জুমবাংলা ডেস্ক : মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডলের (৫২) বিরুদ্ধে ওঠা ধর্ম অবমাননার অভিযোগের সত্যতা মিলেছে বলে দাবি করেছে পুলিশ।
বৃহস্পতিবার (৭ এপ্রিল) দুপুরে মুন্সিগঞ্জ সদর থানা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) ও মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মো. মিজান এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
এসআই মো. মিজান বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে তার (হৃদয় চন্দ্র মন্ডল) বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। প্রধান শিক্ষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করা ওই দিনের ১৩ মিনিট ৫৪ সেকেন্ডের রেকর্ডটিও আমরা শুনেছি। ঘটনার দিন ১০ম শ্রেণির ‘ক’ সেকশনে থাকা প্রায় ২০-২৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গেও কথা হয়েছে। তারাও একই কথা বলেছে। মামলার তদন্ত এখনও চলছে। তদন্ত শেষে ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে চার্জশিট দেওয়া হবে।”
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হৃদয় চন্দ্র মন্ডলের বাড়ি জেলার সিরাজদিখান উপজেলার চিত্রকোট ইউনিয়নে। ১৯৮২ সালে বিজ্ঞান বিভাগ থেকে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার কুচিয়ামোড়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তিনি এসএসসি পাশ করেন। পরে শ্রীনগর কলেজের বিজ্ঞান বিভাগ থেকে এইচএসসি পাশের পর তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে গণিত বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেন। পরবর্তীতে তিনি বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা শুরু করেন।
শিক্ষক হৃদয় চন্দ্রের স্ত্রী ববিতা মন্ডলের অভিযোগ, তার স্বামীকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ফাঁসানো হয়েছে।
অত্যন্ত সৎ ও নিয়মানুবর্তী শিক্ষক হৃদয় মন্ডল, বললেন প্রধান শিক্ষক
সহকর্মী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে হৃদয় চন্দ্র মন্ডলের আচরণের প্রসঙ্গে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আলাউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘‘আমি গত সাত বছর ধরে এ স্কুলে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করে শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডল গত ২০ বছর ধরে এ স্কুলে শিক্ষার্থীদের গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে পড়িয়ে আসছেন। আমি এ সাত বছরে কখনোই তার বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননাকর কিছু বলার অভিযোগ পাইনি। তবে তিনি নিয়মের ব্যাপারে খুবই কঠোর। খুব শৃঙ্খলায় থাকতে পছন্দ করেন। শিক্ষার্থীদেরও এসব নিয়ম-কানুন শেখানোর চেষ্টা করেন। সময়মতো ক্লাসে না এলে, স্কুল ড্রেস না পরলে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ঢুকতে দিতেন না, শাস্তিও দিতেন। এমন অভিযোগ মাঝে মাঝেই আমার কাছে আসতো। তখন আমি তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, ‘এখনই যদি ঠিকমতন সময় মেনে, সুশৃঙ্খলভাবে চলাফেরা না শিখে তাহলে কবে শিখবে‘?’’
প্রধান শিক্ষক আরও বলেন, “এমনকি পরীক্ষায় ৩২ পেলেও অভিভাবক, শিক্ষার্থীদের অনুরোধে তিনি কখনোই এক নম্বর দিয়ে পাশ করাতেন না। কিন্তু এ কাজগুলো এখন অধিকাংশ শিক্ষক করতে পারেন না। কারণ শিক্ষার্থীরা কখন কী করে বলা যায় না। কিন্তু এ স্কুলে তিনিই একমাত্র এমন কাজ করার সাহস দেখাতেন।”
সহকর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, “স্কুলে তার সহকর্মীদের সঙ্গেও নানা ব্যাপারে সমস্যা ছিল। একসঙ্গে থাকলে যা হয় আর কি। কিন্তু কখনো ধর্মীয় অবমাননাকর কিছু বলেছেন, এমন কোনো কিছু কারও কাছে শুনিনি। তবে এটা সত্যি তিনি খুব কঠোর ও সৎ ছিলেন তার দায়িত্বে।”
“এখন কেন কীভাবে এ বিষয়টা এলো তা জানা নেই। এ ধরণের অনেক কারণই হতে পারে। শুনেছি তার এ বক্তব্য শিক্ষার্থীরা রেকর্ডও করেছে। কিন্তু আমি ওই রেকর্ড শুনিনি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ পেয়ে আমি স্কুল কমিটির লোকজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কিন্তু ততক্ষণে স্কুলের অফিস সহকারী এ ঘটনায় মামলা করে বসেন। কারণ যে অভিযোগটি স্পর্শকাতর।”
প্রধান শিক্ষক বলেন, “আমাদের ৯০% মানুষই মুসলিম। এখন এ ধরনের বিষয় এলে যে কেউই মামলা করতে পারেন। যেহেতু মামলাটি তদন্ত চলছে তাই এর বেশি কিছু বলতে চাইছি না।”
তিনি আরও বলেন, “হৃদয় চন্দ্র মন্ডল বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের কোয়ার্টারেই থাকেন। কিন্তু অবস্থা বেগতিক আমরা এ ব্যাপারে তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি।”
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যা বলছে
এ ব্যাপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নিলুফার জাহানের সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বাজেট নিয়ে ব্যস্ততার কথা জানিয়ে পরে ফোন করার জন্য বলেন। পরবর্তীতে তাকে ফোন করা হলে তিনি কল রিসিভ করেননি।
জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা বেনজীর আহম্মদকে ফোন করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ( শিক্ষা ও আআইসিটি) স্নেহাশীষ দাসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে জেলা প্রশাসক যা বলার বলবেন। আমি কোনো মন্তব্য করতে রাজি নই।”
মুন্সিগঞ্জের জেলা প্রশাসক নাহিদ রসুল জানান, “উনি হয়তো কোনো কারণে ভিক্টিম হয়ে গেছেন। এখনও বিষয়টি প্রমাণিত হয়নি সেক্ষেত্রে তাকে এখনও আসামি বলা যাচ্ছে না। যেহেতু বিষয়টি এখনও তদন্তাধীন, আদালতে মামলাটি রয়েছে। সেক্ষেত্রে আমি এর চেয়ে বেশি কিছু মন্তব্য করতে রাজি নই।”
তিনি আরও বলেন,“তবে আমরা তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ রাখছি। কারণ এ ধরনের অবস্থায় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। তাই যাতে তাদের কোনো ক্ষতি না হয়। তাদের যথাযথ নিরাপত্তারও ব্যবস্থা করা হয়েছে।”
এদিকে শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মন্ডলের একাধিকবার জামিনের আবেদন করা হলেও তা নামঞ্জুর করা হয়েছে। মুন্সিগঞ্জ আদালত সূত্রে জানা যায়, বিদ্যালয়ে ক্লাস চলাকালে ধর্ম অবমাননার অভিযোগে গত ২২ মার্চ আটক করা হয় বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের গণিত ও বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মন্ডলকে। ওইদিনই সদর থানায় মামলা করা হয়। ২৩ মার্চ তাকে আদালতে নেওয়া হলে আদালত জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরে গত ২৮ মার্চ মুন্সিগঞ্জ আমলী আদালত-১ এ আসামির জামিন আবেদন করা হলে ওই আদালতের বিচারক সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল্লাহ আল ইউসুফ জামিন নামঞ্জুর করেন।
পরে হৃদয় কুমারের জামিন নামঞ্জুরের পরিপ্রেক্ষিতে তার আইনজীবী মুন্সিগঞ্জ সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আদালতে আসামির জামিনের জন্য ফৌজদারি মিস মামলা করেন। পরে তার জামিন শুনানির জন্য আগামী ১০ এপ্রিল দিন ধার্য করেন মুন্সিগঞ্জ সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ আমজাদ হোসেন।
ঘটনার সূত্রপাত
গত ২০ মার্চ পঞ্চসার ইউনিয়নের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ক্লাস নিচ্ছিলেন হৃদয় মণ্ডল। এ সময় তিনি শিক্ষার্থীদের প্রশ্নের জবাবে প্রাসঙ্গিকভাবে ইসলাম ধর্ম বিষয়েও কথা বলেন।
কয়েকজন শিক্ষার্থী মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় তার বক্তব্য রেকর্ড করে। সেই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো হলে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। এ নিয়ে অসন্তোষের জেরে স্কুল ছুটির পর ওই শিক্ষকের বিরুদ্ধে প্রধান শিক্ষকের কাছে লিখিত আবেদন দেয় শিক্ষার্থীরা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে স্কুল কর্তৃপক্ষ হৃদয় চন্দ্র মন্ডলকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়।
বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় একটি পক্ষের অসন্তোষের জেরে স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষকরা বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসে। তবে শিক্ষার্থীদের একাংশ বিষয়টি সমঝোতার সমাধান না মেনে ২২ মার্চ ক্লাস বর্জন করে ওই শিক্ষকের শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ করে।
খবর পেয়ে মুন্সিগঞ্জ থানা ও জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেয়। এরপর হৃদয় চন্দ্রকে তার বাসা থেকে আটক করা হয়। সূত্র : ঢাকা ট্রিবিউন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।