সাইফুল্লাহ মাহফুজ, কানাডা থেকে : আমি আর বেঁচে নাই মা। সন্দেহে, ধোঁয়া ধোঁয়া মাঝরাতে ওরা আমাকে পিটিয়ে মেরেছে। বাবাকে বলে দিও। আমি আর বেঁচে নেই মা।
চড়, কিল, ঘুষি, অকথ্য, অশ্রাব্য গালাগালি, ধাতব কিছুর আঘাত ইত্যাদি ইত্যাদি নানাবিধ উপায় উপকরণে তিলে তিলে অনেকগুলো মানুষের সন্তান আমাকে পিঁপড়ে ভেবে পিষে মেরে ফেলেছে। যে হল ছিল আমার বাড়ি, আমার মত মধ্যবিত্ত ছাত্রের স্বর্গরাজ্য যে আবাস, সেইখানে ওরা আমাকে শেষ করে দিলো।
অথচ ওরা ছিল আমার ভাই। হলের সিঁড়িতে উঠতে নামতে দেখা হতো দোতলার ল্যান্ডিং এ সাইকেল নিতে গিয়ে সালাম ঠুকেছি অনেককে। টিভিরুমে জড়িয়ে ধরেছিলাম একজনকে সেবার বাংলাদেশ জেতার পরে।ক্যান্টিনেও দেখা হত।খাবার সময় এগিয়ে দিয়েছি ডালের গামলা।কখনো ওদের কেউ আমাকে লবণের কৌটো এগিয়ে দিয়েছে অথবা হলের সেলুনে অগ্রজ বলে বেশ কয়েকবারই আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম আমার সিরিয়াল।
এমনকি একজনকে একটি টিউশনি দিয়েছিলাম। উনি বলেছিলেন, বেতন পেলে আমাকে পুরাণ ঢাকায় খাওয়াবেন।সেই দিন কখনো আসেনি।এখন তো আর সম্ভব নয় সেসব। ওদের হয়তো এসব মনে ছিল না।আসলে ওরকম সময়ে কারো কিছু মনে থাকে না। ওরকম সময়ে চোখে ভাসে হায়েনার হাসি, শরীরে ভর করে আসুরিক শক্তি ধরাকে সরা মনে হয় – তাই তিলকে তাল বানাতে লাগে না একটুকু সময়। হিংস্রতায় কে কাকে হার মানাবে, কে কোন পোস্ট পজিশনে যাবে, তার অলীক কল্পনায়, আমি যে ওদের কত কাছের ছিলাম, তা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো বোধ হয়।না হলে একি ঘরে থেকে, একি টেবিলে খেয়ে, একি রিডিং রুমে পড়ে, একি ক্লাসে ক্লাস করে, এইভাবে ওরা আমাকে একটি সাপের মতো পিটিয়ে মারতে পারতো না।
তুমি নিজেকে সামলে নিও মা। ছোটোনকে বলবে গনিতে মন দিতে, গণিতে ও বড্ড কাচা।দুইয়ের সাথে দুই যোগ করে পাঁচ বানালে চলবে কি করে? আমার যত সার্কিট আর হাবিজাবি বই, সব এখন থেকে ওর।বাবাকে ওষুধ দিও নিয়ম মত।তুমি বড় ভুলোমনা।এবার আসার সময় নাড়ু দিতে চেয়েও শেষ বেলায় নাকি তোমার মনে ছিল না। যে আমি তোমাকে সব মনে করিয়ে দিতাম। সেই আমিই এখন গত।নিজ থেকে সব কিছু সামলে নিও।টিউশনির টাকাটা আর পাঠানো হবে না।তোমার নষ্ট সেলাই মেশিনটা ঠিক করে দেখো কিছু উপরি আয় হয় কিনা।ছোটনের মাষ্টারটা খুব ভালো। ওকে ছাড়িও না। আর পাড়ার মোনা কে জানিও- আমি আর কখনো আসবো না; কিভাবে এ কথা বলবে জানি না। তবে তার একটা ব্যাখ্যা পাওয়ার অধিকার আছে মনে হয়।
কখনো যদি আমার জন্যে সংবাদ সম্মেলন ডাকে কেউ , মাইক ধরে কেঁদে ফেলো না। শরীরের সব শক্তি কণ্ঠে এনে দৃপ্তস্বরে মানুষকে জানিয়ে দিও: “পদ, পদবী ও পদকের মোহে নিত্য দুর্জনের পা চেটে, স্বজ্ঞানে সুখের নামে, অন্তহীন লোভের নরক যন্ত্রণায় আপনারা সবাই ফেঁসে যাচ্ছেন।”
এরপর আর একটা কথাও না বলে ফিরে এসো ঘরে।বাবা আর ছোটনকে জড়িয়ে অনেক বেশি করে কেঁদে নিও।মানুষের সামনে কেঁদো না।আসলে মানুষ কোথায়? কে তোমাকে বুঝবে? কত মা ই তো সন্তান হারাচ্ছে অথবা সন্তানেরা সম্ভ্রম হারাচ্ছে, এই সারি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে।এজন্যে কেঁদে কেটে লাভ নেই।
অনেক কথা বলে ফেলেছি।আসলে এ যাত্রা বেশ লম্বা। জানিনা শেষ হবে কোথায়। আমি এখন যাই। আমার মতো আর অনেকে এপারে আছে বলে মনে করি। ওদের সাথে এখনি ভাব করি। এপারে আমি আর মরতে চাই না। এইপারে আমি মানুষ হতে চাই। মানুষের মত মাথা উঁচু করে বিশাল বিরাট একটি বিপ্লব হয়ে উঠতে চাই।
আর তাই, তুমি জেনো; সন্দেহে, ধোঁয়া ধোঁয়া মাঝরাতে ওরা আমাকে পিটিয়ে মেরেছে। বাবাকে বলে দিও।আমি আর বেচে নেই মা।
>ফেসবুক থেকে সংগৃহীত
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।