১৯১৫ সালে নিউটনের মহাকর্ষের উন্নত রূপ আবির্ভূত হয়। একাধিক বস্তুর মধ্যে আকর্ষণের বদলে এখানে চিন্তা করা হয় স্থান-কালের বক্রতা নিয়ে। আগে ধারণা করা হতো মহাবিশ্ব স্থির। নেই কোনো শুরু বা শেষও। নিজের তত্ত্ব বিপরীত কথা বললেও আইনস্টাইনও একই বিশ্বাসে অনড় ছিলেন। হকিং সেই তত্ত্বের গাণিতিক সূত্রগুলো প্রয়োগ করলেন মহাবিশ্বের জন্মের সময়ে। বের করে আনলেন সত্যটা। এর আগে হাবলও দেখিয়ে গিয়েছিলেন, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। গ্যালাক্সিরা একে অপর থেকে দূরে সরছে।
মহাবিশ্ব যদি প্রসারিতই হয়, তবে একসময় নিশ্চয় এটি একত্রে গুটিয়েছিল। মহাবিশ্বের শুরুও নিশ্চয় সেই সময় হবে। এই ধারণার তীব্র বিরোধী বিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েল রসিকতা করে বলেন, তাহলে নিশ্চয় হঠাৎ বড় কোনো ব্যাংয়ের (বিস্ফোরণ) মাধ্যমে মহাবিশ্বের শুরু। হয়েলের সেই ব্যঙ্গাত্মক নামটিই বর্তমানে জনপ্রিয় এক পরিভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে। হকিং প্রমাণ করলেন, হয়েলের ধারণাকৃত স্থির মহাবিশ্ব পর্যবেক্ষণের সঙ্গে খাপ খায় না। অবশ্য এটাও বললেন, আইনস্টাইনের তত্ত্ব খুব শক্তিশালী হলেও এর সমীকরণ থেকে অনেকগুলো আলাদা নমুনা ও সমাধান বের করা যায়।
ফ্রেড হয়েলদের স্থির মহাবিশ্বের তত্ত্বকে বলা হতো হয়েল-নার্লিকার থিওরি। হকিং বললেন, এটি রবার্টসন-ওয়াকার মেট্রিকের সঙ্গে মেলে না। মেট্রিক্সটির বর্তমান নাম ফ্রিডম্যান-লেমিত্রি-রবার্টসন-ওয়াকার মেট্রিক্স (এফএলআরডব্লিউ মেট্রিক্স)। মেট্রিক্স হলো সাধারণ আপেক্ষিক তত্ত্বের বিশেষ ধরনের (প্রকৃত) একটি সমাধান। মহাবিশ্বের আধুনিক মডেলের অন্যতম ভিত্তি এই মেট্রিক্স। এটি অনুসারে মহাবিশ্বে পদার্থ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে সুষমভাবে। পর্যবেক্ষণও এটাই বলছে। শুধু চিন্তা করতে হবে মহাবিশ্বের বড় মাপকাঠিতে।
তবে মজার ব্যাপার হলো হয়েলের তত্ত্বকে বাঁচানোর একটি উপায়ও বাতলে দিয়েছেন হকিং। তার জন্য প্রমাণ করতে হবে, মহাবিশ্বে ঋণাত্মক ভরও আছে। আরও মজার ব্যাপার হলো, বর্তমানে আমরা জানি, মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে ক্রমশ দ্রুতগতিতে। এর জন্য দায়ী করা হয় ডার্ক এনার্জিকে। মজার বিষয়টি হলো এই ডার্ক এনার্জির বৈশিষ্ট্য ঋণাত্মক ভরের সঙ্গে অনেকটাই মিলে যায়।
মেধাবীরাও ভুল করেন মাঝেমধ্যে। যেমনটা করেছিলেন আইনস্টাইনও। হকিং বলেছিলেন, স্থান-কালের বক্রতার ভিন্নতার কারণে ছায়াপথের জন্ম হওয়া সম্ভব নয়। ভুলটি করার কারণ হলো তখনো ডার্কম্যাটার আবিষ্কৃত হয়নি। ডার্কম্যাটারের কল্যাণে এভাবে জন্ম হতে পারে ছায়াপথের। হকিংয়ের থিসিস লেখার পরবর্তী সময়ে বিষয়টি এফএলআরডব্লিউ মডেলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
ছায়াপথ নিয়ে একটু ভুল কথা বলে ফেললেও মহাকর্ষ তরঙ্গ নিয়ে সঠিক বক্তব্য উঠে আসে থিসিসে। আইনস্টাইনের সমীকরণ ব্যবহার করে হকিং দেখান, বস্তুর চলাচলের ফলে স্থান-কালের মধ্যে যে ঢেউ ওঠে, কোনো বস্তু সেটাকে শোষণ করে নিতে পারে না। অবশ্য এ ক্ষেত্রে ধরে নিতে হবে, মহাবিশ্বের বড় অংশ ধূলিকণা দিয়ে গঠিত। হকিং বলেন, মহাকর্ষীয় বিকিরণ অনেকটা সাধারণ বিকিরণের (যেমন আলো) মতো কাজ করে। ২০১৫ সালে লাইগোর মহাকর্ষ তরঙ্গ আবিষ্কারের মাধ্যমে প্রমাণ হয় কথাগুলো।
স্থানের গঠন সাধারণত তিন রকম হতে পারে। উন্মুক্ত, বদ্ধ ও সমতল। বদ্ধ মহাবিশ্ব পৃথিবীর মতো। কোনো প্রান্তসীমা নেই। চলতে চলতে কোথাও গিয়ে কোনো কিনার পাওয়া যাবে না। উন্মুক্ত মহাবিশ্ব দেখতে ঘোড়ার জিনের মতো। আর সমতল মহাবিশ্ব একটি মেলে রাখা কাগজের পৃষ্ঠার মতো। ত্রিভুজের তিন কোণ ১৮০ ডিগ্রি হয় শুধু সমতল স্থানেই।
যেমন পৃথিবীর মেরু থেকে যাত্রা করুন। বিষুবরেখায় এসে ৯০ ডিগ্রি মোড় নিয়ে পূর্ব (বা পশ্চিম) দিকে যাত্রা করে ৯০ ডিগ্রি মোড় নিয়েই আবার মেরুর দিকে যাত্রা করুন। ফলে বিষুবরেখায় দুটি ৯০ ডিগ্রি কোণ হয়ে গেল। মেরুতে আছে আরেকটি অশূন্য কোণ। সব মিলিয়ে ত্রিভুজের কোণগুলো ১৮০ ডিগ্রির বেশি।
তারপর হকিং কাজ করেন ‘কচিপৃষ্ঠ’ নিয়ে। কচি শব্দটা এসেছে ফরাসি পদার্থবিদ অগাস্টিন কচির নামানুসারে। ‘কচিপৃষ্ঠ’ হলো স্থানের একটি ছেদাংশ। অনেকটা একমুহূর্ত সময়ের মতো। কচিপৃষ্ঠের সব বিন্দু সময়ের সঙ্গে যুক্ত থাকে। বদ্ধ মহাবিশ্বের বক্রতা হলো ধনাত্মক আর উন্মুক্ত মহাবিশ্বের বক্রতা ঋণাত্মক। সমতল বিশ্বের বক্রতা শূন্য। তিনি বলেন, মহাবিশ্বের বৈশিষ্ট্য শূন্য বক্রতার সঙ্গে সবচেয়ে ভালোভাবে মিলে যায়। আধুনিক জ্যোতির্বিদেরাও এমনটিই মনে করেন।
হকিংয়ের থিসিস পেপারের প্রথম দিকের বেশির ভাগ বক্তব্যই সাদামাটা। যুগান্তকারী কিছু নেই তাতে। আছে কিছু ভুল কথাও। কিন্তু শেষ অধ্যায়ে তিনি এমন একটি বিষয় নিয়ে এলেন, যা তাঁকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিজ্ঞানীর কাতারে নিয়ে আসে। বললেন, স্থান ও কাল সিঙ্গুলারিটিতে শুরু বা শেষ হতে পারে। দিয়েছেন প্রমাণও।
সিঙ্গুলারিটি বা পরম বিন্দু হলো অতিশয় ক্ষুদ্র ও ঘন এক বিন্দুর নাম। প্রকৃতই এর আকার শূন্য। মানে এখানে এসে স্থান ও কাল দুটোই শেষ। মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে থাকা মানে অতীতে এটি আরও ছোট ছিল। এভাবে অতীতে যেতে থাকলে একসময় দেখা যাবে এটি ক্ষুদ্র এক বিন্দুতে গুটিয়েছিল। সেই ক্ষুদ্র ও উষ্ণ বিন্দুতেই জন্ম মহাবিশ্বের।
গণিতে একধরনের প্রমাণ আছে যাকে বলে বৈপরীত্যের মাধ্যমে প্রমাণ। উল্টোটা ঘটা সম্ভব নয় দেখিয়ে বক্তব্য প্রমাণ করা হয় এই প্রক্রিয়ায়। হকিংও এভাবে প্রথমে ধরে নিলেন স্থান-কালে সিঙ্গুলারিটির উপস্থিতি নেই। পরে জটিল গাণিতিক প্রক্রিয়ায় দেখালেন, এ ধরনের মহাবিশ্ব হবে একই সঙ্গে উন্মুক্ত ও বদ্ধ।
এটা অর্থহীন। তাই বলা যায়, সিঙ্গুলারিটি থাকবেই। আরও দেখালেন, স্থান-কালের শুরুও হতে পারে সিঙ্গুলারিটিতে। তার মানে মহাবিশ্বের একটি শুরুও থাকবে। হকিং পিএইচডি থিসিস লেখা শুরু করেছিলেন ১৯৬৫ সালের অক্টোবরে। তার মাত্র ১৭ মাস আগেই আবিষ্কৃত হয় মহাজাগতিক পটভূমি বিকিরণ। এটাও ছিল বিগ ব্যাং তত্ত্বের একটি অনুমান। ফলে দুই দিক থেকে তত্ত্বটি জোরালো স্বীকৃতি পেল। হয়েলের স্থিরাবস্থা তত্ত্বেরও কবর হলো চিরতরে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।