কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কী? সম্ভবত আপনার মাথায় চট করে চলে এসেছে চ্যাটজিপিটির নাম। ওপেনএআইয়ের এই এআই চ্যাটবট ইন্টারনেটের জগতে বিপুল জনপ্রিয় নাম। এটি যেন এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একরকম প্রতিশব্দই হয়ে উঠেছে!
শুধু এটিই কিন্তু নয়। আমরা দেখছি, গুগলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে তথ্য খুঁজে দিচ্ছে, মিডজার্নি এঁকে দিচ্ছে ছবি। আর চ্যাটজিপিটি বা গুগলের বার্ড রীতিমতো আলাপ-আলোচনায় অংশ নিয়ে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে সবাইকে।
আমাদের কাছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিচয় এগুলো হলেও গবেষকদের কাছে এর ব্যবহার আরও অনেক বিস্তৃত। তাঁরা বহু বছর ধরেই বিপুল তথ্য বিশ্লেষণ ও বিন্যাসের কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্য নিচ্ছেন। এটিকে তাই আধুনিক সময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি ও গবেষণা টুল বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
এর প্রয়োগও দেখা যাচ্ছে হাতে-কলমে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অদেখা নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি শনাক্ত করতে পারছে মহাকাশের ছবি দেখে, ভিন্নধর্মী বিশ্লেষণ করছে বিভিন্ন তথ্যের, নতুন সম্ভাবনার কথা বলছে বিজ্ঞানীদের।
এসব কীভাবে করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা? জিনিসটা তো আসলে যন্ত্র—মানে ধরুন, কম্পিউটার প্রোগ্রাম। আর আমরা জানি, কম্পিউটার চিন্তা করতে পারে না। তাহলে বিষয়টা কী? ঠিক এখানেই চলে আসে বর্তমানে বহুল প্রচলিত আরেকটি শব্দ—মেশিন লার্নিং। বিষয়টা হলো, মেশিন বা যন্ত্র শিখতে পারে। এই শেখার প্রক্রিয়ার নামই মেশিন লার্নিং।
সাধারণভাবে যেকোনো যন্ত্রকেই তো শেখানো বা বলে দেওয়া হয়, কীভাবে কাজ করতে হবে। তাহলে সাধারণ সফটওয়্যার বা প্রোগ্রামের সঙ্গে মেশিন লার্নিংয়ের পার্থক্য কী? পার্থক্য হলো, সাধারণ প্রোগ্রামিংয়ের ক্ষেত্রে যন্ত্র কী কী করবে, ধাপে ধাপে সব বলে দিতে হয়। আর মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে অনেকগুলো উদাহরণ দেওয়া হয়।
এসব উদাহরণ বিশ্লেষণ করে প্রোগ্রামটি নিজে নিজে শিখে নেয়, কীভাবে কী করতে হবে। অর্থাৎ মেশিন লার্ন করে বা শেখে এবং সে অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এককথায়, আমরা একেই বলি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
যন্ত্রের এই শেখা বা মেশিন লার্নিংয়ের একটা বিশেষ পদ্ধতি আছে। এই পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ দিলে বা শেখালে দেখা যায়, যন্ত্র বা প্রোগ্রাম মানুষের মস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে, তাকে নকল করতে পারে। এটাকেই বলা হয় কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্ক। এ প্রযুক্তি তৈরি করা হয়েছে আমাদের মস্তিষ্কের গঠন অনুসরণ করে।
আমাদের মস্তিষ্কের কোষগুলোকে বলা হয় নিউরন। এগুলোই মস্তিষ্কের গাঠনিক একক। শতকোটি নিউরন পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বুদ্ধিমত্তা এবং স্মৃতি সংরক্ষণব্যবস্থা তৈরি করে। কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কে মস্তিষ্কের নিউরনের আদলে তৈরি করা হয় একেকটি নোড—বলতে পারেন, নেটওয়ার্কের একক প্রতিটি অংশ। নিউরনের মতো প্রতিটি নোড হয় আলাদা মান ও বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। প্রতিটি নোড পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পরস্পরকে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দিয়ে প্রভাবিত করে।
এই কানেকশন বা সংযোগগুলো আবার শক্তিশালী বা দুর্বল হতে পারে। এখানে শক্তিশালী বা দুর্বল হওয়ার অর্থ, নোডগুলোর মধ্য দিয়ে সিগন্যাল প্রবাহিত হচ্ছে কি না, সেটা। সিগন্যাল প্রবাহিত হলে সেটাকে ‘হাই’ বলতে পারি (কিংবা বলতে পারেন ১), আর সিগন্যাল প্রবাহিত না হলে বলতে পারেন এর মান ‘লো’ (বা ০)। একটা নেটওয়ার্ককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় নোডগুলোর মান ‘হাই’ করে তোলার চেষ্টা করা হয়, অর্থাৎ নোডগুলোকে একসঙ্গে কর্মক্ষম করে তোলার চেষ্টা করা হয়। এভাবে পুরো নেটওয়ার্কের মধ্যে একটা শক্তিশালী যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে ওঠে। তখন মস্তিষ্কের মতোই পুরো নেটওয়ার্কটি মিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এ বছর কৃত্রিম নিউরাল নেটওয়ার্কে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে যে দুজন বিজ্ঞানীকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তাঁরা এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা শুরু করেন সেই ১৯৮০-এর দশকে।
নোবেল কমিটি এককথায় বলেছে, জন হপফিল্ড এমন একটি অবকাঠামো বানিয়েছেন, যা তথ্য জমা করে রাখার পাশাপাশি আবার রিকনস্ট্রাক্টও (পুনর্গঠন) করতে পারে। আসলে প্যাটার্ন বা নির্দিষ্ট ছাঁচ সংরক্ষণ ও আবার তৈরি করতে পারে, এমন একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করেন জন হপফিল্ড। একে এখন বলা হচ্ছে ‘হপফিল্ড নেটওয়ার্ক’।
এ ক্ষেত্রে প্রতিটা নোডকে আপনি ডিজিটাল ছবির একেকটি ‘পিক্সেল’ হিসেবে কল্পনা করতে পারেন। ‘হপফিল্ড নেটওয়ার্ক’ তৈরির পেছনে পদার্থবিজ্ঞানের মৌলিক ধারণাগুলো কাজে লাগিয়েছেন জন হপফিল্ড। বিশেষ করে পদার্থের পারমাণবিক ঘূর্ণন বা স্পিন কাজে লাগানো হয়েছে। এই স্পিনের কারণে প্রতিটি পরমাণু একেকটি ছোট্ট চুম্বকের মতো আচরণ করে।
এই নেটওয়ার্কটি জন হপফিল্ড পদার্থবিজ্ঞানের স্পিন–ব্যবস্থার শক্তিদশার আদলে তৈরি করেন। আমরা জানি, একটা সিস্টেমে পরমাণুগুলো সব সময় নিম্নশক্তির অবস্থায় যেতে চায়। একইভাবে হপফিল্ড নেটওয়ার্ক কানেকশন বা সংযোগগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে চেষ্টা করে যেন সেভ করা ছবির শক্তিদশা হয় সর্বনিম্ন।
ধরুন, এই নেটওয়ার্ককে একটা ঝাপসা বা অসমাপ্ত ছবি দেওয়া হলো। ডিজিটাল ছবির কথা ভাবলে—এর কিছু পিক্সেল মিসিং। নেটওয়ার্কটা এখন কাজ করবে, চেষ্টা করবে ছবিটাকে পূর্ণতা দিতে। কীভাবে দেবে? এটি বিভিন্ন ধরনের পিক্সেল মিলিয়ে পুরো নেটওয়ার্কের শক্তি যে পিক্সেলের জন্য সর্বনিম্ন হয়, সেই পিক্সেলটা বেছে নেবে। সেই পিক্সেলটা বসাবে একটা মিসিং পিক্সেলের জায়গায়। এভাবে ধাপে ধাপে এটি বারবার নতুন পিক্সেল তৈরি করে, তা সঠিক জায়গায় বসিয়ে বসিয়ে ঝাপসা বা অসমাপ্ত ছবিটিকে সম্পূর্ণ ছবিতে রূপান্তর করে।
অন্যদিকে কানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জেফরি হিন্টন এই হপফিল্ড নেওয়ার্ক ব্যবহার করে নতুন একধরনের নেটওয়ার্ক তৈরি করেন। এই নেটওয়ার্ককে বলা হয় ‘বোলজম্যান মেশিন’। এর ভিত্তি হপফিল্ড নেটওয়ার্ক হলেও কাজের পদ্ধতি ভিন্ন।
বোলজম্যান মেশিনকে একগাদা উদাহরণ ইনপুট হিসেবে দেওয়া হয়। এসব উদাহরণ দেখে দেখে সে প্যাটার্ন বা ছাঁচ ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য আলাদা করতে শেখে। এবার টেস্ট বা পরীক্ষার জন্য কোনো ছবি দিলে সেই ছবিটা কোন ক্যাটাগরি বা বিভাগের, সেটা আলাদা করতে পারে বোলজম্যান মেশিন। আবার প্যাটার্ন অনুসারে অসমাপ্ত ছবিকে সম্পূর্ণ করতে পারে কিংবা বানাতে পারে নতুন ছবিও।
বর্তমানে যন্ত্র যে শিখছে, কথা বলছে, ছবি আঁকছে, এসবেরই ভিত্তি গড়ে দিয়েছেন এবারের দুই নোবেলজয়ী—জন জে হপফিল্ড ও জেফরি ই হিন্টন। আজকের এই বৈপ্লবিক এআইয়ের দুনিয়ায় বসে তাঁদের কাজের গুরুত্ব বোধ হয় আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।