আন্তর্জাতিক ডেস্ক: সত্তর বছর রাজত্ব করার পর ব্রিটেনের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী রাজশাসক রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথ ব্যালমোরাল প্রাসাদে মারা গেছেন। তার বয়স হয়েছিল ৯৬ বছর।
বৃহস্পতিবার তার স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ বেড়ে যাওয়ার পটভূমিতে রানি এলিজাবেথের পরিবার স্কটল্যান্ডের ঐ প্রাসাদে জড়ো হয়েছিলেন।
রানী এলিজাবেথ ১৯৫২ সালে সিংহাসনে আসীন হন এবং তার জীবদ্দশায় বিশাল সামাজিক পরিবর্তনের সাক্ষী হয়ে ছিলেন।
রাজা তৃতীয় চার্লস
বাকিংহাম প্যালেস জানিয়েছে, রানীর মৃত্যুতে যুবরাজ চার্লস এখন ব্রিটেনের রাজা। তিনি রাজা তৃতীয় চার্লস হিসেবে পরিচিত হবেন৷ আর তার স্ত্রী ক্যামিলা কুইন কনসোর্ট হিসেবে পরিচিত হবেন৷ ডিউক অব ক্যামব্রিজ প্রিন্স উইলিয়াম এখন যুবরাজ, যিনি সিংহাসনের উত্তরাধিকারী৷ শুক্রবার সকালে তারা লন্ডনে ফিরবেন বলে জানানো হয়েছে।
এক বিবৃতিতে, রাজা বলেন: “একজন প্রিয় রানী এবং প্রিয়তম মায়ের মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমি জানি সারা দেশ, রাজ্য ও কমনওয়েলথ, এবং সারা বিশ্বের অগণিত মানুষ তার মৃত্যুকে গভীরভাবে অনুভব করবেন।”
তিনি বলেন, প্রয়াত রানীর প্রতি “যে সম্মান এবং গভীর স্নেহ রয়েছে” এই শোক ও পরিবর্তনের সময়কালে সেটা তাকে ও তার পরিবারকে সান্ত্বনা দেবে এবং শক্তি জোগাবে।
শান্তিপূর্ণভাবে প্রাণত্যাগ
এর আগে রানীর প্রাসাদ বাকিংহাম প্যালেস থেকে এক বিবৃতিতে জানানো হয়, “রানি ব্যালমোরাল প্রাসাদে আজ (বৃহস্পতিবার) বিকেলে শান্তিপূর্ণভাবে প্রাণত্যাগ করেছেন।
“রাজা এবং রাজপত্নী আজ সন্ধ্যায় ব্যালমোরালে থাকবেন এবং আগামীকাল তারা লন্ডনে ফিরে যাবেন।”
ডাক্তাররা রাণীর চিকিৎসা তত্ত্বাবধান শুরু করার পর রানী এলিজাবেথের সব সন্তান অ্যাবারডিন শহরের কাছে ব্যালমোরাল প্রাসাদে জড়ো হন।
তার নাতি প্রিন্স উইলিয়াম সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ছোট নাতি প্রিন্স হ্যারিও পরে সেখানে হাজির হন।
রাজার প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আনুগত্য
প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাস মাত্র মঙ্গলবারই রানীর আমন্ত্রণে ব্রিটেনের নতুন সরকার প্রধানের দায়িত্বে নিযুক্ত হয়েছেন। তিনি বলছেন, প্রয়াত রানী হলেন সেই ভিত্তি যার ওপর আধুনিক ব্রিটেনের কাঠামো নির্মিত হয়েছে এবং “আমাদের যে স্থিতিশীলতা ও শক্তির প্রয়োজন ছিল তিনি সরবরাহ করেছিলেন।”
ব্রিটেনের নতুন রাজা সম্পর্কে তিনি বলেন, “তার মা যেমন দীর্ঘদিন ধরে অগণিত মানুষের কল্যাণে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন, আমরাও তার (রাজার) প্রতি আমাদের আনুগত্য এবং ভক্তি নিবেদন করছি।
“এবং দ্বিতীয় এলিজাবেথ যুগের অবসানের সাথে সাথে, ‘ঈশ্বর রাজাকে রক্ষা করুন’ কথাটি বলে আমরা আমাদের মহান দেশের মহিমান্বিত ইতিহাসে আরও একটি নতুন যুগের সূচনা করছি, ঠিক যেমনটি প্রয়াত রানি কামনা করেছিলেন।”
১৫ জন প্রধানমন্ত্রী
রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মেয়াদকালে মহাযুদ্ধ-পরবর্তী কৃচ্ছতা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে কমনওয়েলথে উত্তরণ, স্নায়ুযুদ্ধের পরিসমাপ্তি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্রিটেনের যোগদান ও পরে প্রত্যাহারের ঘটনা ঘটেছে।
তার জীবদ্দশায় ১৮৭৪ সালে জন্মগ্রহণকারী উইনস্টন চার্চিল থেকে শুরু করে, তার ১০১ বছর পর, ১৯৭৫ সালে জন্মগ্রহণকারী মিস ট্রাসসহ ১৫ জন প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করেছেন।
পুরো শাসনামলে তিনি নিয়মিতভাবে প্রতি সপ্তাহে তার প্রধানমন্ত্রীদের সাক্ষাৎ দিতেন।
রানীর স্বাস্থ্যের সর্বশেষ খবর জানার জন্য লন্ডনে বাকিংহাম প্যালেসের বাইরে বিশাল জনতা অপেক্ষা করছিলেন এবং তার মৃত্যু সংবাদ শুনে অনেকেই কাঁদতে শুরু করেন। প্রাসাদের মাথায় ইউনিয়ন জ্যাক পতাকাটি স্থানীয় সময় সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টায় অর্ধনমিত করা হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে রানির মৃত্যুর ঘোষণা করে একটি সরকারি নোটিশ প্রাসাদের বাইরে স্থাপন করা হয়।
রানী এলিজাবেথের পুরো নাম আলেকজান্দ্রা মেরি উইন্ডসর। ১৯২৬ সালের ২১শে এপ্রিল লন্ডনের মেফেয়ার এলাকার বাড়িতে তিনি জন্মগ্রহণ করেন।
তিনি যে একসময় রানী হবেন একথা খুব কম লোকই তখন ধারণা করতে পেরেছিলেন। কিন্তু ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে তার চাচা অষ্টম এডওয়ার্ড দু’বার তালাকপ্রাপ্ত এক আমেরিকান নারী ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ে করার জন্য সিংহাসন ত্যাগ করেন।
লিলিবেট থেকে এলিজাবেথ
তখন রাজকুমারী এলিজাবেথের বাবা ষষ্ঠ জর্জ ব্রিটেনের রাজা হন এবং ১০-বছর বয়সী ‘লিলিবেট’, যে নামে তাকে পরিবারের মধ্যে ডাকা হতো, তিনি হন ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী।
এর তিন বছরের মধ্যে ব্রিটেন নাৎসি জার্মানির সাথে যুদ্ধে জাড়িয়ে পড়ে। যুবরাজ্ঞী এলিজাবেথ এবং তার ছোট বোন প্রিন্সেস মার্গারেটকে ক্যানাডায় সরিয়ে নেয়ার প্রস্তাব করা হলেও তাদের বাবা-মা সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। দুই বোন ঐ মহাযুদ্ধের বেশিরভাগ সময়টাতে বসবাস করেন ইংল্যান্ডের বার্কশায়ার কাউন্টির উইন্ডসর প্রাসাদে।
বয়স ১৮ পেরোনোর পর যুবরাজ্ঞী এলিজাবেথ পাঁচ মাসের মতো সময় অক্সিলিয়ারি টেরিটোরিয়াল সার্ভিসে কাজ করেন এবং মোটর মেকানিক হিসেবে বুনিয়াদী জ্ঞান ও ড্রাইভিং-এর দক্ষতা অর্জন করেন।
“আমি জোটের সংঘবদ্ধ শক্তির বিষয়টি বুঝতে শুরু করি, প্রতিকূলতার মুখেও যে শক্তি বাড়তে থাকে,” সেই স্মৃতির কথা স্মরণ করে পরে তিনি বলেছিলেন।
রাজপুত্র ফিলিপের সাথে প্রেম
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যখন চলছে সেই সময়টাতে তিনি তার দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় গ্রিসের রাজপুত্র ফিলিপের সাথে চিঠি আদান-প্রদান শুরু করেন। ফিলিপ তখন ব্রিটেনের রাজকীয় নৌবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।
তাদের মধ্যে রোমান্স বাড়তে থাকে এবং ১৯৪৭ সালের ২০শে নভেম্বর ওয়েস্টমনিস্টার অ্যাবি গির্জায় তারা বিয়ে করেন। এই বিয়ের সুবাদে প্রিন্স ফিলিপ ডিউক অফ এডিনবরা উপাধি লাভ করেন।
দু’হাজার একুশ সালে ৯৯-বছর বয়সী প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যু পর্যন্ত ৭৪-বছরের বিবাহিত জীবনে রানি এলিজাবেথ তাকে “আমার শক্তি এবং নির্ভরতা” হিসাবে বর্ণনা করেন।
হঠাৎ করে ব্রিটেনের রানি
রাজকীয় দম্পতির প্রথম পুত্র চার্লসের জন্ম হয় ১৯৪৮ সালে, এরপর প্রিন্সেস অ্যান ১৯৫০ সালে, প্রিন্স অ্যান্ড্রু ১৯৬০ সালে এবং প্রিন্স এডওয়ার্ড ১৯৬৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। এই সন্তানেরা তাদের বাবা-মাকে মোট আট জন নাতি-নাতনি এবং ১২ জন পুতি-পুতনি উপহার দিয়েছেন।
উনিশশো বাহান্ন সালে যুবরাজ্ঞী এলিজাবেথ যখন কেনিয়া সফর করছিলেন তখন প্রিন্স ফিলিপ তাকে তার বাবার মৃত্যুর খবর দেন। ব্রিটেনের নতুন রানী হিসাবে তিনি দ্রুত লন্ডনে ফিরে আসেন।
“এটি ছিল হঠাৎ করেই দায়িত্বভার হাতে তুলে নিয়ে সাধ্যমতো সেরা কাজটি করার মতো ঘটনা,” পরে তিনি বলেছিলেন।
অভিষেক টেলিভিশনে সম্প্রচার
সাতাশ বছর বয়সে ১৯৫৩ সালের ২রা জুন রাজকুমারী এলিজাবেথকে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবি গির্জায় ব্রিটেনের রানীর মুকুট পরানো হয়েছিল। দু্ই কোটিরও বেশি টিভি দর্শক এই অনুষ্ঠান দেখেছিলেন, যা ছিল সে সময়ের একটি রেকর্ড।
এর পরের দশকগুলিতে দেখা গিয়েছিল বিশাল সব পরিবর্তন – বিদেশে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অবসান এবং ‘সুইংগিং সিক্সটি’ নামে পরিচিত ‘৬০-এর দশক, যে সময়ে ব্রিটেনের পুরনো সব সামাজিক নিয়ম-কানুন ভেসে গিয়েছিল।
এমন এক সময় যখন রাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধায় ক্ষয় ধরেছিল, সেই সময়টিতে রানি এলিজাবেথ মনোনিবেশ করেন রাজতন্ত্রের সংস্কারে, সাধারণ মানুষের সাথে মেলামেশায়, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত হয়ে এবং নানা ধরনের রাজকীয় পরিদর্শনে। কমনওয়েলথের প্রতি তার ছিল অবিচল অনুরাগ। অন্তত একবারের জন্য হলেও তিনি প্রত্যেকটি কমনওয়েলথ রাষ্ট্র পরিদর্শন করেছিলেন।
ভয়ঙ্কর বছর ১৯৯২
কিন্তু প্রকাশ্য এবং ব্যক্তিগতভাবে তার জন্য অনেক বেদনার দিনও ছিল। ১৯৯২ সাল, যাকে তিনি বলেছিলেন ‘অ্যানাস হরিবিলিস’ (ভয়ঙ্কর বছর), সে সময় অগ্নিকাণ্ড ঘটে উইন্ডসর প্রাসাদে। এটি ছিল একই সঙ্গে তার অফিস ও ব্যক্তিগত বাসস্থান। ঐ সময়টাতে তার তিন সন্তানের বিয়ে ভেঙ্গে যায়।
উনিশশো সাতানব্বই সালে প্যারিসে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় ওয়েলসের রাজকুমারী প্রিন্সেস ডায়ানার মৃত্যুর পর জনসাধারণের মধ্যে রানির কঠোর সমালোচনা হয়। অভিযোগ ছিল, ঐ মৃত্যুতে তিনি যথোপযুক্ত শোক-পালনে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
মানুষের সেবায় জীবন উৎসর্গ
আধুনিক ব্রিটিশ সমাজে রাজতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছিল।
“যারা কোন প্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্য দেখায় এবং সমর্থন জানায়, তাদের সমালোচনা থেকে সেই প্রতিষ্ঠানের রেহাই পাওয়ার আশা করা উচিত নয় … আর যারা সেটা করেন না তাদের কথা না হয় বাদই দেয়া হলো,” পরে তিনি স্বীকার করেছিলেন।
একুশ-বছর বয়সী একজন রাজকুমারী হিসাবে এলিজাবেথ তার জীবনকে মানুষের সেবায় উৎসর্গ করার শপথ নিয়েছিলেন।
এর কয়েক দশক পর, ১৯৭৭ সালে তার সিংহাসনে আরোহণের রজত জয়ন্তীর সময় সেই শপথের কথা মনে করে তিনি বলেছিলেন, “যদিও সেই শপথ করা হয়েছিল আমার তরুণ দিনগুলিতে, অভিজ্ঞতার দিক থেকে যখন আমি ছিলাম অপরিপক্ব, তবুও সেই শপথের একটি শব্দ নিয়েও আমার কোন অনুশোচনা নেই কিংবা তা আমি ফিরিয়েও নেব না।”
এর ৪৫ বছর পর গত জুন মাসে তার সিংহাসনে আরোহণের প্ল্যাটিনাম জয়ন্তী উপলক্ষে জাতির কাছে লেখা এক ধন্যবাদ-পত্রে সেবা করার সেই একই প্রতিশ্রুতি তিনি আবার তুলে ধরেছিলেন।
এই জয়ন্তীর মাইলফলকটি উদযাপিত হয় বহু প্রাণবন্ত স্ট্রিট পার্টি এবং রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান ও ব্রিটিশ জীবনযাত্রার ওপর নানা ধরনের রঙিন উৎসবের মধ্য দিয়ে।
যদিও ভগ্ন স্বাস্থ্যের জন্য রানি বেশ কিছু অনুষ্ঠানে সশরীরে উপস্থিত হতে পারেননি, তিনি শুধু বলেছিলেন, “আমার সমস্ত হৃদয় রয়েছে আপনাদের সবার সাথে।” (বিবিসি)
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।