আসিফ হাসান কাজল : গত ১৫ বছরে বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা তিনগুণ বেড়েছে। তবে দেশের শ্রমিক বিদেশ গিয়ে অর্থনীতিতে যে অবদান রাখছে, উচ্চ শিক্ষিত মেধাবীরা তা রাখতে পারছেন না। উল্টা শিক্ষার্থীদের বিদেশে পড়াতে বছরে হাজার কোটি টাকা দেশ থেকে পাঠানো হচ্ছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমরা দেশে সেভাবে ভালো ছাত্র তৈরি করতে পারছি না। মেধাবী, প্রভাবশালী ও ধনীদের সন্তান পড়াশোনা করতে বিদেশ গেলেও ফেরত আসছে না অর্থ। বিদেশের মাটিতে তাদের মেধা ও সঞ্চিত জ্ঞান দেশেরও কোনো কাজে আসছে না। প্রতিবেশী দেশ ভারতের মতো আন্ডারগ্র্যাজুয়েট পড়ার পর শিক্ষার্থীরা বিদেশে গেলে কোনো সমস্যা হতো না। অর্থনীতিতেও নেতিবাচক প্রভাব কমে পড়ত। কিন্তু শিক্ষাবিদরা বলছেন, বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে শিক্ষার্থীদের নিরুৎসাহিত করা এখনই ঠিক হবে না।
সম্প্রতি ডলার সংকটের অজুহাতে গত এক বছরের বেশি সময় ব্যাংকগুলোতে স্টুডেন্ট ফাইল খোলা বন্ধ রয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সরাসরি কোনো নির্দেশনা না থাকলেও ব্যাংকগুলো ডলার সংকটের কথা বলছে। কিন্তু থেমে নেই বিদেশে শিক্ষার্থীদের গমন। ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর সুযোগ না থাকায় অভিভাবকরা হুন্ডির মাধ্যমে দেশের বাইরে টাকা পাঠাচ্ছে। ফলে উচ্চশিক্ষার জন্য বড় অঙ্কের অর্থ অবৈধ পথে বিদেশে যাচ্ছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতেও।
কিছুদিন আগেই সিহাব রহমান (ছদ্মনাম) যুক্তরাজ্যের একটি বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন করেন। ভর্তি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সেমিস্টার ফি বাবদ টিউশন ফি জমা দেন। কিন্তু সেই অর্থ বিশ্ববিদ্যালয় ফিরিয়ে দিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছে, সে যে ফান্ড ট্রান্সফার করেছে তা অবৈধ। যে কারণে অর্থ যার অ্যাকাউন্ট থেকে পাঠানো হয়েছিল, তা ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে শিক্ষার্থীর ভর্তি নিয়েও তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। সিহাব রহমান জানান, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থ পাঠাতে হয় নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে অথবা বাবা-মার অ্যাকাউন্ট থেকে। কিন্তু দেশ থেকে অর্থ পাঠানো যাচ্ছে না। যে কারণে হুন্ডির মাধ্যমে ওই দেশের এক ব্যক্তির মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয়েছে। এরপর টাকা তার অ্যাকাউন্টে ফেরত গেলেও আমরা সেই টাকা এখনো ফিরে পায়নি। অভিভাবকরা বলছেন, হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠাতে গিয়ে অনেক সময় ভোগান্তি ও হয়রানি পোহাতে হচ্ছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, দেশে বেশকিছু আন্তর্জাতিক ব্যাংক রয়েছে। সেসব ব্যাংকের মাধ্যমে স্টুডেন্ট ফাইল খোলা হলে ভালো হবে। ব্যাংকের মাধ্যমে একটি চ্যানেলও খোলা যেতে পারে। সব ব্যাংকে স্টুডেন্ট ফাইল খোলার কার্যক্রম বন্ধ থাকায় সমালোচনা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি জানান, শিক্ষার্থীদের ফাইল আটকে রাখা ঠিক নয়। সব মিলিয়ে টাকার যে লেনদেন হয়, তা দুই-তিনটি এলসির সমপরিমাণ হবে। কিন্তু ফাইল আটকে রাখার কারণে ডলার ঘাটতি আছে- এমন বার্তা ঘরে ঘরে দেওয়া হচ্ছে। বিদেশের শিক্ষার্থী বা যারা ইউরোপ-আমেরিকায় পাড়ি জমাচ্ছে, তাদের অবদান সম্পর্কে তিনি বলেন, আজ হয়তো তারা বিশেষ অবদান রাখতে পারছে না, কিন্তু ভবিষ্যতে যে রাখবে না সেটি বলা কঠিন। দেশে ফিরে উপযুক্ত কর্মপরিবেশ সৃষ্টির বিষয়েও তিনি জোর দিয়েছেন।
জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কোর তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন মোট ৫২ হাজার ৭৯৯ শিক্ষার্থী। যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াও উচ্চশিক্ষার পছন্দের দেশের তালিকায় রয়েছে যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া এবং জার্মানির মতো দেশ। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যে ৬ হাজার ৫৮৬, কানাডায় ৫ হাজার ৮৩৫, মালয়েশিয়ায় ৫ হাজার ৭১৪ এবং জার্মানিতে ৫ হাজার ৪৬ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ ছেড়েছেন। এ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে অস্ট্রেলিয়ায় ৪ হাজার ৯৮৭, জাপানে ২ হাজার ৮২, প্রতিবেশী দেশ ভারতে ২ হাজার ৬০৬, কোরিয়া প্রজাতন্ত্রে ১ হাজার ২০২ এবং ১ হাজার ১৯০ জন শিক্ষার্থী সৌদি আরবে উচ্চশিক্ষার জন্য গেছেন। এর আগে বিগত ২০২২ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য বাংলাদেশ ছাড়েন ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী, যা তার আগের বছর অর্থাৎ ২০২১ সালে ছিল ৪৪ হাজার ৩৩৮ জন। ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে ৪৯ হাজার ১৫১ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গেছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চসংখ্যক শিক্ষার্থী গেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। যদিও ২০১৩ সালে বিদেশে পড়তে যাওয়ার সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ১১২ জন এবং ২০০৮ সালে ১৬ হাজার ৬০৯ জন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, ২০২১-২০২২ অর্থবছরে উচ্চশিক্ষায় বিদেশে যাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য দেশ থেকে ২১ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাঠানো হয়েছিল। প্রেসিডেন্সি বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ মাহবুব আলী বলেন, একটি বৈশ্বিক মন্দা চলছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এর মধ্যেও দেশের বাইরে শিক্ষার্থীদের যাওয়ার প্রবণতা কমছে না। সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিডপরবর্তী সময়ে ইউরোপ-আমেরিকায় যেসব শিক্ষার্থী পড়তে গেছে, তাদের ৬০ ভাগ ড্রপআউট হয়ে গেছে। অর্থাৎ অর্থনৈতিক সারভাইভের কারণে তারা পড়াশোনা চালাতে পারছে না। কোভিডের আগে এই হার ছিল মাত্র ১০-২০ শতাংশ। তিনি দাবি করেন, আমাদের দেশে একটি নিয়ম হওয়া দরকার। উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে যারা বিদেশ যাচ্ছে, তাদেরকে অন্তত মোট আয়ের ১০ শতাংশ দেশে পাঠাতে হবে। তা না হলে তার পাসপোর্ট নবায়নের সময় কর্তৃপক্ষ চাইলে এ বিষয়টি আটকাতে পারবে। সংসদে এ বিষয়ে বিল উত্থাপন ও পাস হলে জাতি উপকৃত হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, যারা বিদেশে পড়তে যাচ্ছে তাদেরকে উৎসাহ দিতে হবে। আজ তাদের অবদান কম হলেও আগামীতে যে বাড়বে না তা সঠিক নয়। পাশর্^বর্তী দেশ ভারতে প্রতি বছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী পড়তে যাচ্ছে, যাদের বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ওই সব দেশেই থেকে যায়। অনেকে আবার ফিরেও আসে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, তারা প্রচুর পরিমাণে রেমিটেন্স পাঠাচ্ছে দেশে। ফিরে আসার জন্য মেধাবী শিক্ষার্থীদের কাজের সুযোগ বৃদ্ধি, কর্মপরিবেশ ও আর্থিক নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। এটি নিশ্চিত না করতে পারলে শিক্ষার্থীরা হতাশ হবে ও ফিরে না আসার আশঙ্কা বাড়বে।
এই শিক্ষাবিদ বলেন, আমাদের যেসব শিক্ষার্থী দেশের বাইরে যাচ্ছে, বিশ্বপরিমন্ডলে তারা দেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। আধুনিক ল্যাবে তারা গবেষণা করছে। উচ্চশিক্ষায় পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদেরও তারা সুযোগ করে দিচ্ছে।
এদিকে উচ্চ শিক্ষায় বিদেশে যাওয়ার প্রবণতার কারণে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনার্স পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তি কমছে। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বেশি টিউশন ফির কারণে অনেকে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছে। স্নাতক পাস করার পরও বেকার থাকার চিন্তা অভিভাবকদের মধ্যে দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে। এছাড়া একাডেমি-ইন্ডাস্ট্রির মধ্যে যোগসূত্রের অভাব নিরসনে এখনো কোনো উদ্যোগ নেই। বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির হার ২০২১ সালের ২০ দশমিক ১৯ শতাংশ থেকে কমে ১৮ দশমিক ৬৬ শতাংশে নেমে এসেছে।
লেবার ফোর্স জরিপ-২০২২ অনুসারে, পাঁচ বছরে স্নাতক পাস করার পরও বেকারত্ব দ্বিগুণ হয়েছে। ২০১৬-১৭ সালের জরিপে মোট ৩ লাখ ৯০ হাজার গ্র্যাজুয়েট বেকার পাওয়া গেছে। জরিপের সর্বশেষ সংস্করণে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৯৯ হাজারে। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের শিক্ষিতদের মধ্যে বেকারত্বের হার ২০১৬-১৭ সালের ১১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ১২ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
ইউজিসির সাবেক চেয়ারম্যান এম এ মান্নান বলেন, করোনার কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক দুরবস্থা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী গৃহশিক্ষকের কাজ করে তাদের পড়াশোনার খরচ মেটাতেন। কিন্তু মহামারির সময় তারা সেই আয়ের উৎস হারান এবং পরবর্তীতে তারা ঝরে পড়েছেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।