জুমবাংলা ডেস্ক : পৃথিবীতে এই মুহূর্তে প্রাকৃতিক এবং কৃত্রিম উপায়ে মডিফায়েড মিলে প্রায় ৩০০’র মত জাতের ছাগল আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের স্থানীয় জাতের কালো ছাগল বা ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলকে অন্যতম সেরা জাতের ছাগল বলা হয়। গবেষক ও সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ স্বীকৃতি এসেছে জাতিসঙ্ঘের বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এফএও’র মত সংস্থার গবেষণার মাধ্যমে। খবর বিবিসি’র।
২০০৭ সালে এফএও বিশ্বের ১০০টি জাতের ছাগলের ওপরে গবেষণা চালিয়ে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল’কে বিশ্বের অন্যতম সেরা জাত হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল দেখতে কেমন, বৈশিষ্ট্য কী?
পৃথিবীতে প্রায় ৩০০ রকমের ছাগলের জাত আছে, কিন্তু আকার, আয়তন এবং বৈশিষ্ট্য ভেদে এরা একে অপরের থেকে আলাদা হয়। ২০১৮ সালে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জেনোম সিকোয়েন্সিং বা পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য উন্মোচন করে বাংলাদেশের বিজ্ঞানীদের একটি দল।
সেই দলের সদস্য বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানিম্যাল ব্রিডিং অ্যান্ড জেনেটিক্স বিভাগের অধ্যাপক এমএএম ইয়াহিয়া খন্দকার বলেছেন, এই ছাগলের গায়ের রং মূলত কুচকুচে কালো। এটি আকারে বেঁটে, কিন্তু শরীরের কাঠামো শক্তপোক্ত ও পেশীবহুল। এর গায়ের লোম খাটো এবং শিং ছোট হয়।
একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ ছাগল বা পাঠার ওজন হয় ২২ থেকে ৩০ কেজি, ছাগীর ওজন ২০ থেকে ২৫ কেজি হয়। ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগল ১৪ মাসে দুইবার বাচ্চা দেয়, প্রতি বারে অন্তত দুইটি, সর্বোচ্চ ৫টি পর্যন্ত বাচ্চা দিতে পারে একবারে। এই ছাগল দুধ কম দেয়। বাংলাদেশ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, আসাম এবং উত্তর উড়িষ্যায় ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পাওয়া যায়। এছাড়া মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকাতেও পাওয়া যায় এই জাতের ছাগল। ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল পরিষ্কার, শুষ্ক এবং উঁচু জায়গায় থাকতে পছন্দ করে।
অধ্যাপক এমএএম ইয়াহিয়া বলেন,‘বহু বছর ধরে এ অঞ্চলে আবাস হবার কারণে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের জিনগত বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশের আবহাওয়ার সঙ্গে মিশে গেছে, যে কারণে মূলত বাংলাদেশেই তাদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।’
বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা এবং ঝিনাইদহ জেলায় ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের উৎপাদন সবচেয়ে বেশি হয়।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল নামটি এলো কোথা থেকে
ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট জাতের এই ছাগলটি বাংলাদেশের একেবারে নিজস্ব প্রজাতি। গবেষক ও সরকারি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এ অঞ্চলে পশুপালনের একেবারে শুরুর সময় থেকে এ জাতের ছাগল এখানে ছিল। তবে স্থানীয়ভাবে এগুলো দেশী কালো ছাগল বলে পরিচিত ছিল।
কিন্তু যখন থেকে পশুপালন গবেষকেরা এই প্রাণী নিয়ে গবেষণা শুরু করেন তখন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল গোট’ এই নামটি আসে। পরবর্তীতে যখন আন্তর্জাতিক গবেষণার বিষয় হয়ে ওঠে বাংলাদেশের এই নিজস্ব প্রজাতি, তখন থেকে একে এই নামেই ডাকা শুরু হয়।
কেন ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল অনন্য?
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নূরে হাছনি দিশা বলেছেন, মূলত গোশত ও চামড়ার জন্য ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগল বিখ্যাত।
তিনি বলেন,‘গোশত ও চামড়ার গুনগত মানের জন্য এ জাতের ছাগলকে উৎকৃষ্ট মানের বলা হয়। এছাড়া এটি পালন সহজ এবং পালন করার জন্য বড় কোনো জায়গার দরকার হয় না।’
সংখ্যার দিক থেকে ছাগল উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ এবং ছাগলের গোশত উৎপাদনে পঞ্চম।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এমএএম ইয়াহিয়া বলেছেন,‘ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি। এছাড়া এ জাতের ছাগলের মধ্যে মৃত্যুহার অনেক কম এবং ছাগলের বাচ্চার মৃত্যু হারও কম, যেটি এই জাতের ছাগলের সংখ্যা বৃদ্ধি ও জনপ্রিয়তার আরেকটি বড় কারণ।’
বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর গড়ে ২ কোটি ২০ লাখ ছাগল উৎপাদন হয়, যার ৯৫ শতাংশই ব্ল্যাক বেঙ্গল। এর মধ্যে বড় অংশটি বাংলাদেশের অন্যতম বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল আজহা বা কোরবানির ঈদের সময় জবাই করা হয়। কোরবানির ঈদের সময় দেশে যত গরু জবাই হয়, তার দেড়গুন ছাগল জবাই হয়। গত পাঁচ বছরে দেশে ছাগল আমদানি করতে হয়নি।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়াও বিশ্বে প্রসিদ্ধ। আন্তর্জাতিক বাজারে ছাগলের চামড়াকে ‘গোটস্কিন’ ও ‘কিডস্কিন’ উভয় নামে ডাকা হয়।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চামড়া ‘কুষ্টিয়া গ্রেড’ নামে পরিচিত বিশ্ব বাজারে এবং এর কদর আছে।
খামারীদের কাছে চাহিদা বাড়ছে
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যাচ্ছে গবাদি পশুপালনের উৎসাহী হচ্ছেন দেশের অনেক উদ্যোক্তা। তাদের মধ্যে ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের চাহিদা অনেক।
প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা নূরে হাছনি দিশা বলছিলেন,‘এর একটি বড় কারণ হচ্ছে, এই জাতের ছাগল পালন করা সহজ এবং এর মৃত্যু হার কম।’
বাণিজ্যিক উৎপাদনের কারণে দেশে ব্ল্যাক বেঙ্গলসহ প্রায় সব জাতের ছাগলেরই উৎপাদন বেড়েছে। এক দশক আগেও দেশে দেড় কোটির মত ছাগল উৎপাদন হতো। এই মুহূর্তে দেশে প্রায় ৫০ হাজারের মত ছাগলের খামার রয়েছে।
ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের বৃদ্ধিতে বাধা
পৃথিবীর অন্যতম সেরা জাতের ছাগল হবার পরও অনেক সময় খামারীরা এ ছাগল উৎপাদন করতে চান না। এর একটি কারণ হচ্ছে যেসব এলাকায় এই জাতের ছাগল বেশি হয়, সেখানে মরুকরণের পেছনে এই ছাগলকে অনেকে দায়ী করেন। এছাড়া ছাগল ফসলের ক্ষেত নষ্ট করে এবং তা থেকে উদ্ভূত আঞ্চলিক মারামারির ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঝিনাইদহ জেলার অন্তত ৩৫টি গ্রামে বেশ কয়েক বছর ছাগল পালন বন্ধ ছিল। তবে এর বাইরেও সমস্যা আছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে ব্ল্যাক বেঙ্গল জাতের ছাগলের জিনের গুনাগুণ, বিশেষ করে প্রজনন ক্ষমতার গুনগত মান হ্রাস পেয়েছে বলে বলছিলেন অধ্যাপক এমএএম ইয়াহিয়া। তিনি বলেন,‘এর বড় কারণটি হচ্ছে দেশে এই জাতের পাঠার সংখ্যা অনেক কমে গেছে। গায়ে দুর্গন্ধ হয় হয় বলে লোকে পাঠা পালন করতে চায় না। এর ফলে পাঠা হিসেবে ছাগলের জন্ম হলেও সেগুলোকে খাসি করে দেয়া হয়। তাছাড়া বাংলাদেশে পাঠার মাংসের চাহিদাও নেই, যে কারণে পাঠার সংখ্যা কম। বৈজ্ঞানিক গবেষণায় আমরা দেখেছি, একই পাঠা যদি একই পরিবারের কয়েক প্রজন্মের ছাগীর প্রজননের একমাত্র উৎস হয়, অর্থাৎ আন্তঃপ্রজনন হতে থাকে, তাহলে তার জিনের বৈশিষ্ট্যের মান আগের মত থাকবে না।’
এই মুহূর্তে দেশে গড়ে ১৬২টি ছাগীর প্রজনন হয় একটি পাঠা দিয়ে। তিনি কৃত্রিম প্রজননকে আরো এগিয়ে নিয়ে যাওয়াকে এর সামধান মনে করেন।
বাংলাদেশে প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইন্সটিটিউট ২০০০ সালের দিকে কৃত্রিম প্রজননের ওপর গবেষণা শুরু করে। এখান থেকে গবেষণাগারে উৎপাদিত উন্নত জাতের পাঠা খামারীদের মধ্যে দেয়া হয়, তবে সে সংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।