মো. মাহামুদুল হাসান: বিচারহীনতার সংস্কৃতির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে সেই ছোটবেলায়। তখন আমার বয়স চার অথবা পাঁচ হবে। দিনটি ছিল শুক্রবার। সন্ধ্যা হয়ে গেলেও আমার ছোট ফুফু বাড়িতে ফিরে আসেননি। আব্বা ও আমার পাঁচ চাচা সেদিন হাটে গিয়েছিলেন। উনারা বাড়িতে ফেরার পর পুরো গ্রাম তন্নতন্ন করে খোঁজা হলো। কিন্তু কোথাও ফুফুকে পাওয়া গেল না। রাতেও হ্যাজাক লাইট (বাতি) দিয়ে খোঁজা হলো কিন্তু পাওয়া গেল না।
পরদিন সকালে একটি পাটক্ষেতে ফুফুকে পাওয়া গেল। কিন্তু জীবিত না, মৃত। কে বা কারা ফুফুকে…হত্যা করে ফেলে রেখে গেছে। আমার বাবা বাদী হয়ে হত্যা মামলা করলেন। মামলা যতই এগুতে থাকলো ততই লক্ষ করলাম, আমাদের সম্পদ কমতে থাকার প্রবণতা। অবস্থাটা এমন হলো যে সাক্ষী, উকিল, থানা ও কোর্টের পেসকার থেকে শুরু করে সব জায়গায় টাকা দাও, নইলে মামলা একচুলও আগাবে না। আসামিদের কয়েকজন গ্রেফতারও হলেন। পলাতকদের মালামাল ক্রোক করা হলো। উকিল, থানা ও কোর্টে টাকা ঢালতে ঢালতে এক পর্যায়ে আমাদের পরিবার নিঃস্ব হওয়ার মতো অবস্থা। এমন সময় লোয়ার কোর্টে কয়েকজন আসামির ফাঁসির রায় হলো। পরিরবারের সবাই আমরা খুশি।
তবে এই খুশি বেশিদিন টিকলো না। আসামিরা উচ্চ আদালতে আপিল করে বেকসুর খালাস পেয়ে গেলেন। এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না।
আমার প্রশ্ন হচ্ছে, হত্যাকাণ্ডের সাথে আসামিদের যদি কোনও সংশ্লিষ্টতা না থেকে থাকে তাহলে আদালত কেন আবার তদন্তের নির্দেশ দিলেন না? তাহলে কি আমার ফুফুকে মানুষ খুন করেনি, খুন করেছে আসমান থেকে কেউ নেমে এসে!
সেই যে বিচারহীনতার সংস্কৃতির সঙ্গে আমার পরিচয় সেটা এখন আরও বেশি করে এই সমাজে চোখে পড়ছে। এই দেশে মামলা করলেই বিবাদীর চেয়ে বাদী পক্ষই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যেটার সবচেয়ে বড় উদাহরণ আমাদের পরিবার। ওই একটা হত্যা মামলার কারণে আমার চোখের সামনে একটা স্বচ্ছল এবং ভালো পরিবার ধ্বংস হয়ে গেছে। সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও এই বিচারহীনতা এবং ঘুষ সংস্কৃতির কারণে আমাকে সেই ছোটবেলা থেকে অনেক সংগ্রাম করে বড় হতে হয়েছে।
আজ বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই অপরাধীরা বেপরোয়া। তারা আইনকে গুরুত্ব দেয় না, অপরাধ করতে ভয় পায় না। তারা মনে করে অপরাধ করে পার পাওয়া যায়। আমার ফুফুর হত্যাকারীদের ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছে।
বাংলাদেশে ফৌজদারি মামলা সন্দেহাতীতভাবে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে উপস্থাপন করতে হয়। মামলা প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতে হাজির করতে হয় পুলিশকে। তদন্ত যতি দুর্বল ও ত্রুটিপূর্ণ হয় আর মামলার সাক্ষী যদি উল্টাপাল্টা বলে তাহলে এর সুবিধা পায় আসামি পক্ষ। আইনের ভাষায় ‘বেনিফিট অফ ডাউট’ আসামিদের সবসময় বাঁচিয়ে দিয়ে আসছে৷
তবে আমি আশাবাদী মানুষ। একদিন না একদিন এই বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান হবে। মানুষ ন্যায়বিচার পাবে। আর ন্যায়বিচারের জন্য কোনও পরিবারকে সর্বশান্ত হতে হবে না।
লেখক: মো. মাহামুদুল হাসান, সম্পাদক, জুমবাংলা নিউজ ডট কম।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।