মোঃ নাজমুল হক বিপ্লব : সম্ভাবনাময় এই ছোট্ট দেশে ৬টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৪৪টি ব্যাক্তি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক, ৩টি বিশেষায়িত ব্যাংক, ১টি ডিজিটাল ব্যাংক এবং ৯টি বিদেশি ব্যাংকসহ মোট ৬২টি তফসিলভূক্ত ব্যাংক তাদের শাখা উপ-শাখার মাধ্যমে বাংলাদেশের নাগরিকদের ব্যাংকিং সেবা প্রদান করে আসছেন। অ-তফসিলভূক্ত আরও পাঁচটি ব্যাংক রয়েছে।
১৮ কোটি মানুষের এই দেশে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার চেষ্টা করা এই ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই। আমাদের আভ্যন্তরীণ এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দুও এসব ব্যাংক।
অর্থনীতির চালিকাশক্তি এসব ব্যাংকের মালিকানা এবং অনুমোদন প্রক্রিয়াগুলো ছিল অনেকটাই পারিবারিক ও নিজস্ব দল কেন্দ্রিক। পারিবারিক ও দলীয় প্রভাব প্রতিপত্তির কারণে ব্যাংকগুলোতে একই পরিবারের পরিচালক নিয়োগ ও মেয়াদের ক্ষেত্রে ব্যাংকিং নিয়মকানুন তেমন একটা মানা হয়নি। শুধু তাই নয়, ব্যাংকিং সেক্টরের নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ এসব প্রতিষ্ঠানে তাদের পছন্দমত কর্মকর্তা কর্মচারী বসয়েছিল হয়েছিল, যার ফলে নির্দিষ্ট ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের বাইরে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ সুবিধা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল।
ব্যবসায়ী-শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ নিতে হলে নির্দিষ্ট ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের কমিশনের বিনিময়ে রেফারেন্সের মাধ্যমেই আসতে হতো, তা-না হলে ব্যাংকিংয়ের স্বাভাবিক সুযোগ-সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত হতেন। আর এভাবে তারা ব্যাংকগুলোতে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান সীমাহীন দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ভুয়া কাগজপত্র দেখিয়ে ঋণ, নামে বেনামে ঋণ সুবিধা, ব্যাংক মর্টগেজের ওভার ভ্যালু, ভুয়া প্রতিষ্ঠানের নামে শুধু কাগুজে ঋণ , এমন কোন অনিয়মের পন্থা নেই যা তারা অবলম্বন করেননি। এভাবে পরিকল্পনা করে একেকজন, একেকটি ব্যাংক শিকারে পরিণত করেছিলেন। লুটপাট করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়াটাকে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে পরিণত করেছিলেন যেন দেখার মত কেউ ছিল না।
শুধু এস আলম গ্রুপেরই মোট ঋণ ছিল প্রায় দুই লাখ কোটি টাকার মতো। এর মধ্যে ১ লাখ নয় হাজার কোটি টাকা দেশের বাহিরে পাচারের অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও জনতা ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জনতা ব্যাংকের লোকাল অফিস থেকে বেক্সিমকো গ্রুপ ও গ্রুপ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ঋণ রয়েছে প্রায় ২৬ হাজার ৯৫৪ কোটি টাকার মতো। এছাড়া সুকুক বন্ডের মাধ্যমেও নিয়েছেন ২২০ কোটি টাকা। রাষ্ট্রায়াত্ত্ব রূপালী ব্যাংক থেকেও নিয়েছিলেন ৯৬৫ কোটি টাকা।
এরকম আরো নাম না জানা অনেক মাফিয়া ডন ছিলেন ব্যাংকিং সেক্টরে। তারাও ব্যাংকিং সেক্টর থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট করেন অনায়াসে, যা ইতিহাসে বিরল। দুর্নীতিতে তারা একজন আরেকজনের উপর শ্রেষ্ঠত্বের মহাযুদ্ধে নেমেছিলেন। প্রতিষ্ঠানের নীট-মূলধনকে শুধু কাগজে-কলমে বাড়িয়ে শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ধোকা দিয়ে বোকা বানিয়ে টাকা লুট করেছেন তারা।
প্রতিটি কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল (আল-হাদীস)। কোনও ব্যক্তি যে নিয়তে কাজ শুরু করবে আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে সে দিকেই সাহায্য করেন। একের পর এক পরিকল্পনামাফিক এই বিশাল সিন্ডিকেটের মাধ্যমে একেকটা ব্যাংককে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ব্যাংকগুলোতে চরম তারল্য সংকট সমাধানে টাকা ছাপিয়ে ব্যাংকগুলোর দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর ব্যাবস্থা করা হয়েছিল, যা ছিল আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। মুদ্রাস্ফীতির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম হু হু করে বাড়তে থাকে। টাকা ছাপানোর মতো ভুল পদক্ষেপের কারণে বাজারে অর্থ সরবরাহ থাকায় মুদ্রাস্ফীতি জনিত মূল্যস্ফীতি ব্যাপক আকার ধারণ করে।
দেশে যখন জনগণের নাভিশ্বাস অবস্থা তখন বৈদেশিক রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ল। ডলার সংকটের অজুহাতে এলসি খোলা প্রায় বন্ধই হয়ে গিয়েছিল। সিন্ডিকেট ও অসাধু ব্যবসায়ীরা এর সুবিধা নেওয়া শুরু করল। অনেক প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা তারা দেশে নিয়ে আসেননি, বিদেশেই ইনভেস্ট করেছেন। এমনকি ওভার ইনভয়েসিং করেও তারা ডলার দেশের বাহিরে পাচার করে সংকট মুহূর্তে তারা দেশকে আরও বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছেন।
আমরা চাই, যেহেতু একটি সুযোগ তৈরি হয়েছে সেহেতু দেশের চালিকাশক্তি ব্যাংকগুলোতে এমন সংস্কার করতে হবে যাতে কোন অবস্থাতেই সিন্ডিকেট, লুটপাট, অনিয়ম -দুর্নীতি ব্যাংকিং সেক্টরে আর ফিরে না আসে। অর্থখাত সংক্রান্ত আইনকানুন পরিবর্তন, পরিমার্জন করতে হবে। ব্যাংকিং কমিশন গঠন করে ব্যাংকগুলোকে রাজনীতির বাইরে রেখে নিজস্ব গতিতে চলতে দিতে হবে। দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তির যারা মূল কারিগর তাদেরকে কাজের পরিবেশ দিতে হবে। সঠিক সময়ে প্রমোশন, বিদ্যমান সুযোগ সুবিধাসমূহের দিকে সুদৃষ্টি দিতে হবে। এসব বিষয়ে মাননীয় অর্থ উপদেষ্টাসহ অর্থ মন্ত্রণালয় (ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ), বাংলাদেশ ব্যাংক, বিএফআইউসহ সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
পরিশেষে এটুুকু বলতে পারি, ব্যাংকাররা ভালো থাকলে, ভালো থাকবে ব্যাংক আর ব্যাংক ভালো থাকলে, ভালো থাকবে দেশের অর্থনীতি এবং সর্বোপরি ভালো থাকবে দেশের জনগণ।
লেখক : সরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা
*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।