জুমবাংলা ডেস্ক : খেলাধুলায় বেশ আগ্রহী ছিল মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র মাহিন আহমেদ। ক্রিকেট ও ফুটবলের পাশাপাশি সাইকেলের রেসসহ দুই চাকার এ যান নিয়ে নানা কলাকৌশল প্রদর্শনে সে মুগ্ধ করত সবাইকে। ভবিষ্যতে ক্রীড়াবিদ হওয়ার কথাও বলত প্রায়ই। তবে সেই স্বপ্ন ছোঁয়া হলো না তার।
গত বৃহস্পতিবার রাতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় নিভে যায় তার জীবন প্রদীপ। গতকাল শুক্রবার বিকেলে তার মৃতদেহ বাসায় পৌঁছলে শোকের মাতম ওঠে। প্রাণচঞ্চল স্বভাবের ছেলেটির এমন ‘শান্ত’ রূপ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না মা জ্যোৎস্না বেগম। কাঁদতে কাঁদতে বারবার অচেতন হয়ে পড়ছিলেন। আর বাবা মাসুম আহমেদ যেন শোকে পাথর হয়ে গেছেন।
পরিবারের সঙ্গে রাজধানীর উত্তর মুগদার মামা-ভাগনে গলির ভাড়া বাসায় থাকত মাহিন। বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ৯টার দিকে খেলা শেষ করে বন্ধুর সঙ্গে হেঁটে তার চাচার বাসায় যাচ্ছিল। পথে মুগদার মদিনাবাগ এলাকায় সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ি পেছন থেকে তাকে ধাক্কা দেয়। এতে ছিটকে পড়ে সে গুরুতর আহত হয়। তাকে উদ্ধার করে প্রথমে মুগদা জেনারেল হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে নেওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। তার বাবা গার্মেন্ট একসেসরিজের ব্যবসায়ী। তিন সন্তানের মধ্যে মাহিন দ্বিতীয়। তাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলায়।
বড় ছেলেকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলেও অর্থাভাবে সেটা পূরণ হয়নি। পরে মাহিনকে নিয়েই ঘিরে ছিল পরিবারের সব স্বপ্ন। মতিঝিল আইডিয়ালে তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে তার একমাত্র বোন ফাতেমা আক্তার আফরিন। তারা একসঙ্গে যাওয়া-আসা করত। এখন কী করে মেয়ে স্কুলে যাবে সেই চিন্তা মায়ের। এদিকে আফরিন শুধুই কাঁদছে। তাকে বলতে শোনা যায়, ‘তারা দুই ভাই-বোন একসঙ্গে স্কুলে যেত। এখন কে তাকে স্কুলে নিয়ে যাবে?’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মাহিনের মা বলেন, ‘সন্ধ্যা ৭টার দিকে আমার সঙ্গে ইফতার করে মাহিন। ইফতার শেষে বলে আম্মু আমি বক্করদের (বন্ধু) বাসায় খেলা করতে যাচ্ছি। রাতে ছোট চাচার বাসায় থাকব। ওর চাচা বাসায় একা থাকছে বলে গত ১৫ দিন সেখানেই থাকে। সকালে ওর চাচা অফিসের যাওয়ার সময় চলে আসে। কিন্তু ছেলে আমার একেবারে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।’
মুগদা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) কামরুল হোসাইন জানান, এ ঘটনায় মাহিনের বাবা বাদী হয়ে সড়ক পরিবহন আইনে মামলা করেছেন। দুর্ঘটনার সময় গাড়িটি চালাচ্ছিলেন হেলপার মো. রুবেল। তাঁকে গ্রেপ্তারের পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গতকাল পাঁচ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। তিনি প্রথমে দাবি করেন, তাঁর ড্রাইভিং লাইসেন্স আছে। তবে তিনি তা দেখাতে পারেননি। গাড়িটির মূল চালক কামাল হোসেনকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
গতকাল সন্ধ্যায় মাহিনের বাসায় গিয়ে দেখা যায় কেউ উচ্চ স্বরে কাঁদছেন, কেউ নীরবে চোখ মুছছেন। পাগলপ্রায় মাহিনের মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছেন প্রতিবেশীরা। মাহিনের বড় ভাই মাহফুজ আহমেদ দাফন শেষ করে বাসায় এসে বিলাপ করছিলেন। তিনি বলছিলেন, ‘ভাই তুই আমার কাছে টাকা চাইলি, কিন্তু দেওয়ার সময়টুকুও দিলি না। আমার রেখে কেন তুই এভাবে চলে গেলি। তোকে ছাড়া আমরা কী করে বাঁচবো।’
মাহফুজ জানান, কয়েক দিন ধরে ছোট চাচার বাসায় থাকছিল মাহিন। বৃহস্পতিবার রাতে সে তার বন্ধু আবু বক্করের সঙ্গে কিছুক্ষণ খেলবে জানিয়ে বাসা থেকে বের হয়। এর পর তার চাচার বাসায় যাওয়ার কথা ছিল। সেখানে যাওয়ার পথেই এ দুর্ঘটনা ঘটে। ওর সঙ্গে থাকা বন্ধু বাসায় এসে খবর জানায়। তখন সবাই হাসপাতালে ছুটে যান।
মৃত্যুর আগে মাহিন বড় ভাই মাহফুজকে বলেছিল, ‘আমি তো আর বাঁচব না ভাইয়া, তুমি বাবা-মাকে দেখে রেখো।’ এটাই তার শেষ কথা। মুগদা হাসপাতাল থেকে ঢামেক হাসপাতালে নেওয়ার সময় ওর অবস্থা সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর মা তাকে কলেমা পড়ান। এ সময় পানি চাইলেও ছেলের মুখে একটু পানি দিতে না পারার কষ্ট তার যেন শেষ হচ্ছে না। বলছিলেন, ‘ছেলে আমার কাছে একটু পানি খেতে চাইল, আর আমি দিতে পারলাম না।’ গতকাল রাতে মুগদা কবরস্থানে তার লাশ দাফন করা হয়েছে।
ময়লাবাহী গাড়ির চাপায় একের পর এক মৃত্যু
ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কা বা চাপায় প্রাণহানি থামছে না। গত তিন বছরে এমন ঘটনায় অন্তত ১৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই মূল চালকের বদলে হেলপার বা বদলি চালক গাড়ি চালাচ্ছিলেন। এসব দুর্ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। আবার সিটি করপোরেশনের গাড়িচালকদের অনেকেরই ভারী যান চালানোর লাইসেন্স নেই।
এর আগে ২০২১ সালের ২৪ নভেম্বর গুলিস্তানে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নটর ডেম কলেজের ছাত্র নাঈম হাসান মারা যান। পরদিন ২৫ নভেম্বর পান্থপথ এলাকায় প্রাণ হারান সংবাদকর্মী আহসান কবির খান। ওই বছর এ ধরনের দুর্ঘটনায় অন্তত সাতজনের মৃত্যু হয়। ২০২২ সালে ময়লার গাড়ির ধাক্কায় মারা যান চারজন। ২০২৩ সালের ৬ মার্চ ময়লাবাহী গাড়িচাপায় আবু তৈয়ব নামের একজন কাপড় ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়।
শিক্ষার্থী মাহিনের মৃত্যুর জন্য দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস। শুক্রবার সন্ধ্যায় মুগদায় মাহিনের জানাজা শেষে তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, নির্ধারিত গাড়িচালক গাড়িটা চালাচ্ছিলেন না। অন্য একজনকে টাকা দিয়ে গাড়িটি চালানো হচ্ছিল। এর আগেও এ ধরনের ঘটনায় জড়িত সবাইকে কর্মচ্যুত ও ছাঁটাই করা হয়েছে।
এ ধরনের ঘটনায় শাস্তি দেওয়ার পরও কেন পরিবহন ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা আসছে না– সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে মেয়র বলেন, এটা দুঃখজনক। আরও এ রকম অবহেলা গাফিলতি থাকতে পারে। এ জন্য কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং পুনঃসংস্কার করা হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।