন্য লজ্জা ও কলঙ্কের বিষয় নয়? দেখুন এখন তার ভুমিকা কী ?
- মামুনুল হকের মধ্যে আকাবিরদের কী চারিত্রিক সুষমা ও বৈশিষ্ট্য রয়েছে আমার জানা নেই। তার ব্যক্তিত্বের মধ্যে নীতি-নৈতিকতা, শালীনতা-ভদ্রতা, দাওয়াতী মানসিকতা এবং রাব্বানিয়াত কতটুকু আছে? বরং সাম্প্রতিক রিসোর্টকাণ্ডে তার অন্যরকম একটি চেহারা বেরিয়ে এসেছে। এ রকম একটি স্পর্শকাতর ও সঙ্গীন রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে একটি তারকা হোটেলে আনন্দ-ফূর্তি করার জন্য যাওয়া কি একজন ইসলামি ব্যক্তিত্ব বা ইসলামিক লিডারের চরিত্র হতে পারে?
মুসলিম শরীফের এক হাদিসে রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘হালাল স্পষ্ট ও হারামও স্পষ্ট। আর এ দু’য়ের মাঝে রয়েছে বহু সন্দেহজনক বিষয় যা অনেকেই জানে না। যে ব্যক্তি সেই সন্দেহজনক বিষয় হতে বেঁচে থাকবে, সে তার দ্বীন ও মর্যাদা রক্ষা করতে পারবে। আর যে সন্দেহজনক বিষয়সমুহে লিপ্ত হয়ে পড়ে, তার উদাহরণ সে রাখালের ন্যায়, যে তার পশু বাদশাহর সংরক্ষিত চারণভুমির আশেপাশে চরায়, অচিরেই পশুগুলো সংরক্ষিত চারণভুমিতে ঢুকে পড়ার আশংকা রয়েছে।’
এ হাদিসটি কি মামুনুল হকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হচ্ছে না? তারপরও কি সে অনুসরণযোগ্য ? যে লোকটি দেওবন্দিয়তের মানসম্মান ধুলায় মিশিয়ে দিয়েছে সে কি হেফাজতের ইসলামের নেতৃত্বের যোগ্যতা রাখে? অথচ এখনো আমাদের মাঝে আল্লামা মুহাম্মদ সুলতান যওক নদভী, আল্লামা আব্দুল হালিম বোখারী ও আল্লামা মাহমুদুল হাসানের মতো নক্ষত্রতুল্য আলেমরা বেঁচে আছেন।
আজ ইসলামের শত্রুরা হাসছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে দেওবন্দিয়ত ও আলেমদের বিরুদ্ধে যার যেমন ইচ্ছে বলছে। আর আমরা তাদের বলার ও লেখার রসদ যোগান দিচ্ছি। এসব দেখে মনটা দু:খে ভারাক্রান্ত। তাই আমার কিছু প্রতিক্রিয়া ও নিবেদন আপনাদের সমীপে পেশ করলাম।
এখন আমাদের করনীয় কি? আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা কী হতে পারে? আমরা এখন যা করতে পারি তা নিন্মরূপ :
ক. দারুল উলুম দেওবন্দ, দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা এবং দারুল উলুম করাচীর নেসাবে তালিম বা পাঠ্যক্রম ও চিন্তাধারা অনুযায়ী বাংলাদেশের মাদরাসাগুলোকে নতুনভাবে সাজানো।
খ. সলফে সালেহীন ও উপরোক্ত মাদরাসাসমূহের কর্মপদ্ধতির আলোকে বাংলাদেশে যোগ্য ও চরিত্রবান আলেম তৈরী করার মিশন নিয়ে কাজ করা।
গ. মৌলিক ইসলামি জ্ঞানের পাশাপাশি প্রয়োজন অনুসারে আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং আরবি, বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় পূর্ণাঙ্গ দক্ষতা অর্জন করা। আরবি, উর্দু ও ইংরেজির মতো বাংলা ভাষাতেও ইলমি,ফিকরী, দাওয়াতী ও ফিকহী গ্রন্থ রচনা ও অনুবাদ করা। ছাত্রদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে দূরে রেখে এ ধরণের একাডেমিক কাজে নিমগ্ন রাখা।
ঘ. মাদরাসার সিলেবাসে ‘বাংলাদেশ স্টাডিজ’ অন্তর্ভুক্ত করা, যাতে মাদরাসার ছাত্ররা স্বাধীনতার সঠিক ইতিহাস জানতে পারে। এছাড়াও সিলেবাসে অতিরিক্ত পাঠ্য হিসেবে বাছাইকৃত কিছু সাহিত্য, চিন্তাগঠনমূলক ও দাওয়াতী চেতনা সৃষ্টিমূলক গ্রন্থ অন্তর্ভুক্ত করা ।
ঙ. ছাত্রদের আত্মশুদ্ধি এবং নৈতিকতা গঠনের বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। তাবলীগ জামাতের সাথে সম্পর্ক নিবিড় করা ও ছাত্রদের তাবলীগের কাজে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করা।
চ. যেহেতু দাওরা হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের সমমান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, তাই কওমি মাদরাসার ছাত্রদের নির্মিতব্য সরকারী মডেল মসজিদ কমপ্লেক্স, ইসলামি ব্যাংক, আলিয়া মাদরাসা এবং ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন সরকারী চাকুরীতে কর্মসংস্থানের জন্য চেষ্টা-তদবির করা।
চ. দারুল উলুম দেওবন্দ, দারুল উলুম নাদওয়াতুল উলামা, আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরব ও মুসলিম বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কওমি মাদরসার ছাত্রদের উচ্চশিক্ষার পথ সুগম করা।
ছ. ভারতবর্ষের পূর্বসূরী আলেমগণ ইসলামি জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা-প্রশাখায় যে অবদান রেখে গেছে, তার ধারাবাহিকতা ধরে রাখার মতো একটি গবেষণামুখী প্রজন্ম তৈরী করার পরিকল্পনা হাতে নেয়া। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ইসলামি সাহিত্য ও চিন্তামূলক দাওয়াতমুখী ও গবেষণামুখী সেমিনার ও কনফারেন্স আয়োজন করা।
জ. কুরআনের ও হাদিসের আলোকে ইসলামের শাশ্বত সত্য ও সৌন্দর্য মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য কওমি মাদরাসার ছাত্রদেরকে যুগোপযোগী দাঈ হিসেবে গড়ে তুলার নিমিত্ত নানামুখি প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করা।
আল্লাহ তা’লা বলেন, ‘‘তার কথার চেয়ে আর কার কথা সুন্দর হতে পারে যে মানুষকে আল্লাহর দিকে ডাকে, নিজে নেক আমল করে আর বলে- নিশ্চয়ই আমি মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত।’’ (সুরা ফুসসিলাত: ৩৩)
আল্লাহ তা’লা আরো বলেন, ‘‘তোমার রবের দিকে আহবান কর প্রজ্ঞা ও উত্তম উপদেশের মাধ্যমে।” (সুরা নাহল : ১২৫)
রাসুল (সা.) বলেন, ‘আমার একটি বাণী হলেও তোমরা মানুষকে পৌঁছিয়ে দাও’। বিদায় হজের ভাষণে রাসুল (সা.) বলেছিলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যারা উপস্থিত আছ তারা অনুপস্থিতদের কাছে আমার কথাগুলো অবশ্যই পৌঁছিয়ে দেবে।”
আমরা লক্ষ্য করছি যে, কওমি মাদরাসাগুলো ইসলামের এ গুরুত্বপূর্ণ দিকটিকে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না। ছাত্রদের চিন্তা ও মনন গঠন এবং কাঙ্খিত তারবিয়াতের দিকটিও উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে।
রাজনীতিই যেন দিনদিন তাদের চিন্তা-চেতনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠছে। অথচ এ রাজনীতির সাথে রাসুল (সা.) এর আদর্শের রয়েছে যোজন যোজন দূরত্ব।
প্রয়োজনীয় যোগ্যতা সহকারে আলেম সমাজকে নিন্মোক্ত কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত হওয়া উচিত ছিল। (ক) বিশেষজ্ঞ ও গবেষক (খ) দক্ষ ফকীহ (গ) হাদিস বিশারদ (ঘ) তাফসির বিশারদ (ঙ) নিবেদিতপ্রাণ দাঈ (চ) লেখক ও সাহিত্যিক ।
কুরআন ও হাদিসের আলোকে একজন দাঈ’র মধ্যে নিন্মোক্ত গুণাবলী থাকতে হবে। (ক) নিজের মিশনের প্রতি গভীর আস্থা ও বিশ্বাস (খ) আল্লাহর সাথে নিবিড় সম্পর্ক (গ) দাওয়াতের বিষয় সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান (ঘ) নৈতিক দৃঢ়তা ও ইলম অনুযায়ী আমল (ঙ) পরিপূর্ণ সচেতনতা (চ) প্রজ্ঞাপূর্ণ দাওয়াতের পদ্ধতি (ছ) সুন্দর চরিত্রের অধিকারী হওয়া (জ) মুসলমানদের ব্যাপারে সুধারণা পোষণ করা (ঝ) মানুষের দোষত্রুটি গোপন করা (ঞ) দাওয়াতের প্রয়োজনে মানুষের সাথে মেলামেশা করা, আবার দাওয়াতের প্রয়োজনে মানুষের সাথে মেলামেশা থেকে বিরত থাকা (ট) মানুষকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়া এবং সম্মানিত ব্যক্তিকে সম্মান দেয়া (ঠ) অন্যান্য দাঈদের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন করা ও পরামর্শ করা।
(শায়খ আবুল হাসান আলী নদভীর রচনাবলী, ড. ইউসুফ কারজাভীর ‘ছাক্বাফাতুদ দায়িয়া’ ও আল বয়ানুনী রচিত ‘আল মাদখাল ইলা ইলমিদ দাওয়াহ’ তে এসব বিষয় আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে।)
আজকের এ নিবেদনটি শেষ করছি হযরত আনাস বিন মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত একটি হাদিস দিয়ে। রাসুল (সা.) বলেন, ‘এই জাতি ততদিন পর্যন্ত কল্যাণের উপর থাকবে যতদিন তারা সত্য কথা বলবে, ন্যায়-ইনসাফের সাথে শাসন পরিচালনা করবে এবং দয়াপ্রার্থীর উপর দয়া করবে।’
আল্লামা ইকবালের কন্ঠেও ধ্বনিত হয়েছে প্রায়ই একই কথা। তিনি বলেন, আরেকটি বার শিখে নাও তুমি সততা, বিশ্বস্ততা আর বীরত্ব, তোমার কাছেই আসবে ফিরে এই দুনিয়ার নেতৃত্ব।
লেখক: গবেষক আলেম ও সংসদ সদস্য-২৯২, চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।