জুমবাংলা ডেস্ক : একসময় গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার নাগরী বাজারে বাবার সঙ্গে চায়ের দোকান করতেন মো. মোমেন। পরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে পিয়নের চাকরি নেন। সঙ্গে টুকটাক জমির দালালিও করতেন। সে সূত্রেই পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের কাছাকাছি যাওয়ার সুযোগ হয় তার। এরপর আর মোমেনকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। কালবেলার প্রতিবেদন থেকে বিস্তারিত তুলে ধরা হলো-
অল্পদিনেই ফুলেফেঁপে ওঠেন। এখন তিনি কয়েকশ কোটি টাকার মালিক। কালীগঞ্জের চানখোলা, বাগরদিয়া ও আমতলা বিলের অধিকাংশ জমিই এখন তার কবজায়। নানা কায়দায় ভীতি সৃষ্টি করে কারও জমি নামমাত্র মূল্যে কিনে নিয়েছেন। কোনো কোনোটা পেশিশক্তির জোরে দখলও করেছেন। পরে নামে-বেনামে দলিল করে নিয়েছেন। নাগরী ও তুমুলিয়া ইউনিয়নজুড়েই মোমেন এক আতঙ্কের নাম। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও তার কাছে অসহায়।
সরেজমিন দেখা গেছে, রাজধানীর উপকণ্ঠ হলেও এখনো অনেকটাই অন্ধকারে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার তুমুলিয়া ও নাগরী ইউনিয়ন। গাড়ি চলাচলের অনুপযুক্ত ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট। ফলে ওই এলাকায় যেতে হয় হেঁটে। এই দুই ইউনিয়নেই চানখোলা, বাগরদিয়া এবং আমতলা বিল। তিন বিলের মাঝখান দিয়ে চানখোলা রাস্তা। সেই রাস্তার দুপাশে শতশত বিঘা এক ফসলি জমি। শুকনো মৌসুমে শুধু ধান চাষ হয়। বছরের বেশিরভাগ সময়ই থাকে পানিতে টইটম্বুর। সেখানে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন এলাকার অনেক মানুষ।
২০১৭ সালের দিকে এখানে আবির্ভূত হন র্যাবের তৎকালীন মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। প্রথমে টুকটাক জমি কিনতে শুরু করেন। তবে অধিকাংশ জমির মালিকই চুক্তি অনুযায়ী মূল্য পাননি। আবার কারোটা ভুয়া ও জাল দলিল বানিয়ে দখল করেছেন। বাসা থেকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়েও কারও কারও জমি লিখে নিয়েছেন। এভাবে নানা কায়দায় তিন বিলের বড় অংশ দখল করেন ক্ষমতাধর বেনজীর। এ কাজে তার মূল সহায়কের ভূমিকা পালন করেন নাগরী ইউনিয়নের রয়ান গ্রামের বাসিন্দা মো. মোমেন। তার সঙ্গে ছিলেন বিমল, রমজান ও প্রদীপ নামে আরও তিন দালাল। সম্প্রতি এসব জমি বিক্রি করে দিয়েছেন বেনজীর আহমেদ।
শুধু বেনজীর নন, আরও কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে জমি দখল করে দিয়েছেন মোমেন ও তার লোকজন। বেনজীরের সঙ্গে সখ্যের কারণে স্থানীয় থানা পুলিশও ছিল মোমেনের নিয়ন্ত্রণে। কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বললেই হয়রানির শিকার হতেন। থানায় ধরে নিয়ে নির্যাতনের নজিরও আছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
এতদিন ভয়ে কেউ মুখ না খুললেও এখন পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। বেনজীরের দেশ ছাড়ার খবর বেরোনোর পর অনেকেই মোমেনের অপকর্ম নিয়ে কথা বলতে শুরু করেছেন।
জানা যায়, নুন আনতে পানতা ফুরানো মোমেনের জীবনে আলাদিনের প্রদীপ হয়ে আসেন বেনজীর। সাবেক এই পুলিশপ্রধানের আশীর্বাদে শূন্য থেকে শত কোটিপতি হয়েছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, মোমেন নিজেকে বেনজীরের ম্যানেজার পরিচয় দিতেন। বলতেন, বেনজিরের সব সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব তার। নানা সময়ে এর প্রমাণও দেন। বেনজীর মাঝেমধ্যেই ঘুরতে যেতেন ওই এলাকায়। সঙ্গে থাকতেন মোমেন।
জানা যায়, জমিজমার খুঁটিনাটি ভালো বুঝতে পারায় অল্পদিনেই বেনজীর আহমেদের প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন মোমেন। ডিসি অফিসের পিয়ন হলেও বেনজীরের দরবারে ছিল তার অবাধ যাতায়াত। র্যাবের মহাপরিচালক থাকাকালে মাঝেমধ্যেই তুমুলিয়া এবং নাগরী ইউনিয়নে যেতেন বেনজীর। তখন তাকে বিলের জমি ঘুরিয়ে দেখাতেন মোমেন ও তার দলবল। প্রায় সারা বছরই বিল থেকে মাছ ধরে বেনজীর আহমেদের বাসায় পাঠাতেন মোমেন। একপর্যায়ে ওই বিলে সাধারণ মানুষের মাছ ধরায়ও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। কেউ মাছ ধরতে নামলেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পাঠিয়ে হয়রানি করা হতো। কেউ কথা না শুনলে ডেকে নেওয়া হতো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ক্যাম্পে। এভাবে অল্পদিনে তুমুলিয়া এবং নাগরী ইউনিয়নে নিজের একচ্ছত্র সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন মোমেন।
সরেজমিন চানখোলা রাস্তার পাশে বিলে কাজ করতে দেখা যায় মো. আলমগীর শেখকে। সেখানেই তার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জানান, তাকে পুলিশ দিয়ে বাড়ির সামনে থেকে তুলে নিয়ে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে জমি লিখে নিয়েছেন মোমিন। যে জমির বর্তমান মূল্য প্রায় ৭ কোটি টাকার ওপরে।
আলমগীর বলেন, ‘একজন এসআই এসে আমাকে কালীগঞ্জ নিয়ে যান। সেখানে এক বাড়িতে আটকে রাখেন। তারা কীভাবে যেন জানতে পারে কেটুন মৌজায় সাড়ে ৪৭ শতাংশ সম্পত্তি আছে। আমারে আটকাইয়া বলে জমি লিখে দিতে। আমি দিতে না চাইলে আমার বাড়িতে ফোন দিয়া বাবা-মাকে হুমকি দেয়। আমারে বলে, জমি তাদের নামে কওলা কইরা দেওয়ার জন্য; নাইলে আমারে বেনজীর স্যার ক্রস দিয়া মাইরা লাইব। ভয়ে ওনারা যার নামে বলেছেন তার নামে আমমোক্তারনামা কইরা দিসি।’
আলমগীরের ছোট ভাই জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘আমার ভাইরে উঠাই নেওয়ার পর মোমিন ফোন দিয়ে কয়, জমি না লেইখা দিলে ক্রসফায়ার দিয়া মাইরা লাইব। মায় আবার কান্নাকাটি করতেছে। মায় কয়, ওরা যেমনে কয় ওমনে জমি লিখে দিয়ে তোর ভাইরে বাঁচাই নিয়ায়।’
আব্দুর সোবাহান নামের আরেক ব্যক্তির কাছ থেকে ৩৫ শতাংশ জমি কেনার পর টাকা দেননি মোমেন। কালবেলাকে ওই ভুক্তভোগী বলেন, ‘আমার জমি ১২ লাখ টাকায় বিক্রির চুক্তি হয়। ২ লাখ টাকা দিয়া পাওয়ার নেয়। পাওয়ার নিয়া মোমেনে দলিল করে নেয়। এরপর টাকা চাইলে টাকাও দেয় না, আর জমিও দেয় না। হুমকি-ধমকি দেয়।’
জাহাঙ্গীর হোসেন নামে আরও এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমার ৫৭ শতাংশ জমি ভুয়া দলিল বানিয়ে দখল করে নেয় মোমেন। আমি আমার জমিতে পুকুর কাটতেছিলাম। কিন্তু পুলিশ এসে বাধা দিয়ে বলে, ওপরের নির্দেশ, কাজ করা যাবে না। স্থানীয় ভূমিদস্যু মোমেনের মাধ্যমে বেনজীর এই এলাকায় সব অপকর্ম করেছে। মোমেন নিজস্ব গুন্ডাবাহিনী পাঠিয়েও কাজে বাধা দেয়। আমি কাগজপত্র দেখতে চাইলে মোমেন বলে, র্যাব সদরদপ্তরে বসতে। পরে আমি আর ভয়ে আমার জমিতে যাইনি। সম্প্রতি বেনজীরের দুর্নীতির নানা তথ্য বের হওয়ার পর আমি আবার আমার জমির দখল নিয়েছি।’
আরও এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমার কয়েকজন আত্মীয়স্বজনের জমি জোর করে অল্পকিছু টাকা দিয়ে দলিল করে নিয়ে গেছে মোমেন। আমরা এই বিলের মাছ ধরে চলতাম। কিন্তু তারা জমি নেওয়ার পর আমাদের এই বিলে মাছও ধরতে দেওয়া হয় না। তারা সব মাছ ধইরা গাড়ি দিয়া নিয়া যায়। কেউ মাছ ধরতে নামলেও পুলিশ আইসা পড়ে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বেনজীরের সঙ্গে সাক্ষাতের মাত্র সাত থেকে আট বছরেই কয়েকশ কোটি টাকার মালিক বনে গেছেন একসময় পিয়নের চাকরি করা মোমেন। স্থানীয় নাগরী ইউনিয়নের রয়ান গ্রামের ৩ নম্বর ওয়ার্ডে কয়েক বিঘা জমি নিয়ে তৈরি করেছেন বিশালাকৃতির বাগানবাড়ি। বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, চারদিকে বিভিন্ন ফলদ বৃক্ষ রোপণ করা। পেছনে প্রায় শতবিঘা জমি নিয়ে একটি মাছের ঘের। যেই জমির মূল্য শতকোটির টাকার ওপরে। যেই ঘেরের অধিকাংশ জমিই তার দখল করা। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা কয়েকবার দেনদরবারও করেছেন।
তবে বেনজীরের জোরে মোমেন রয়ে গেছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। মাছের ঘেরে বর্তমানে কয়েক কোটি টাকার মাছ রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে দুটি গরুর খামার। যেখানে শতাধিক গরু রয়েছে। যার মূল্য প্রায় ৫ কোটি টাকার ওপরে। এ ছাড়া বাড়ির পাশেই রয়েছে বিশাল একটি মুরগির খামার। যেখানে সোনালি জাতের কয়েক হাজার মুরগি রয়েছে। এ ছাড়া বাড়ির আশপাশের সব জমিই মোমেন জোর করে দখল করে নিয়েছেন বলে জানান স্থানীয়রা।
স্থানীয় এক ইউপি সদস্য বলেন, ‘মোমেন একসময় নাগরী বাজারে ওর বাবার সঙ্গে দোকান করত। এরপর ডিসি অফিসে পিয়নের চাকরি করত। কিছুদিন পর দেখি চাকরি ছেড়ে বেনজীর সাহেবকে নিয়ে এ এলাকায় আসে। এরপর তার ভয় দেখাইয়া বিভিন্ন মানুষের জমিজমা জোর-জবরদস্তি করে এখন সে শত শত কোটি টাকার মালিক। সে একটা মাছের ঘের বানিয়েছে প্রায় শত বিঘা জমি নিয়ে। সেখানেও অসংখ্য মানুষের জমি দখল করেছে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়রা আমার কাছে বিচার দিয়েছে। আমরা সালিশিও করেছি, তার ঘেরটি বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু পারিনি।’
অভিযুক্ত মো. মোমেনকে টেলিফোন করে সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। বলেন, ‘এ ধরনের কথা বলবেন না ফোনে। আপনি আমাকে এই ধরনের প্রশ্ন করছেন কেন।’
‘আপনি তো একসময় ডিসি অফিসের পিয়ন ছিলেন এত অল্পদিনে শতশত কোটি টাকার মালিক কীভাবে হলেন’—এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমি ৫ হাজার কোটি টাকার মালিক থাকি। তাতে আপনার সমস্যা কী? বেনজীর সাবের ইস্যু নিয়া কথা বলেন। আমি কী করছি সেটা তো দেখার বিষয় নয়। আপনি ফোনে এ ধরনের কথা বলছেন কেন?’
এরপর উত্তেজিত হয়ে অশ্রাব্য ভাষা ব্যবহার করে বলেন, ‘আমারে কি আপনি বেনজীর সাব পাইছেন? আমি জমির দালালি করি। আমার পেশা জমির দালালি করা।’
মোমেন জানান, ‘বেনজীর সাহেব গ্রুপ করে এখানে জায়গা কিনছেন একটা বাগান বাড়ি করার জন্য। এখন তার প্রকল্পটা বাতিল করা হয়েছে। আমরা জমির দালালি করি। আমরা জমি কেইনা বেইচা দেই। দুই পয়সা পাই।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।