জুমবাংলা ডেস্ক : রূপপুর বালিশকান্ড ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্মাণাধীন ভবনে ধসের ঘটনায় বিতর্কিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন রাজশাহী মহানগরীতে প্রায় ৫৫০ কোটি টাকার কাজ করছে। এর মধ্যে রাজশাহী সিটি করপোরেশনের দীর্ঘতম একটি ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজও রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রতিদিনের করা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ কাজেই নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারসহ দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঢিলেমির অভিযোগ রয়েছে, তাকে দিয়ে ১ দশমিক ২ কিলোমিটারের ফ্লাইওভার নির্মাণ কতটা নিরাপদ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে রবিবার দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মজিদ সন্সের নির্মাণাধীন ভবনে ধসের ঘটনায় ঠিকাদারি কাজের নথিপত্র অনুসন্ধানে ক্যাম্পাসে অভিযান চালিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ সময় তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারসহ ভবন নির্মাণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দফতর ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখতে চান।
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। দুদকের রাজশাহী জেলার উপপরিচালক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন নির্মাণকাজ কীভাবে পেল এবং কীভাবে তারা কাজগুলো করছে এগুলোর সব খতিয়ে দেখার জন্য অনুসন্ধান শুরু করা হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ভবনে ধসের ঘটনায় কাউকে অভিযুক্ত পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রাজধানীর মহাখালী নিউ ডিওএইচএসে অবস্থিত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন লিমিটেড রাজশাহীর গুরুত্বপূর্ণ চারটি প্রতিষ্ঠানে ৫৪৭ কোটি টাকার কাজ করছে। প্রজেক্টগুলোর মধ্যে রয়েছে- ৪৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজশাহী ওয়াসায় ১০ তলা ভবন নির্মাণ, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (রুয়েট) ৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ তলা মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ভবন, ৬৪ দশমিক ৪ কোটি টাকা ব্যয়ে ইনস্টিটিউট ভবন নির্মাণ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০ তলা কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ভবন, ৬৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ তলা এ এইচ এম কামারুজ্জামান হল নির্মাণ, রাজশাহী সিটি করপোরেশন এলাকায় ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ফ্লাইওভার, ৪১ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শালবাগান কাঁচা বাজার ও ৩৬ দশমিক ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভদ্রা মার্কেট নির্মাণ।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের ‘মজিদপ্রীতি’
২০২০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় ‘রাজশাহী মহানগরীর সমন্বিত নগর উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়। এ প্রকল্পে ১০৭ ধরনের কাজ রয়েছে। এর মধ্যে নগরীতে পাঁচটি ফ্লাইওভার নির্মাণ। সে বছরই ফ্লাইওভারগুলোর নকশা প্রণয়ন ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। গত বছর মহানগরীর বর্ণালি মোড়, বন্ধগেট ও বিলিসিমলা রেলক্রসিং এলাকার প্রায় ১ কিলোমিটার ২৫৫ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার নির্মাণের কাজ পায় মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন। সম্প্রতি ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে এ ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ শুরু করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।
রাজশাহী সিটি করপোরেশনের একাধিক সূত্র জানায়, পাঁচটি ফ্লাইওভারের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘ এই ফ্লাইওভারটির নির্মাণকাজ মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনকে দেওয়ার ব্যাপারে শুরু থেকেই দরপত্র প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের ওপর চাপ ছিল। প্রভাবশালী একটি মহলের বিশেষ আগ্রহেই এর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, রুয়েট ও ওয়াসায় বিভিন্ন কাজ পায় এই মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশন। সিটি করপোরেশনের ফ্লাইওভার ছাড়াও ৪১ দশমিক ৪৮ কোটি টাকা ব্যয়ে শালবাগান কাঁচা বাজার ও ৩৬ দশমিক ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ভদ্রা মার্কেট নির্মাণের কাজও দেওয়া হয় মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনকে।
২০১৯ সালে বালিশকান্ড দিয়ে প্রথম আলোচনায় আসে মজিদ সন্স। পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের আবাসিক ভবনে আসবাবপত্র সরবরাহে অস্বাভাবিক দাম ধরে দুর্নীতি ও কেনাকাটায় অনিয়ম করা হয় বলে অভিযোগ ওঠে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। সেখানে একটি বালিশের পেছনে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা ব্যয় দেখানোর খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া এ ঘটনা ‘বালিশ দুর্নীতি’ হিসেবে পরিচিতি পায়। দেশে একটি বালিশের বাজারমূল্য ২৫০ টাকা থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। কিন্তু প্রকল্পের অধীনে প্রতিটি বালিশের মূল্য দেখানো হয় বাজারমূল্যের প্রায় ২০ গুণ।
এরপর গত ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনের নির্মাণাধীন শহীদ এ এইচ এম কামারুজ্জামান ছাত্রাবাসের ছাদের অংশ ধসে পড়ে। এ অংশটি ছিল ৩০ ফুট উচ্চতাবিশিষ্ট এবং ৬৯ ফুট প্রশস্ত। তখন অভিযোগ ওঠে, জটিল এই কাজে স্পেশাল কোয়ালিটির শাটারিং দরকার হলেও তা দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া কলাম ও বিম ঢালাইয়ের পর কংক্রিটের জমাট বাঁধার প্রয়োজনীয় সময়টাও দেওয়া হয়নি। ঢালাই শক্ত হওয়ার আগেই নতুন করে ঢালাই দেওয়া শুরু হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের এই গাফিলতি তখন দেশজুড়ে আলোচিত হয়।
এসব ঘটনার পরও রাজশাহী সিটি করপোরেশন কীভাবে সেই প্রতিষ্ঠানের ওপর আস্থা রাখছে, জানতে চাইলে রাসিকের প্রধান প্রকৌশলী মো. নূর ইসলাম বলেন, সরকার তো তাদের কালো তালিকাভুক্ত করেনি। তাই আমাদের কিছুই করার নেই।
নেপথ্যে প্রভাবশালী নেতা
মজিদ সন্সকে ৪৪ কোটি ১৬ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজশাহী ওয়াসায় ১০ তলা ভবন নির্মাণের ওয়ার্ক অর্ডার দেওয়া হয় ২০২২ সালের জুন মাসে। এ কাজ পাওয়া নিয়ে তখনই কথা ওঠে। ওয়াসার একাধিক সূত্র জানিয়েছে, এ কাজটি মজিদ সন্সকে দেওয়ার জন্য দরপত্র প্রক্রিয়ার শুরু থেকেই তাদের ওপর চাপ ছিল। সরকারি দলের একজন প্রভাবশালী নেতা ও তার স্ত্রীর বিশেষ আগ্রহ ছিল এ প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ পাইয়ে দিতে।
নির্মাণাধীন ওয়াসা ভবনের প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) মো. মাহাবুবুর রহমান জানান, ২০২৩ সালে ম্যাট ঢালাইয়ের জন্য তারা যে রড ব্যবহার করতে চেয়েছিল, তা পিডব্লিউডি অনুমোদিত রড নয়। পরীক্ষা করে ধরা পড়ে যে, পিডব্লিউডির নির্ধারিত মানদন্ডের চেয়ে ওই রডের মান অনেক কম। এরপর থেকে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ঢিলেমির কারণে দুই দফা কাজের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, নেপথ্যে প্রভাবশালী নেতা থাকার কারণেই মজিদ সন্সের গাফিলতির বিষয়টি তাদের বিড়ম্বনায় ফেললেও সরাসরি ব্যবস্থা নিতে বেগ পেতে হয়।
রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) একটি সূত্রে জানা যায়, এখানেও দুটি নির্মাণকাজ মজিদ সন্স অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন পেয়েছে সরকারি দলের প্রভাবশালী এক কেন্দ্রীয় নেতার চাপে। তৎকালীন উপাচার্যের বিরুদ্ধে এই ক্যাম্পাসে নিয়োগ ও ঠিকাদারি কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে ওই নেতা ও তার পরিবারের নির্দেশ পালন করার অভিযোগ আছে। পরবর্তীতে সাবেক সেই উপাচার্যের বিরুদ্ধে দুদকও তদন্ত শুরু করে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, সাবেক বিতর্কিত উপাচার্য অধ্যাপক আবদুস সোবহানের আমলে শহীদ কামারুজ্জামান আবাসিক হলের নির্মাণকাজটিও মজিদ সন্স কনস্ট্রাকশনকে দেওয়া হয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী ওই কেন্দ্রীয় নেতার নির্দেশে। কাজটি শুরুর পর থেকেই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতে শুরু করে।
সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী গ্রেফতার
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।