জুমবাংলা ডেস্ক : বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের অফিস সহকারীর সহায়তায় এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নের বিপরীতে তৈরি নমুনা উত্তরপত্র পেয়ে তা খাতায় তুলে দেন ১৮ শিক্ষার্থী। তবে নিরীক্ষকের হাতে খাতা যাওয়ার পর ঘটনা ধরা পড়ে যায়। পরে অনুসন্ধানে অফিস সহকারী ও শিক্ষার্থীদের জালিয়াতির বিষয়টি সামনে চলে আসে। এ ঘটনায় শিক্ষার্থীদের ফলাফল স্থগিত ও অফিস সহকারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
জানা যায়, এবার এইচএসসির উচ্চতর গণিতের খাতা নিরীক্ষণের দায়িত্ব পান নলছিটি সরকারি ডিগ্রি কলেজের প্রভাষক মো. আবু সুফিয়ান। এ বছর উচ্চতর গণিতের ২০০টি উত্তরপত্র নিরীক্ষণ করেন তিনি। তবে খাতা নিরীক্ষা করতে গিয়ে ১৮টি খাতায় সমস্যা পান। ওইসব খাতায় উত্তর এমনভাবে লেখা হয়েছে যেখানে নম্বর কাটার কোনও উপায় নেই। শুধু তাই নয় ১৮টি খাতায় একটি দাঁড়ি, কমাও ভুল ছিল না। সুফিয়ান মিলিয়ে দেখেন শিক্ষাবোর্ড থেকে উচ্চতর গণিত বিষয়ের উত্তরপত্র যেভাবে তৈরি করা ঠিক সেভাবেই ওই ১৮টি খাতায় উত্তর লেখা হয়েছে। সেখানে কোনও ভুল নেই। বিষয়টি দেখে সন্দেহ হলে তিনি প্রধান পরীক্ষকের সঙ্গে আলোচনা করেন। প্রধান পরীক্ষক খাতাগুলো নিয়ে আসেন শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে। এরপরই বেরিয়ে আসে জালিয়াতির মূল কাহিনী।
শিক্ষাবোর্ড সূত্র জানায়, এবার তিন ধাপে খাতা মূল্যায়ন করা হয়। প্রথমে পরীক্ষক খাতা মূল্যায়ন করে নম্বর দেন। পরে নিরীক্ষক প্রতিটি খাতা নিরীক্ষা করেন। সর্বশেষ প্রধান পরীক্ষক স্বাক্ষর করে উত্তরপত্র বোর্ডে পাঠান। শিক্ষাবোর্ডে ১৮টি উত্তরপত্র নিয়ে যে জালিয়াতি হয়েছে তার পরীক্ষক ছিলেন নগরীর তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মহিলা কলেজের গণিতের শিক্ষক মনিমোহন। তিনি অবসরে গেছেন। প্রধান পরীক্ষক ছিলেন পিরোজপুরের সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের সহযোগী অধ্যাপক মো. শহিদুল ইসলাম।
এ বিষয়ে গণিতের নিরীক্ষক আবু সুফিয়ান বলেন, আমার শিক্ষকতার বয়স ২৫ বছর। ১০ বছর ধরে আমি খাতা নিরীক্ষণের কাজ করছি। কিন্তু ১৮টি খাতা মূল্যায়ন করতে গিয়ে আমার সন্দেহ হয়। আগে আমরা নিজেরাই উত্তরপত্রে নিজেদের মতো করে নম্বর দিতাম। কিন্তু সৃজনশীল হওয়ার পর বোর্ড থেকে প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে দেওয়া হয়। তা মিলিয়েই উত্তরপত্র মূল্যায়ন করা হয়। তবে ওই ১৮টি খাতায় হুবহু বোর্ডের উত্তরপত্র তুলে দেওয়া হয়। উত্তরপত্রে একটি অঙ্ক ১৩ লাইনে শেষ হয়েছে। ওই পরীক্ষার্থীর খাতায়ও ঠিক সেইভাবে ১৩ লাইনে অঙ্ক উঠানো। পরে আমি প্রধান পরীক্ষককে বিষয়টি জানাই। তিনি চেয়ারম্যানের স্যারের কাছে খাতাগুলো নিয়ে যান।
প্রধান পরীক্ষক শহিদুল ইসলাম বলেন, উচ্চতর গণিতের নমুনা উত্তরপত্র তৈরি করেছি আমি ও পিরোজপুরের মঠবাড়ীয়া সরকারি কলেজের প্রভাষক আলাউদ্দীন খান। তিনি আগে নগরীর সরকারি বরিশাল কলেজে শিক্ষকতা করতেন। আমরা দুই জন যেভাবে উত্তরপত্র তৈরি করেছি তেমনই টু দ্য পয়েন্টে তা খাতায় লেখা। একটি জটিল প্রশ্ন এসেছিল, যার উত্তর তৈরি করতে আমাদের খুব কষ্ট হয়েছে, তাও হুবহু তুলে দেওয়া হয়েছে। পরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ওই ১৮ জনের মধ্যে এমন পরীক্ষার্থীও আছে যে গেলবার তিন/চার বিষয়ে ফেল করেছে, অথচ এবার সে গোল্ডেন জিপিএ-৫ পেয়েছে। বিষয়টি সন্দেহ হলে আমি শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান স্যারকে বিষয়টি জানাই। পরে তিনি আমাকে খাতাগুলো নিয়ে যেতে বলেন।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে শুধু উচ্চতর গণিতই নয়, এভাবে সব বিষয়েই জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন ওই ১৮ শিক্ষার্থী। এবার ওই ১৮ জন পরীক্ষার্থীর সবাই জিপিএ-৫-ও পেয়েছে, একজন পেয়েছে গোল্ডেন। তারা শুধু উচ্চতর গণিতই নয়, সব বিষয়ের উত্তরপত্র বাসায় নিয়ে লিখে জমা দিয়েছেন। ফলে প্রতি বিষয়ে তারা শতভাগ নম্বর পেয়েছে (লিখিত পরীক্ষায়)। তাদের রেজাল্ট ঘেঁটে দেখা গেছে কেউ ৪ পয়েন্ট এর বেশি পায়নি। আবার অনেকে ক্যাজুয়াল পরীক্ষার্থী। তারা একাধিক বিষয়ে ফেল করেছিল। তারা এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে।
তাদের জালিয়াতি বিষয়টি ধরা পড়ার পর সম্প্রতি ১৮ পরীক্ষার্থীকে ডেকে আনা হয় বরিশাল শিক্ষাবোর্ডে। পূর্বের প্রশ্নপত্র দিয়েই উত্তর লিখতে বলা হয় তাদের। কিন্তু ১৮ পরীক্ষার্থীর একজনও একটি প্রশ্নের উত্তরও লিখতে পারেনি। এরপরই জালিয়াতির বিষয়টি নিশ্চিত হন শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান। শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যানের কাছে পরীক্ষার্থীরা স্বীকার করেন অফিস সহকারী গোবিন্দ চন্দ্রের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে তারা পরীক্ষার খাতা ও উত্তরপত্র বাইরে নিয়ে লিখেছেন। এর বিনিময়ে প্রত্যেক শিক্ষার্থী গোবিন্দকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার পরীক্ষা সংক্রান্ত আইনশৃঙ্খলা সভায় জালিয়াতির বিষয়টি উপস্থাপনের পর অফিস সহকারী গোবিন্দকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। তবে এর সঙ্গে আরও বড় রাঘব বোয়ালরা জড়িত রয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষাবোর্ডের একাধিক সূত্র।
যে ১৮টি খাতা নিয়ে জালিয়াতি হয়েছে ওই খাতাগুলোর পরীক্ষক ছিলেন তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া কলেজের শিক্ষক মনিমোহন। তিনি কিছুদিন আগে অবসরে গেছেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো ১৮টি খাতায় উত্তরপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে হুবহু উত্তর লিখে দেওয়ার পরেও নজরে আসেনি পরীক্ষকের। তিনি ১৪টি খাতায় ৫০ এর মধ্যে ৫০ নম্বর দিয়েছেন। আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো প্রত্যেক পরীক্ষক খাতা পেয়েছেন ২৫০টি কিন্তু মনিমোহন খাতা নিয়েছেন ২৬৯টি। প্রশ্ন হলো এই ১৯টি খাতা তিনি কীভাবে পেলেন, কার কাছ থেকে নিলেন। এ বিষয়ে শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান ওই পরীক্ষকের কাছে জানতে চাইলে তিনি (পরীক্ষক) জানিয়েছেন অফিস সহকারী গোবিন্দ তাকে ডেকে নিয়ে ওই খাতা দিয়েছেন।
শিক্ষাবোর্ড চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইউনুস জানান, শুধু গোবিন্দ একা নয় এর সঙ্গে আরও অনেকে জড়িত আছেন। আমরা এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি করেছি। পেছনে কারা আছে সব বের হবে। জালিয়াতির বিষয়টি দেখে আমি বিস্মিত হয়েছি। কারণ ১৮ জন পরীক্ষার্থী একই কেন্দ্রের নয়। সৈয়দ হাতেম আলী কলেজ, মডেল কলেজ, সরকারি মহিলা কলেজসহ ১০টি কেন্দ্রের পরীক্ষার্থীদের খাতা চলে গেছে একই পরীক্ষকের কাছে। এটা কীভাবে সম্ভব?
তিনি জানান, এ ঘটনায় অফিস সহকারী গোবিন্দকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে এবং ১৮ পরীক্ষার্থীর ফলাফল স্থগিত রয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।