এর ইংরেজি নাম হোয়াইট বেলিড সি ঈগল (White bellied sea eagle)। বৈজ্ঞানিক নাম Haliacetus Leucogaster। পুরুষ পাখিটির মাপ ৭১ সেন্টিমিটার, মেয়েটির মাপ ৭৮ সেন্টিমিটার। পুরুষ-মেয়ে দেখতে একই রকম। সাদা বুক-পেট, পালক ঢাকা পাড়, ঘাড়-গলা, কপোল ও মাথার চাঁদি এই পাখিটির সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ঠোঁট খয়েরি লাল।
ডানা বুজানো অবস্থায় পিঠ ও শরীরের উপরিভাগটা বাদামি-ধূসর, ছাই বর্ণের আভাও আছে। পা আর ঠোঁট ছাড়া বাকিটা চকচকে সাদা বলেই পাখিটির নাম সাদা ঈগল হয়েছে। সাগরের পাড়ে, নদীর মোহনায় থাকে বলে নাম সাগর ঈগল। কিন্তু বর্তমানেও গ্রামাঞ্চলে দেখা যায়, আগে স্থায়ীভাবে থাকতও গ্রামে।
সুন্দরবনে এখন যারা বাসা করে, বাচ্চা হওয়ার পরে হাঁস-মুরগির ছানার জন্য ৩০ কিমি পথও পাড়ি দেয় ওরা। ডিম-বাচ্চা না থাকলে এক জোড়া পাখিকে প্রায় সর্বক্ষণই পাশাপাশি দেখা যায়। এদের ওড়ার ভঙ্গি, ঘাড় লম্বা করে তাকানো আর ডাইভ মারার কৌশলে সত্যিই রয়েছে রাজকীয় ভাব। চেহারায়ও আছে আভিজাত্যের ছাপ।
বছরে একবার ডিম-বাচ্চা তোলে এরা। বর্ষা ঋতুটা বাদ দিয়ে যেকোনো সময়ে ডিম পাড়তে পারে। কোনোরকম অসুবিধা না হলে এরা প্রতিবছর একই বাসায় ডিম পাড়ে। প্রতিবারই বাসায় কিছু নতুন উপকরণ আনে। বাসা তাই হয়ে পড়ে বড়সড় মাচানের মতো। এরকম একটি বাসার ডালপালা দিয়ে একবেলা রান্নার কাজ সারতে পারবে যেকোনো গ্রাম্যবধূ।
আমি সাগর ঈগলের বাসা দখল করতে দেখেছি শকুনদের। সাগর ঈগলেরা বাসা বাঁধার আগে থেকেই খুশিতে শূন্যে উঠে দুটিতে মিলে পাক খেয়ে ওড়ে, এ-ওকে ধাওয়া করে, এই নেমে আসে পাক খেতে খেতে, এই আবার উঠে পড়ে শূন্যে। ওদের ওই আনন্দ-ক্রীড়া দেখলে মুগ্ধ না হয়ে পারা যাবে না। দুজনে মিলেই বাসা সাজায়। সময় লাগে (নতুন বাসা হলে) ৬-৯ দিন। তারপর ২৪ ঘণ্টার ভেতরে দুটি ডিম পাড়ে স্ত্রী ঈগল।
দুজনে পালা করে ডিমে তা দেয়। ৩৬-৪২ দিনে ডিম ফুটে বাচ্চা হয়। বাচ্চাদের রং থাকে সাদা। বাচ্চা হওয়ার পর দুটি পাখি একসঙ্গে খাবার আনতে যায় না, যায় একজন। সে খাবার এনে বাসায় ফেলেই আবার বেরিয়ে পড়ে। বাসায় থাকা পাখিটি ওই খাবার কেটে কেটে বাচ্চাদের খাওয়ায়। ৭০-৭৭ দিন পরে বাচ্চারা উড়তে পারে। তার পরেও ২১-২৮ দিন মা-বাবার সঙ্গে সঙ্গে থাকে। মা-বাবার শিকার করা দেখে, নিজেরা শেখে। দুবছর বয়স হলে ওই বাচ্চারা নিজেরাই নিজেদের বাসা গড়ে, ডিম-বাচ্চা তোলে।
সুন্দরবনের বাইরে যেসব গাছে বাসা করে ওরা, সেগুলো হচ্ছে তেঁতুল, শিমুল, রাজশিরীষ, বয়সী দেবদারু ও আমগাছ, বট-অশ্বথ, কাঠবাদামগাছ। জলের কাছাকাছি বাসা বাঁধার প্রবণতা রয়েছে। একজোড়া পাখি বিশাল একটা এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখে, এই এলাকায় অন্য সাগর ঈগল এলেই ধাওয়া করে। এ যেন অলিখিত রাজত্ব। স্বজাতিকে ধাওয়া করার সময় এরা গলায় ধাতব আওয়াজ তোলে দ্রুত তালে—কণ্ঠস্বর সুরেলা, তীক্ষ্ণ। আবার বাসা বাঁধার আনন্দে, ডিম-বাচ্চা হওয়ার আনন্দেও এরা ডাকাডাকি করে শূন্যে উড়তে উড়তে।
সুন্দর পাখি সাগর ঈগল বর্তমান বাংলাদেশে খুব খারাপ অবস্থায় আছে। বিল-ঝিলে মাছ নেই। বাসা বাঁধার গাছ নেই। জীবনের নিরাপত্তা নেই। দেশের স্বার্থে, প্রকৃতির স্বার্থে একটি পাখিকে টিকিয়ে রাখা আজ বড়ই জরুরি হয়ে পড়েছে। কোনো পাখি যেন হারিয়ে না যায়। গত ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর সিডরের রাতে সুন্দরবনের ২টি বাসার ৪টি সাগর ঈগলের বাচ্চা বাসা থেকে পড়ে আহত হয়েছিল। কয়েকজন জেলে ওদের সেবা করে সুস্থ করেছিল।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।