নিজস্ব প্রতিবেদক, গাজীপুর: গাজীপুরের কালীগঞ্জে অবস্থিত ‘ফুসফুস’ খ্যাত বেলাই বিল অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে। এক সময়ের ৫০ বর্গকিলোমিটারের প্রাকৃতিক জলাভূমি আজ সংকুচিত হয়ে এসেছে মাত্র ৮ বর্গকিলোমিটারে। জলাশয় রক্ষায় উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও থেমে নেই ভরাট ও দখলের অপতৎপরতা। অভিযোগ উঠেছে, ‘নর্থ সাউথ গ্রুপ’ ও ‘তেপান্তর গ্রুপ’ নামের দুটি প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান প্রকাশ্যেই আদালতের আদেশ লঙ্ঘন করে বিল দখলে নিচ্ছে।
সরেজমিনে টঙ্গী-কালীগঞ্জ সড়কের পাশের নলছাটা এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেলাই বিলের একাংশে টাঙানো রয়েছে নর্থ সাউথ ও তেপান্তর গ্রুপের সাইনবোর্ড। যেখানে আগে রাতের আঁধারে বালু ফেলার কাজ চলত, সেখানে এখন প্রকাশ্যে দিনের আলোয় ডাম্প ট্রাকে করে জমি ভরাট করা হচ্ছে।
স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, প্রশাসনের অভিযান যেন লোক দেখানো মাত্র। দখলদার চক্রের বিরুদ্ধে কয়েক দফা অভিযান চালিয়ে কিছু কর্মচারীকে আটক ও জরিমানা করা হলেও মূল পরিকল্পনাকারীরা রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে।
২০১৯ সালে হাইকোর্টের রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে বেলাই বিলে ভরাট, দখল কিংবা শ্রেণি পরিবর্তনের ওপর স্থিতাবস্থা জারি করা হয়। তবে অভিযোগ রয়েছে, আদালতের এই আদেশকে পাশ কাটিয়ে প্রভাবশালী চক্র নিয়মিতই চালিয়ে যাচ্ছে বালু ফেলার কার্যক্রম। প্রশাসনের পদক্ষেপ অপ্রতুল হওয়ায় বিল দখলের গতি যেন বেড়েই চলেছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, জমি অধিগ্রহণে প্রভাবশালীদের হয়ে কাজ করছে একাধিক দালালচক্র। তুমলিয়া ইউনিয়নের দড়িপাড়া গ্রামের রিতা পালমা অভিযোগ করেন, “নর্থ সাউথের হয়ে কাজ করা সাইদুল প্রথমে জমি বিক্রির প্রলোভন দেখান, রাজি না হলে ভয়ভীতি দেখানো শুরু করেন। রাতের আঁধারে আমার জমিতে জোরপূর্বক বালু ফেলা হয়।”
অপর এক ভুক্তভোগী জানান, চার বিঘা জমির চুক্তিমূল্য ধরা হয় এক কোটি টাকা। কিন্তু জমি দখলের পর মাত্র ২২ লাখ টাকা দিয়ে কার্যক্রম থামিয়ে দেওয়া হয়। বাকি টাকা আদায়ের চেষ্টা করলে নানা অজুহাতে ঘোরানো হয়।
নর্থ সাউথ গ্রুপ বিল দখলের পর সেখানে একটি অবৈধ সাইট অফিস তৈরি করেছে, যাতে রয়েছে বিদ্যুৎ সংযোগও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কালীগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি একবার আদালতের নির্দেশে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেও পরবর্তীতে রহস্যজনকভাবে আবার তা পুনঃস্থাপন করা হয়। এই বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির ডিজিএম আক্তার হোসেন জানান, “জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেই সংযোগ দিতে হয়।” তবে কীভাবে অবৈধ স্থাপনায় সংযোগ দেওয়া হলো, সে বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারেননি।
এই প্রতিবেদক নর্থ সাউথ ও তেপান্তর গ্রুপের সাইট অফিসে উপস্থিত হয়ে কাউকে না পেয়ে মোবাইলে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তবে কেউ ফোন ধরেননি বা কোনো মন্তব্য দেননি।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, বিলটি ভরাট হলে এই অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিলপারের হাজারো জেলে ও কৃষক পরিবার কর্মহীন হয়ে পড়বে। পাশাপাশি এই অঞ্চল দেশের অন্যতম ধান উৎপাদনকারী এলাকা হওয়ায় খাদ্য উৎপাদনেও বিপর্যয় দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, বর্ষাকালে পানি ধারণের এই প্রাকৃতিক আধার হারিয়ে গেলে গাজীপুর শহরসহ আশপাশে জলাবদ্ধতা ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তনিমা আফ্রাদ বলেন, “বেলাই বিল রক্ষায় প্রশাসন সর্বোচ্চ আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করছে। একাধিক অভিযানে মালামাল জব্দ ও দোষীদের সাজা দেওয়া হয়েছে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”
বিদ্যুৎ সংযোগ বিষয়ে তিনি জানান, “এটা নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
একদিকে আদালতের নির্দেশ, অন্যদিকে প্রশাসনের অভিযান—সবকিছু ছাপিয়ে শক্তিশালী একটি দখলচক্র বেলাই বিল গিলে ফেলছে। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে একের পর এক আদেশ-অভিযান উপেক্ষা করে বিল দখল সম্ভব হয়? এই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত বিল রক্ষার লড়াই কেবল কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।