জুমবাংলা ডেস্ক : আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ব্যাংক একীভূতকরণের বিষয়টি নতুন নয়। প্রায় সব বড় অর্থনীতিতেই এর রেওয়াজ রয়েছে। এ ব্যবস্থায় ব্যাংক খাত সংস্কারের নামে একটি দুর্বল ব্যাংককে সবল বা ভালো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত বা মার্জার করা হয়। তবে দেশে দেশে এই ব্যাংক একীভূতকরণের নিয়মে নিলাম পদ্ধতি ও সরাসরি ক্রয়ের রেওয়াজ বেশি দেখা গেছে।
খুব বেশি আগের কথা নয়, গত বছরই এমন পরিস্থিতি দেখেছে গোটা বিশ্ব। ২০২৩ সালে বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রেই ঘটেছে এমন ঘটনা। সেখানে তিন মাসের মধ্যে পরপর তিনটি ব্যাংকের পতন হয়, যা অতীতে কখনো ঘটেনি। ওই বছরের মার্চে কয়েক দিনের ব্যবধানে বন্ধ হয়ে যায় সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিবি) ও সিগনেচার ব্যাংক, মে মাসে ফার্স্ট রিপাবলিক।
সিলিকন ভ্যালি ও ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংকের পতন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতের ইতিহাসে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বৃহৎ ব্যর্থতা। ঘটনাগুলো অবাক করে দিয়েছিল গোটা বিশ্বকে। এ তিনটি ব্যাংক বন্ধ হওয়ার মূল কারণ আমানত সংকট। দেশটির ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফেডারেল ডিপোজিট ইন্স্যুরেন্স করপোরেশনের (এফডিআইসি) তত্ত্বাবধানে ব্যাংকগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। এই ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা হলো ‘ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাংক রান’—তিরিশের দশকে মহামন্দার সময় এমনটি ঘটেছিল।
গ্রাহকরা এ সময় একসঙ্গে টাকা তুলতে উন্মাদ হয়ে যান। তখন মন্দ ব্যাংক তো বটেই, বিশ্বের সবচেয়ে ভালো ব্যাংকটিরও ধসে পড়ার মতো পরিস্থিতি হবে। ব্যাংকগুলো ছিল মধ্যম মানের। জেপি মর্গানের মতো শক্তিশালী ব্যাংকগুলোর বৈচিত্র্যপূর্ণ ছিল না এগুলোর গ্রাহক ভিত্তি। যেমন এসভিবি ব্যাংকের গ্রাহক ছিল মূলত স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো। সিগনেচার ব্যাংক ঋণ দিত মূলত আবাসন খাতে। সেইসঙ্গে তারা সম্প্রতি ক্রিপ্টোকারেন্সির গ্রাহকদের টানতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিল। কোনো দেশের নিয়ন্ত্রক সংস্থাই কোনো ব্যাংক একেবারে বন্ধ করে দিতে চায় না। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টাই করে কর্তৃপক্ষ। এই চেষ্টার অন্যতম উদ্যোগ একীভূতকরণ।
যুক্তরাষ্ট্রে গত বছর সিলিকন ভ্যালি ব্যাংকের অবস্থা পড়ে যাওয়ার পরপরই ক্রেতা খুঁজতে শুরু করে এফডিআইসি। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন আর্থিক শিল্প প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী ও বিনিয়োগকারীরা। তারা বলেছিলেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ সপ্তাহের মধ্যেই ব্যাংকটির ক্রেতা খুঁজে না পেলে বীমাবিহীন আমানত সুরক্ষা কঠিন হয়ে পড়বে। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে যুক্তরাষ্ট্রের আঞ্চলিক ব্যাংকগুলোয়। পরে মার্চের শেষ দিকে সিলিকন ভ্যালির সব আমানত ও ঋণ কিনে নেয় ফার্স্ট সিটিজেনস ব্যাংক শেয়ারস ইনকরপোরেটেড।
এর মধ্য দিয়ে সিলিকন ভ্যালির আমানতকারীরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফার্স্ট সিটিজেন্স ব্যাংকের আমানতকারী হয়ে যান। বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে সিলিকন ভ্যালির হাতে ১৬ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের সম্পদ ছিল। আর আমানত ছিল ১১ হাজার ৯০০ কোটি ডলার।
সিলিকন ভ্যালি বন্ধের প্রায় তিন দিনের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের সিগনেচার ব্যাংকের কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়। নিউইয়র্কের ব্যাংকটি বন্ধ ঘোষণা করে এর নিয়ন্ত্রণে নেয় এফডিআইসি। পরে বহু দরকষাকষির পর ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেয় নিউইয়র্ক কমিউনিটি ব্যানকরপের সাবসিডিয়ারি ফ্ল্যাগস্টার ব্যাংক। ২০২২ সাল শেষে সিগনেচার ব্যাংকের ছিল ১১০ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ। আমানত ছিল ৮৮ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার।
গত বছরের মে মাসে সংকট শুরু হয় ফার্স্ট রিপাবলিক ব্যাংক। সিলিকন ভ্যালি ও সিগনেচার ব্যাংক বন্ধ থেকে শিক্ষা নিয়ে বিপদ এড়াতে পুঁজি সংগ্রহের চেষ্টা করেও সফল হয়নি ব্যাংকটি। পরে এফডিআইসির তত্ত্বাবধানে নিলামে তোলা হয় ফার্স্ট রিপাবলিককে। নিলামে অংশ নেয় সিটিজেন্স ফিন্যান্সিয়াল গ্রুপ, পিএনসি ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস গ্রুপ, জেপি মরগান চেজ, ইউএস ব্যাংকিং করপোরেশনসহ ছয় প্রতিষ্ঠান। নিলাম প্রক্রিয়ায় এফডিআইসির পরামর্শক হিসেবে ছিল গুগেনহেম সিকিউরিটিজ। শেষ পর্যন্ত নিলামে জয়ী হয় যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যাংক জেপি মরগান চেজ অ্যান্ড কোম্পানি। ফার্স্ট রিপাবলিকের সব আমানত এবং বেশিরভাগ সম্পদ ১ হাজার ৬০ কোটি ডলারে কিনে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানটি।
১৯৮৫ সালে জেমস জিম হার্বাট নামে এক ব্যক্তি ফার্স্ট রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৭ সালে ব্যাংকটি অধিগ্রহণ করে মেরিল লিঞ্চ। কিন্তু ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পর মেরিল লিঞ্চের নতুন মালিক ব্যাংক অব আমেরিকা বিক্রি করে দেয় ফার্স্ট রিপাবলিককে। ২০১০ সালে স্টক মার্কেটে নতুন করে তালিকাভুক্ত হয় প্রতিষ্ঠানটি। বছরের পর বছর গ্রাহকদের বন্ধকী এবং ঋণে অগ্রাধিকারমূলক সুদহার দিচ্ছিল ফার্স্ট রিপাবলিক। এই কৌশল আরও অস্থিতিশীল করে দিয়েছে ব্যাংকটিকে।
এ ছাড়া ব্যাংকটির বেশিরভাগ আমানতই ছিল বীমাহীন। ফলে বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি তখন থেকেই বেড়ে গিয়েছিল ফার্স্ট রিপাবলিকের। ২০০৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ব্যাংক খাতে সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার ঘটনাটি ঘটে। তখন চলছিল অর্থনৈতিক মন্দা। যুক্তরাষ্ট্রের সেই সময়ের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংক ওয়াশিংটন মিউচুয়াল নিতে পারেনি মন্দার ধকল। বন্ধ করে দিতে হয় ব্যাংকটি। বন্ধ হওয়ার সময় ওয়াশিংটন মিউচুয়ালের ছিল ৩০৭ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ। এই ব্যাংকটির কার্যক্রমও জেপি মরগান অ্যান্ড চেজের কাছে ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দেয় এফডিআইসি। সেই থেকে জেপি মরগানের অংশ ওয়াশিংটন মিউচুয়াল।
গত বছর ইউরোপের ব্যাংক খাতও শঙ্কামুক্ত ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংক খাতের টালমাটাল সময়ের মধ্যেই সংকটে পড়ে বিক্রি হয়ে যায় সুইজারল্যান্ডের বৃহৎ ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট সুইস। এ ঘটনাও মার্চের। ১৬৭ বছর বয়সী ক্রেডিট সুইসকে টিকিয়ে রাখতে সিদ্ধান্ত নিতে হবে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে। ক্রেডিট সুইসের রক্ষাকর্তা হয়ে এগিয়ে আসে ইউবিএস এজি। ৩২৩ কোটি ডলারে ক্রেডিট সুইস কিনে নেয় সুইজারল্যান্ডের সবচেয়ে বড় ব্যাংকটি। এর মধ্য দিয়ে নতুন যুগে প্রবেশ করে সুইজারল্যান্ডের ব্যাংক খাত।
এর আগে তারল্য বাড়াতে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ঋণ নেয় ক্রেডিট সুইস। সে সময়ই ইউবিএস এজির সঙ্গে ব্যাংকটিকে একীভূত হওয়ার পরামর্শ দেয় সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ধারাবাহিকতায় ক্রেডিট সুইসকে কেনার প্রস্তাব দেয় ইউবিএস। আলোচনা শুরুর পর প্রথমে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারে ক্রেডিট সুইসকে কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এই নামমাত্র দামে বিকোতে রাজি হয়নি ক্রেডিট সুইস। এরপর দীর্ঘ দরদস্তুরের পর ৩২৩ কোটি ডলারে হয় ফয়সালা। ৫ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের ঋণের দায়ও নেয় ইউবিএস। বিশ্ব অর্থনীতিতে ক্রেডিট সুইস ও ইউবিএসের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সুইস কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশটির মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১৪০ শতাংশ সম্পদ ধারণ করত এই দুই ব্যাংক। এই হিসেবে ব্যাংক দুটি ছিল একে অন্যের প্রতিদ্বন্দ্বী। এখন ইউবিএসে জুড়ে আছে ক্রেডিট সুইসের অস্তিত্ব।
ক্রেডিট সুইসের পতনের পর মার্চের শেষ দিকে জার্মান ঋণদাতা ডয়চে ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার গুঞ্জন ওঠে। শুরুটা হয় আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজারে প্রতিষ্ঠানটির উল্লেখযোগ্য দরপতন দিয়ে। ২০২৩ সালের ২৪ মার্চ ইউরোপের পুঁজিবাজারে ব্যাংকের শেয়ারে ব্যাপক দরপতন দেখা যায়। এর মধ্যে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্টক এক্সচেঞ্জে ডয়চে ব্যাংকের শেয়ারদর কমে ১৪ শতাংশেরও বেশি। আরেক জার্মান ব্যাংক কমার্স ব্যাংকের শেয়ারের দরপতন হয় সাড়ে ৭ শতাংশ। ফ্রান্সের সোসিয়েতে জেনারেলের শেয়ারের দাম কমে ৫ দশমিক ৯ ও অস্ট্রিয়ার রেইফাইসেনের ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। এতে বিনিয়োগকারীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। এদিন লেনদেন শেষে ইউরোপিয়ান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্দে বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করতে বলেন, ইউরোপের ব্যাংকগুলো নিরাপদ আছে এবং তারল্য সংকট নেই।
ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলাও হয়েছিল, ডয়চের সঙ্গে ক্রেডিট সুইসের পার্থক্য অনেক। ক্রেডিট সুইস অলাভজনক। সেই সঙ্গে ব্যাংকটিতে ছিল নানা আইনি জটিলতা। আর এর প্রায় সব আমানত ছিল বীমাহীন। অর্থাৎ, পুরো পরিস্থিতিই ছিল প্রতিকূল। অন্যদিকে অনেক তিক্ততার মধ্য দিয়ে পুনর্গঠনের পর, ডয়চে ব্যাংক এখন লাভজনক। এর খুচরা আমানতের প্রায় ৭০ শতাংশ বীমার আওতায়। নগদ রাখার ব্যাপারেও তারা সতর্ক। ২০১৬ সালের বিপর্যয়ের মুখে আমানতের অবস্থা খারাপ ছিল। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটির এখন যথেষ্ট তরল সম্পদ রয়েছে, যা ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে নগদ বিনিময় করতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।