ভেইনু বাপ্পু মানমন্দির: আধুনিক ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার মাইলফলক

ভেইনু বাপ্পু মানমন্দির

যন্তর-মন্তর ভারতের প্রাচীন জ্যোতির্বিজ্ঞানবিষয়ক মানমন্দির। মোগল সাম্রাজের শেষের দিকে ১৭২৪ থেকে ১৭৩৪ সাল—১০ বছরের মধ্যে জয়পুরের মহারাজা সোয়াই দ্বিতীয় জয় সিং ভারতের বিভিন্ন স্থানে যন্তর-মন্তর নামের বেশ কয়েকটি মানমন্দির স্থাপন করেন। এগুলোর মধ্যে দিল্লি, জয়পুর ও উজ্জয়িনী মানমন্দিরের অবস্থা মোটামুটি ভালো। এসব মানমন্দিরে ইটের তৈরি বিশাল সূর্যঘড়ি, আস্তারলাব ও বিভিন্ন ধরনের কোণ পরিমাপক যন্ত্র ছিল। তবে ছিল না কোনো দুরবিন। বর্তমানে এসব মানমন্দিরে কোনো গবেষণা হয় না। তবে ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে।

ভেইনু বাপ্পু মানমন্দির

 

জয় সিং জন্মগ্রহণ করেন নিউটনের প্রিন্সিপিয়া প্রকাশের ১ বছর আগে ১৬৮৬ সালে। মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি অম্বর রাজসিংহাসনে আরোহণ করেন। ভীষণ আগ্রহ ছিল আরব ও পারস্য জ্যোতির্বিজ্ঞানের প্রতি। একই সঙ্গে পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞানেও।

জয় সিংয়ের রাজজ্যোতিষী পণ্ডিত জগন্নাথেরও আরবি ও ফারসিতে ভালো দখল ছিল। আরবি থেকে সংস্কৃতে তিনি অনুবাদ করেন রেখাগণিত ও সিদ্ধান্ত সম্রাট। প্রণয়ন করেন তারা-সারণি ‘জিজ-ই-মুহাম্মদ শাহি’। এটি উত্সর্গ করেন তত্কালীন ভারতের সুলতান মোহাম্মদ শাহকে। জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চায় মধ্যযুগীয় ঐতিহ্যকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরেছিলেন তিনি এবং অনুসারী ছিলেন অ্যারিস্টটল-টলেমির ভূকেন্দ্রিক মতবাদে। ফলে শতচেষ্টা করেও তিনি এ থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার সঙ্গে যুক্ত হতে পারেননি।

জয় সিং মৃত্যুবরণ করেন ১৭৪৩ সালে, কোপার্নিকাসের মৃত্যুর ঠিক ২০০ বছর পর। যন্তর-মন্তরের প্রায় ৬৮ বছর পর ১৭৯২ সালে মাদ্রাজে স্থাপিত হয় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ‘মাদ্রাজ মানমন্দির’। এটি আবার ১৮৯৯ সালে কোদাইকানালে স্থানান্তরিত হয়। এর নতুন নামকরণ হয় ‘কোদাইকানাল সোলার মানমন্দির’।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা (ইউনেসকো) যন্তর-মন্তরকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান বা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।

‘ভেইনু বাপ্পু মানমন্দির’ ভারতবর্ষের সর্বাধুনিক মানমন্দির। এটি স্থাপিত হয় ১৯৮৬ সালে। ভারতের তামিলনাড়ু জেলার কাভালুর গ্রামের জাভাদি পাহাড়ের ওপরে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭২৫ মিটার উচ্চতায়। এটি বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিকস’–এর নিজস্ব একটি মানমন্দির।

ভেইনু বাপ্পু মানমন্দিরের যাত্রা শুরু হয় ১৯৬৮ সালে। প্রথম দিকে এর নাম ছিল কাভালুর মানমন্দির। এর সর্ববৃহৎ প্রতিফলক দুরবিনের ব্যাস ৯৩ ইঞ্চি (২ দশমিক ৩ মিটার)। দুরবিনটি স্থাপনের পেছনে ভারতের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ভেইনু বাপ্পুর অবদান ছিল অপরিসীম। এ ছাড়া ৪০ ইঞ্চি, ৩০ ইঞ্চি, ২৪ ইঞ্চি প্রভৃতি ব্যাসের বেশ কয়েকটি দুরবিন রয়েছে। এগুলো গবেষণার কাজে ব্যবহৃত হয়।

শুধু দর্শকের জন্য রাখা আছে ৬ ইঞ্চি পরিসরের দুটি দুরবিন। ৪০ ইঞ্চি দুরবিন দিয়ে ১৯৭৭ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র ভট্টাচার্য ও কুপ্পস্বামী ইউরেনাস গ্রহের বলয় আবিষ্কার করেন। এ ছাড়া ১৯৮৮ সালে আবিষ্কৃত হয় একটি গ্রহাণু। গ্রহাণুটির নাম ‘৪১৩০ রামানুজন’। এটি প্রখ্যাত ভারতীয় গণিতবিদ শ্রীনিবাস রামানুজনের স্মরণে নামকরণ করা হয়েছে।

ভারতবর্ষের একমাত্র ধূমকেতু আবিষ্কারক হিসেবে ভেইনু বাপ্পুর (১৯২৭-১৯৮২) নাম স্মরণযোগ্য। ১৯৪৮ সালের কথা। অবসান ঘটেছে ব্রিটিশ শাসনের। বাপ্পু মাত্র মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সম্পন্ন করেছেন। তাঁর বাবা অন্ধ্র প্রদেশের নিজামিয়া মানমন্দিরের একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী। বাবার দেখাদেখি তিনিও বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন এবং সুযোগ খুঁজতে থাকেন।

একদিন কাকতালীয়ভাবে ঘটে সেই সুযোগ। যখন যুক্তরাষ্ট্রের বরেণ্য জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও হার্ভার্ড কলেজ মানমন্দিরের পরিচালক হার্লো শার্পলি হায়দরাবাদে আসেন। শার্পলির সঙ্গে দেখা করতে হায়দরাবাদের হোটেলে যান বাপ্পু। এরপর বাপ্পুকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি হায়দরাবাদ সরকারের বৃত্তি নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানের ওপর পিএইচডি করতে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে গিয়ে তিনি যৌথভাবে একটি ধূমকেতু আবিষ্কার করেন। ধূমকেতুটির নাম ‘বাপ্পু-বক-নিউকির্ক’।

এই আবিষ্কারের জন্য বাপ্পুকে অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল সোসাইটি অব দ্য প্যাসিফিক ‘ডোনোহো পদক’ দিয়ে সম্মানিত করেন। এ ছাড়া ১৯৫৭ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী অধ্যাপক ওলিন উইলসনের সঙ্গে যৌথভাবে আবিষ্কার করেন ‘উইলসন-বাপ্পু ইফেক্ট’। এই মৌলিক আবিষ্কারটি নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আমেরিকায় অবস্থানকালে পালোমার পর্বত মানমন্দিরের ২০০ ইঞ্চি দুরবিন দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়েছিল তাঁর।

১৯৭৯ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ইউনিয়নের (আইএইউ) সভাপতি নির্বাচিত হন তিনি। এর আগে ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত মোট ৬ বছর তিনি আইএইউর সহসভাপতি ছিলেন। মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ১৯৮২ সালে বাপ্পু মৃত্যুবরণ করেন। তিনি ছিলেন ভারতের জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার একজন সফল উদ্যোক্তা এবং মানমন্দিরটির স্বপ্নদ্রষ্টা। মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণেই এর নামকরণ হয় ‘ভেইনু বাপ্পু মানমন্দির’। ১৯৮৬ সালে তত্কালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মানমন্দিরটি উদ্বোধন করেন।

ভেইনু বাপ্পুর সঙ্গে আমাদের রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের একটি ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। সম্পর্কটি হলো রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর জন্য হার্ভার্ড কলেজ মানমন্দির থেকে প্রেরিত দুরবিনটি কাভালুর মানমন্দিরের সামনে আরেকটি ছোট মানমন্দির তৈরি করে ঐতিহাসিক মর্যাদায় ‘বাপ্পুচন্দ্র মানমন্দির’ নামে স্থাপন করা হয়েছে। পরে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভারতের ভবিষ্যৎ জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের উদ্দেশ্যে উত্সর্গ করা হয় এটি।