বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ডেস্ক : ছোটবেলায় স্কুলের বিজ্ঞান বইতে পড়েছি, পদার্থের তিনটি রূপ রয়েছে। কঠিন, তরল এবং বায়বীয়। কঠিন পদার্থের একটি নির্দিষ্ট আকার এবং আয়তন থাকে। কঠিন পদার্থের আকার পরিবর্তন করতে হলে যথেষ্ট বল প্রয়োগ করতে হয়।
অন্যদিকে তরল পদার্থের আয়তন নির্দিষ্ট হলেও, এর আকার নির্দিষ্ট নয়। তরল পদার্থ যে পাত্রে রাখা হয় সেই পাত্রের আকার ধারণ করে। এখানে বল প্রয়োগ করার কোন প্রয়োজন হয় না। একই ভাবে, বায়বীয় পদার্থের আকারও খুব সহজেই পরিবর্তিত হতে পারে।
পদার্থের রূপ পরিবর্তনের জন্য তাপমাত্রার একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যেমন ধরুন, পানিকে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রাখলে তরল পানি কঠিন বরফের আকার ধারণ করে। তারপর কঠিন বরফকে শূন্য ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার উপরে নিয়ে আসলে সেটা গলে গিয়ে আবার তরল পানিতে রূপান্তরিত হয়। তরল পানির তাপমাত্রা বাড়িয়ে একশ ডিগ্রি সেলসিয়াস করা হলে সেটা বাষ্পে পরিণত হয়।
এভাবে তাপমাত্রা কমিয়ে অথবা বাড়িয়ে কোন পদার্থকে কঠিন, তরল এবং বায়বীয় তিনটি অবস্থায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। সব পদার্থেরই ভিন্ন ভিন্ন গলনাঙ্ক এবং স্ফুটনাঙ্ক রয়েছে। তাপমাত্রা পরিবর্তনের ফলে পদার্থ কঠিন, তরল এবং বায়বীয় এই তিনটি রূপই ধারণ করতে পারে।
কঠিন পদার্থের ভেতরে অণুগুলো বেশ আঁটসাট অবস্থায় থাকে। কিন্তু তাপমাত্রা বাড়ালেই, পদার্থের অণুগুলো ছোটাছুটি শুরু করে।
পদার্থের ভেতরে আণবিক বন্ধনগুলো তখন শিথিল হয়ে আসে। তারপর শিথিল হতে হতে, এক পর্যায়ে কঠিন পদার্থ তরল পদার্থে রূপান্তরিত হয়। তাপমাত্রা আরো বাড়ালে, অণুগুলোর ছোটাছুটির মাত্রা আরো বেড়ে যায়, তখন তরল পদার্থ বায়বীয় পদার্থে রূপান্তরিত হয়। তাপগতিবিদ্যার নিয়মেই এই পরিবর্তন ঘটে।
কলেজে পড়ার সময় জেনেছি, পদার্থের তাপমাত্রা আরও অনেক বেশি বাড়ালে, এক পর্যায়ে গ্যাসীয় পরমাণু থেকে সব ইলেকট্রন বেরিয়ে আসে। এর ফলে গ্যাসীয় পরিমন্ডল সম্পূর্ণভাবে আয়োনাইজড হয়ে যায়। পদার্থের এই আয়োনাইজড বা চার্জিত অবস্থাকে বিজ্ঞানীরা বলেন, প্লাজমা। এটি হলো পদার্থের চতুর্থ রূপ। সূর্য এবং অন্যান্য নক্ষত্রের ভেতরে এই অবস্থা বিরাজমান।
পরে বড় হয়ে জেনেছি, এর বাইরেও পদার্থের আরেকটি অদ্ভুত অবস্থা রয়েছে। এর নাম, বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট (Bose-Einstein Condensate) এটি হলো পদার্থের পঞ্চম রূপ। সংক্ষেপে একে বলে, BEC।
মজার ব্যাপার হলো, এখন থেকে প্রায় একশ বছর আগে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু এ ব্যাপারে সর্বপ্রথম তাত্ত্বিক ধারণাটি দিয়েছিলেন। ১৯২৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর গবেষণাপত্রটি পাঠিয়ে ছিলেন বৃটেনের বিখ্যাত ফিলোসফিকাল ম্যাগাজিনে। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল ম্যাক্স প্ল্যান্কের কোয়ান্টাম বিকিরণ তত্ত্ব ব্যবহার করে সম্পূর্ণ এক নুতন পদ্ধতিতে অভিন্ন বস্তুকণার অবস্থানের সম্ভাব্যতা নির্ণয় করা। কিন্তু এই গবেষণাপত্রটি ব্রিটিশ পত্রিকায় ছাপা হলো না। সম্পাদকরা মনে করলেন এই গবেষণাটি প্রকাশের উপযুক্ত নয়। বাতিল করে পাঠিয়ে দিলেন অধ্যাপক বসুর কাছে। কিন্তু হার মানার পাত্র নন তিনি।তিনি জানতেন, তাঁর গবেষণার সুদুর প্রসারী সম্ভবনা রয়েছে। তাই তিনি সাহসের সাথে গবেষণাপত্রটি পাঠিয়ে দিলেন পদার্থবিজ্ঞানের দিকপাল জার্মানীর আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছে।
আইনস্টাইনের খ্যাতি তখন বিশ্বব্যাপী। কথায় বলে জহুরী জহর চেনে। আইনস্টাইন গবেষণাপত্রটি পড়ে বুঝতে পারলেন এর মর্মকথা। উনি গবেষণাপত্রটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে পাঠিয়ে দিলেন জার্মানির বিখ্যাত জার্নাল, সাইটস্রিফট ফুর ফিজিকে (Zeitschrift fur Physik), সঙ্গে নিজের একটি সুপারিশ পত্রও দিলেন গবেষণাটির গুরুত্ব বোঝানোর জন্য।
গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হবার পর আর ফিরে তাকাতে হয়নি অধ্যাপক বসুকে। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেলেন তিনি। তাঁর গবেষণা থেকে উঠে এসেছে বস্তুকণাদের শক্তি নির্ণয়ের জন্য এক নতুন পরিসংখ্যান, যার নাম বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স। পরবর্তীতে তাঁর পরিসংখ্যান ব্যবহার করে, আইনস্টাইন ১৯২৫ সালে তাত্ত্বিকভাবে দেখালেন, পরম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রায় গ্যাসীয় পদার্থের পরমাণুগুলো একটি অভিন্ন কোয়ান্টাম অবস্থায় চলে আসে, যার বৈশিষ্ট্য হয় একটি একক পরমাণুর মত। এটিই হলো বস্তুর পঞ্চম অবস্থা। বস্তুর এই অবস্থা, বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট নামে এখন সুপরিচিত।
পরিতাপের বিষয় হলো, বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেটের পরীক্ষামূলক প্রমাণ অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি। তাঁর তিরোধানের একুশ বছর পর, ১৯৯৫ সালে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেটের অস্তিত্ব পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। এই আবিষ্কারটির জন্য, ২০০১ সালে তিনজন বিজ্ঞানীকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছিলো। এদের নাম: এরিক কর্নেল, কার্ল উইম্যান এবং উল্ফগ্যা়ং ক্যাটরলা। এদের প্রথম দুজন যৌথভাবে এবং পরেরজন একক ভাবে, পরীক্ষাগারে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট তৈরি করতে সক্ষম হন।
আগেই বলেছি বোস আইনস্টাইন কনডেনসেট তৈরি করতে হলে, তাপমাত্রা কমিয়ে নামিয়ে আনতে হবে পরম শূন্য বা জিরো ডিগ্রী কেলভিন তাপমাত্রার কাছাকাছি অর্থাৎ মাইনাস ২৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার কাছাকাছি। বাস্তবে জিরো ডিগ্রী কেলভিন তাপমাত্রায় নামা কখনো সম্ভব হয়নি, কিন্তু বিজ্ঞানীরা পরীক্ষাগারে ন্যানো ডিগ্রী কেলভিন তাপমাত্রা সৃষ্টি করতে পেরেছেন। ন্যানো ডিগ্রি কেলভিন হলো, এক ডিগ্রি কেলভিনের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগ মাত্র। বিজ্ঞানীরা তাঁদের পরীক্ষাগারে লেজার কুলিং এবং ম্যাগনেটিক ট্রাপিং পদ্ধতি ব্যবহার করে রুবিডিয়াম এবং সোডিয়াম গ্যাসের তাপমাত্রা ন্যানো ডিগ্রি কেলভিনে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। এই তাপমাত্রায় গ্যাসের পরমাণুগুলো অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্ব অনুযায়ী বস্তুকণারা শুধুমাত্র কণাই নয়, একই সাথে তারা তরঙ্গও বটে। তাপমাত্রা যখন পরম শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছায় তখন বস্তুকণার তরঙ্গ ধর্ম প্রকট হয়ে ওঠে। ন্যানো ডিগ্রি কেলভিন তাপমাত্রায় বস্তুকণার সম্মিলিত তরঙ্গ একত্রিত হয়ে একটি একক তরঙ্গে পরিণত হয়। তখন পুরো বস্তুটি একটি একক পরমাণুর মত আচরণ করা শুরু করে। অন্য ভাবে বলা যায়, পদার্থ তখন আত্মপরিচয়ের সংকটে ভোগে। এটাই হলো পদার্থের পঞ্চম রূপ, এরই নাম বিজ্ঞানীরা দিয়েছেন, বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট। এর তাত্ত্বিক ধারণা, প্রায় একশ বছর আগে সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং আলবার্ট আইনস্টাইন দিয়ে গিয়েছিলেন।
পরীক্ষাগারে বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট আবিষ্কার হওয়ার পর থেকে বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে জোর গবেষণা শুরু করেছেন। ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কিউবিট, এটমিক লেজার, এটমিক ক্লক, সুপার ফ্লুইডিটি সহ বিভিন্ন আধুনিক প্রযুক্তিতে এর ব্যাপক ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়াও পদার্থের স্বরূপ উদঘাটনে এনিয়ে মৌলিক গবেষণা চলছে।
অধ্যাপক বসুর ভাগ্যে কিন্তু নোবেল পুরস্কার জোটেনি। জীবদ্দশায় তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্য তিনবার মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাঁকে নোবেল পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করা হয়নি। অনেকে মনে করেন, তাঁকে নোবেল পুরস্কার না দেওয়াটা নোবেল কমিটির নিদারুণ ব্যর্থতা। আবার অনেক মনে করেন, শুধুমাত্র তাত্ত্বিক ধারণার উপর ভিত্তি করে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় না। নোবেল পুরস্কার পেতে হলে তত্ত্বটি নির্ভুলভাবে প্রমাণিত হওয়া আবশ্যক। যদিও বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেটের অস্তিত্ব পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, কিন্তু সেটা হয়েছে অধ্যাপক বসুর মৃত্যুর পর। মরনোত্তর নোবেল পুরস্কার দেবার বিধান নেই। সেজন্যই হয়তো তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি।
অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু নোবেল পুরস্কার না পেলেও তার চেয়েও অনেক বড় কিছু অর্জন করেছেন। তিনি অমর হয়ে আছেন তাঁর কাজের মাধ্যমে। পদার্থবিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের সমস্ত কণাকে মূলত দুই ভাগে ভাগ করেছেন—ফার্মিওন এবং বোসন। ফার্মিওন কণাগুলোর নামকরণ করা হয়েছে ইতালিয়ান বিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নামে। ফার্মিওন কণাগুলো ফার্মি-ডিরাক স্ট্যাটিসটিকস মেনে চলে। অন্যদিকে বোসন কণাগুলোর নামকরণ হয়েছে বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম অনুসারে। বোসন হচ্ছে বল বহনকারী কণা। এই কণাগুলো বোস-আইনস্টাইন স্ট্যাটিসটিক্স মেনে চলে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, বোসন কণাগুলোর উদ্ভব হয়েছিল মহাবিশ্ব সৃষ্টির আদিলগ্নে। এরকম একটি বোসন কণার নাম হলো, হিগস বোসন, যাকে অনেকে বলেন, গড পার্টিকেল। এই বিশেষ বোসন কণাটি থেকেই সমস্ত বস্তুর ভরের উৎপত্তি হয়েছিলো বলে বর্তমান যুগের বিজ্ঞানীরা মনে করেন। বিজ্ঞানী সত্যেন বোসের অবদান নিয়ে ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট’ নামে বাংলায় একটি চমৎকার বই লিখেছেন জনপ্রিয় বিজ্ঞান লেখক আবদুল গাফফার। বইটি পড়লে এ বিষয়ে বিশদ জানতে পারবেন।
সূত্র: নিউ সায়েন্টিস্ট
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।