জুমবাংলা ডেস্ক : নিজের প্রথম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন সোয়েব মুহাম্মাদ। আর অংশ নিয়ে চমক দেখিয়েছেন তিনি। ৪১তম বিসিএসে পরীক্ষায় অংশ নিয়েই তিনি সাফেল্যর দেখা পেয়েছেন। হয়েছেন পুলিশ ক্যাডারে (সহকারী পুলিশ সুপার) ১৯তম। বর্তমানে তিতাস গ্যাসের একজন কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন তিনি। তার সঙ্গে কথা বলে বিস্তারিত জেনেছেন সুজন চন্দ্র দাস।
মুহাম্মাদের বেড়ে উঠা নাটোরের সিংড়া উপেজলার সাতপুকুরিয়া গ্রামে। বাবা মো. আব্দুস সাত্তার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অডিট কর্মকর্তা, মা নীলুফার ইসলাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা।
পড়াশোনা:
সিংড়া দমদমা পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে বিএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইন্সটিটিউট (আইবিএ) থেকে এমবিএ ডিগ্রিতে অধ্যায়নরত আছেন। তার ছোটো ভাই সাদি মুহাম্মাদ তামিম বাংলাদেশ আর্মি ইউনিভার্সিটি অফ ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি (বিএইউইটি) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছেন।
ছেলেবেলা:
১৯৯৯ সালের কোনো শীতের সকাল। ছোটোবেলায় নানাবাড়ি সিংড়ার তাজপুর গ্রামে থাকা হতো তার। এ গ্রামে থাকা হলেও কোনো স্কুল না থাকার কারণে বাবার বাড়ি সাতপুকুরিয়া গ্রামের সাতপুকুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হন। তাজপুরে কোনো স্কুল ছিলো না তখনও, এখনও নেই। এ গ্রাম থেকে সাতপুকুরিয়ার দূরত্ব ছিলো এক কিলোমিটার। ছেলেমেয়েদের এ গ্রামে এসেই পড়াশোনা করতে হতো। বর্ষাকালে যাতায়াতের বাহন ছিলো নৌকা এবং শুকনো মৌসুমে ছিলো পায়ে হেঁটে চলাচল।
স্বপ্নের শুরু:
সাতপুকুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থেকে পঞ্চম শেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার পরই মূলত স্বপ্ন দেখার শুরুটা হয়েছিলো। এভাবে অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে আমার স্বপ্ন বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। সোয়েব মুহাম্মাদ বলেন, মেধা আমাকে বেকার অবস্থায় ভালোবেসে বিয়ে করেছিলো। সবসময় সাহস ও অনুপ্রেরণা দিয়েছে। বেকার কেন, চাকরি নেই কেন এগুলা বলে কখনো ঝামেলা করে নাই। খুব অল্পতেই সন্তুষ্ট থেকেছে সবসময়। প্রথমবারেই আমার বিসিএস জয়ে তার অবদান অনেক। আমার স্বপ্ন ছিলো পুলিশ হওয়ার। আমার ৪৩, ৪৪ রিটেন দেওয়া আছে এবং ৪৫ রিটেন সামনে।
তিনি নতুনদের উদ্দেশ্য বলেন, আপনারা নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রেখে রুটিন মাফিক পড়াশোনা চালিয়ে যাবেন, ধৈর্য ধরে থাকবেন, সফলতা আসবেই ইনশাআল্লাহ।
সোয়েব মুহাম্মাদকে নিয়ে স্ত্রী কাজী তানজিমা ফেরদৌস বলেন, আম্মু, শ্বশুর-শাশুড়ি দোয়া করেছেন। তারা চেয়েছেন সোয়েব যেনো তার ইচ্ছা পূরণ করতে পারে। দুই পরিবারের সদস্যদের সমর্থন ছিলো। তাদের চাওয়া ছিলো আমরা যেনো ভালো করে পড়াশোনা করি। পছন্দের ক্যাডারতো দূর, ও প্রথমে বিশ্বাস করতে পারতো না বিসিএস পাস করবে। কিন্তু আমার মনে হতো ও যদি পাস করে আল্লাহর ইচ্ছায় তালে ওর পছন্দের ক্যাডারই পাবে।
তিনি আরো বলেন, ফলাফল প্রকাশ হওয়ার দিন ও আমাকে কল দিয়ে বললো, ‘তোমার জামাই এখন পুলিশ’। আমিতো শুনেই কানতে কানতে শেষ। যতজনকে ওইদিন মেসেজ/রিপ্লাই দিসি ভুলভাল লেখছি। বানান ভুল, এলোমেলো শব্দ এসব। কথাও বলতে পারতেছিলাম না ঠিকঠাক। আম্মু তখন বলতেছিলো, এত ভালো খবর, আর তোমার বউ কানতেছে সমানে। মুহাম্মাদ বলছিল ওরও নাকি হাত-পা কাঁপতেছে। অনেক সময় পরে স্বাভাবিক হইছিলাম।
সোয়েব মুহাম্মাদ বরাবরই পড়াশোনায় ভালো ছিলো, পড়তে পারে অনেক। ওর অনেক স্বপ্ন ছিল একাডেমিক বিষয়গুলো নিয়ে। আমাদের এফেয়ারের সময় থেকেই ও সবসময় শেয়ার করতো এগুলা বিষয়। ওর স্বপ্ন ছিল, কী করতে পারেনি, কী করতে চায়, আফসোস কী কী। আর ওর শেষ বছরে এসে আমাকে প্রশ্ন করছিল এখনতো ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবার সময়। যে কোনো দিকে পছন্দ করতে হবে। তোমাকে জিজ্ঞেস করি উত্তর দিবে কোনটা চাচ্ছো, ও জানতে চায় ‘আমি কী বাইরে যাবার জন্য পড়াশোনা করবো? দেশের বাইরে সেটেলড হবো এইটা প্ল্যান হবে তাহলে।’
আর আরেকটা অপশন ‘দেশে যদি থাকি তাহলে আমি সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টা করবো, মানে বিসিএস এর জন্য প্রিপারেশন নিবো।’ এখন কোনটা করবো বলো। আমিতো একবাক্যে বলেছিলাম ‘দেশে থাকো।’ যাই ই করো না কেন দেশে থেকে করো। আমি বাইরে যেতে চাই না। বাইরে থাকে, বা সেটেলড হবে এমন ছেলে আমার দরকার নাই। এমন আমার ভাল্লাগে না। দেশে থাকবো, পরিবার পরিজন নিয়ে। এক জীবনে এর বেশি কিছু লাগে না। সবকিছু থাকবে কিন্তু দেশের মানুষ কাছে নাই, পরিবার নাই, মাত্র দুইজন মিলে ভিনদেশে থাকবো এমন চাই না।
তখন ও বললো, ‘ওকে, তাইলে সরকারি চাকরির জন্য পড়বো ফাইনাল।’ সেই থেকেই শুরু ওর প্রিপারেশন। অনেক পড়াশোনা করেছে, মাঝে মাঝে আমাকেও সময় দিতে পারেনি সেইভাবে। মাঝে মাঝে রাগ হলেও আল্লাহ’র কাছে ঠিকই চাইতাম যেন এর জন্য ওর পড়ার ক্ষতি না হয়। আমার কারণে যেন ওর স্বপ্নপূরণে কোনও বাধা না আসে। আল্লাহ তাই শুনেছে বোধহয়। করোনার টাইমে আমাদের দেখা হয়েছিল ৪ মাস পর। এর মধ্যে দেখা সাক্ষাত ছিলো না। ও শুধু পড়াশোনা করেছে। করোনার কারণে প্রিলিমিনারি এক্সাম পিছায়, কিন্তু এতে ওর ভাল হয়। ও আরও পড়তে পারে।
আল্লাহর রহমতে পড়াশোনা করার ধৈর্য পেয়েছে, এবং আল্লাহ স্বপ্নও পুরণ করেছে। ওর ড্রিম ছিল পুলিশ ক্যাডার হবে। আবার ইচ্ছা ছিল এডমিশনের সময় শুধুমাত্র সিএসই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে হবে তাই ভাসানীতে ভর্তি হইছিল। কারণ এখানে সিএসই পাইছিল, অন্যান্য পাবলিকে চান্স পাইছিল, কিন্তু ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্ট পায়নি। যদিও মাথা ব্যথা ছিল না সাবজেক্ট নিয়ে। কিন্তু আমার শ্বশুর-শাশুড়ির ইচ্ছায় এখানে পড়ে। ইচ্ছা ছিল ঢাবি থেকে কোনওদিন সম্ভব হলে একটা ডিগ্রি নেওয়ার। সেইটার জন্যই এমবিএ এর জন্য আইবিএতে এপ্লাই করেছিল মেইনলি। পরীক্ষা দিবে কিনা ভাবতেছিল, আমার শাশুড়ি মা তখন বলে এক্সাম দিয়েই দেখা যাক।
অত চিন্তার কী আছে। হলে হবে, না হলে নাই। পরে পরীক্ষাটা দেয়। ভাইভাতেও ভালো করে আর আল্লাহর রহমতে চান্স পায়। সেদিনও ও অনেক খুশি ছিল। আর আমি তো সম্পর্কের শুরু থেকেই জানতান ওর কী কী প্ল্যান আছে একাডেমিক বিষয়ে! কী কী ইচ্ছা! তাই আমিও চেয়েছি ওর চাওয়া যেন পূরণ হয়। খুবই ভালো লাগতো যখন একসাথে আমরা একের পর এক এইভাবে নিজেদের স্বপ্নপূরণের এক একটা ধাপ পার করতাম। জার্নিটা খুব সহজ যে ছিল তাও না। কিন্তু আমরা দুইজনেই ট্রাই করেছি সব সমস্যা কে একপাশে রেখে একসাথে থাকতে আর লক্ষ্য স্থির করে এগুতে। আর সবার দোয়া,ভালোবাসা তো ছিলই। এখন আলহামদুলিল্লাহ অনেক খুশি যে মুহাম্মাদ ওর কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছে। নিজের ভালোবাসার মানুষের স্বপ্নপূরণের জার্নিতে সাথে থাকতে পারাটাও আমার জন্য অনেক আনন্দের একটা ব্যাপার।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।